বন্যার আশঙ্কায় পরিত্যক্ত, অথচ বন্যা হলো না কোনোদিনই

 


ODD বাংলা ডেস্ক: চারিদিকে জলরাশি। আর তার মধ্যে জেগে রয়েছে ছোট্ট একটি শহর। শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট বাড়ি-ঘর, গির্জা। শহরের কেন্দ্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক পাথরের দুর্গ। দেখেই বোঝা যাবে তা তৈরি হয়েছিল মধ্যযুগে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে হঠাৎ কেন গড়ে উঠল এমন শহর?

স্পেনের (Spain) কাসেরেস প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমের এই শহরে গেলে মনে মধ্যে উঁকি দেবে এই প্রশ্নই। তবে মজার বিষয় হলো, কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ওপর এই শহর তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছিল মূল ভূখণ্ডেই। বরং, জলরাশিই ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে এই শহরের চারদিক। কেড়ে নিয়েছে এই শহরের প্রাণ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ছবির মতো সুন্দর, সাজানো-গোছানো এই শহরে মানুষের অস্তিত্ব নেই কোনো। 


গ্রানাডিলার কথা বলছি। আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগের কথা। নবম শতকে গড়ে উঠেছিল স্পেনের এই মধ্যযুগীয় নগর। নেপথ্যে ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী বণিকরা। ইউরোপ এবং আফ্রিকা সংযোগকারী পথের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় তৎকালীন সময়ে বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল গ্রানাডিলা। অবশ্য তখন তার নাম ছিল গ্রানাডা। 


সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের আমলে এই শহর হয়ে ওঠে লিও সাম্রাজ্যের অংশ। নগরীর চারদিকে নির্মিত হয় সুউচ্চ প্রাচীর, তৈরি হয় দুর্গ। মধ্যপ্রাচ্যের বেদুইনদের আক্রমণ ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ফার্দিনান্দ।


তবে যে শহর মধ্যযুগীয় যুদ্ধের আবহেও টিকে ছিল, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সেটা পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক। ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্কোর শাসনকাল। তার সিদ্ধান্তেই শুরু হয়েছিল স্পেনের এই প্রদেশে প্রকাণ্ড এক কৃত্রিম জলাধার তৈরির প্রকল্প। আজ যা পরিচিত গ্যাব্রিয়েল এবং গ্যালান রিজার্ভার নামে। তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম ড্যামগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই দুই জলাধার। তবে নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য গোটা অঞ্চলটি প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। 


১৯৬০ সালে ফ্র্যাঙ্কোর নির্দেশেই রাতারাতি খালি করে দেওয়া হয় এই নগরী। সব মিলিয়ে প্রায়  এক হাজারেরও বেশি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হয় বন্যার আশঙ্কায়। তবে শাসকের পক্ষ থেকে কোনোরকম ক্ষতিপূরণই পাননি তারা। আর গ্রানাডিলা? 


বাঁধ তৈরির পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৬ দশক। তবে আজও অক্ষত রয়েছে এই মধ্যযুগীয় শহর। কোথাও কোথাও আগাছা গজিয়ে উঠলেও দিব্যি বাসযোগ্য করেছে এই শহরের বাড়ি-ঘর। হ্যাঁ, যে বন্যার আশঙ্কায় বিতাড়িত করা হয়েছিল এই শহরের বাসিন্দাদের, সেই বন্যা আজও স্পর্শ করেনি গ্রানাডিলাকে। শুধু মূল ভূখণ্ডের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাকে। 


গ্রানাডিলার চারপাশের অঞ্চল গ্রাস করেছে জলরাশি। আজও চাইলে অনায়াসেই সেতু তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায় এই শহরের। তবে সে-ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই স্প্যানিশ প্রশাসনের। বরং, এই পরিত্যক্ত শহরই এখন হয়ে উঠেছে স্পেনের ঐতিহ্য। 


প্রতিবছর এই শহর দেখতে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক। ১৯৮৪ সালে পর্যটন শিল্পের কথা মাথায় রেখে এই শহর সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও নিয়েছিল স্প্যানিশ সরকার। পাশাপাশি সংরক্ষণের কাজে সমানভাবে অংশ নিয়ে চলেছেন স্পেনের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ারাও। সব মিলিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মধ্যযুগীয় নগরী। শুধু বিচার পায়নি তার আদি-বাসিন্দারা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.