ঘাসের তৈরি ঝুলন্ত সেতু, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও যার কোনো ক্ষতি হয় না !

ODD বাংলা ডেস্ক: একটি সেতু তৈরি করতে যেখানে শক্তিশালী সব স্টিলসহ কংক্রিট ব্যবহার করা হয় সেখানে ঘাস দিয়ে কীভাবে সেতু তৈরি করা যায়! তাও আবার যতই ঝড়-বৃষ্টি হোক বা যাতায়াত, সেই সেতুর ঘাস কখনোই ছিঁড়বে না। অবাক করা বিষয় হলেও কিন্তু সত্যিই।

দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রাচীন সভ্যতার নাম হলো ইনকা। এই জাতিগোষ্ঠীরাই যুগের পর যুগ ধরে এই ঘাসের সেতু তৈরি করে বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। এই সেতুটি তৈরির দিন থেকে প্রায় এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সেটা দুর্বল হওয়া শুরু করে। তখনই নতুন করে অভিবন উপায়ে আবারো সেতু নির্মাণে নেমে পড়ে ইনকারা।

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন যোদ্ধাজাতির এই অদ্ভুত কৌশল তাক লাগিয়ে দেয়। অতি দুর্গম স্থানে খরস্রোতা নদীর ওপর দিয়ে অসাধারণ প্রযুক্তি নিয়ে চলছে এই যাত্রা। পেরুর কুসকো রাজ্যের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে আপুরিম্যাক নদী। এই নদীর অববাহিকায় বাস করছেন ইনকা সভ্যতার উত্তরসূরীরা। নদীর উপরে চলাচলের জন্য তারা যে সেতু ব্যবহার করেন সেটা তৈরি হয় ঘাস দিয়ে। 

শতাব্দীর পর শতাব্দী চলছে। আর একই স্থানে তৈরি হয়েছে নিত্যনতুন ঘাসের সেতু। প্রতিবারই পুরনো সেতু কেটে সেই ঘাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এটা নাকি রীতি। ইনকা সভ্যতার লোকেরা মনে করেন, প্রকৃতির দান প্রকৃতিতেই চলে যাওয়া দরকার। তেমনি একটি অদ্ভুত ঘাস সেতুর রয়েছে কিউএসওয়াচাকাতে। 

কোয়া ইচু নামের বিশেষ ধরনের শক্ত ঘাস দিয়ে তৈরি করা হয় এই সেতু। কীভাবে তৈরি করা হয় এই সেতু? সেতুর প্রতিটি দড়ি বোনা হয় হাত দিয়ে। তার আগে প্রতিটি ঘাস পাথর দিয়ে পিটিয়ে সমান করা হয়। তারপর পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ, যেন সেতুটি নমনীয় থাকে। এই দুর্গম এলাকায় একই স্থানে ৬০০ বছর ধরে রয়েছে কোয়া ইচু ঘাসের সেতু। স্থান না পাল্টালেও তার ঘাস কিন্তু প্রতি বছরে পাল্টে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে এই সেতুটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়। 

ইনকা সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সংযোগ হিসেবে কাজ করতো এই সেতুগুলো। খুবই ঝুঁকিবহুল হিসেবে এর উপর দিয়ে খরস্রোতা নদী পার হওয়া সম্ভব। ইনকা প্রথা অনুযায়ী, এই সেতু নির্মাণে যুক্ত থাকতে পারেন শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা। তবে নারীরা পাহাড়ের উপর বসে ছোট ছোট দড়ি বোনার কাজ করেন। 

নতুন সেতু বসানোর আগে পুরুষেরা পুরোনো সেতুটি সরিয়ে নেন। তারা ছোট ছোট দড়িগুলোকে একসঙ্গে করে নেয়। এই সেতুর প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ছয়টি বড় আকারের ত্রিপাল দড়ি। যেগুলোর প্রতিটি প্রায় এক ফুট মোটা হয়ে থাকে। ১২০টি চিকন দড়ি পেঁচিয়ে এটি তৈরি করা হয়। সেতু নির্মাণের এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো আধুনিক সরঞ্জাম বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। এখানে ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র ঘাস আর জনশক্তি।

সেতু বানানোর সময় ইনকারা বিভিন্ন কাজ ভাগ করে নেন। রান্নার কাজে যারা যুক্ত থাকেন, তারা ঘাস নিয়ে কোনো কাজ করবেন না। রান্নার কাজে যারা যুক্ত থাকেন, তারা কাঠের চুলায় রান্নার আয়োজন করেন। এই কাঠের চুলাগুলো গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়। তারা রান্না করে থাকেন মুরগি, গিনিপিগ, ট্রাউট মাছের মতো আরো নানা ধরনের খাবার। তবে প্রতিটি খাবারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন আকার ও রঙের আলু থাকতেই হয়। 

যারা বেশি সাহসী, তারা ঝুঁকি নিয়ে সেই ঘাসের দড়ি নিয়ে এক পাহাড়ের মাথা থেকে অন্য পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত নিয়ে যান। তারপর সেই প্রধান দড়ি দিয়েই তৈরি করা হয় সেতু। ঝড় হোক, পানি হোক বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ একেবারে নিখুঁত থাকে এই ঘাস। কিন্তু এক বছরের মাথায় এসে সেটি ফেলে দিতে হবেই। ইনকারা মনে করেন, প্রকৃতির দেয়া দানের এই মেয়াদ মাত্র এক বছর। 

কিউএসওয়াচাকা নামের এই সেতুটি বানানো শেষে আয়োজন করা হয় খাবার দাবার আর সংগীতানুষ্ঠানের। মূলত চারদিন ধরে চলে এই সেতু বানানোর আনুষ্ঠানিকতা। চতুর্থ দিনেই উৎসব করা হয় এবং প্রতিবছর ২ জুন তাদের এই উৎসবের দিনটা পড়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.