যে জীবন জলের, জঙ্গলের, ক্যামেরার…কুমিরের। এক ‘রেপটাইল ম্যানে’র কাহিনি



 ODD বাংলা ডেস্ক: কুমির কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। কুমিরকে মাস্ক পরিয়ে নিজেও মাস্ক পরে শুয়ে আছেন সরীসৃপটির পাশে। ডিম ফুটিয়ে বের করে আনছেন কুমিরের বাচ্চা। এরকম বেশ কিছু ছবি দেখে প্রথমে একটু চমকেই গিয়েছিলাম।


প্রখ্যাত বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী এই মানুষটির উপাধি দিয়েছেন রেপটাইল ম্যান অভ বাংলাদেশ। তার নাম আদনান আজাদ। জল, জঙ্গল, ক্যামেরা আর কুমির নিয়ে এই মানুষটির বাস।


এই কুমিরপ্রেমীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য একদিন পাকড়াও করলাম লেখক বাপ্পী খান ভাইকে। তিনি তখন নতুন বই নিনাদ নিয়ে মহাব্যস্ত, তবু একদিন সময় করে আদনানের সঙ্গে বসিয়ে দিলেন আড্ডায়। 


আড্ডায় বসে জানতে পারলাম, শুধু কুমির নয়, আদনান ভালোবাসেন তাবত বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতিকে। আড্ডা দিতে গিয়ে জানতে পারলাম আরও কয়েকটি পরিচয় আছে তার—তিনি একাধারে সরীসৃপ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার এবং অভিনেতাও। মায়া হরিণ থেকে শুরু করে সাদা বাঘ—বিরল সব প্রাণী ধরা পড়েছে তার ক্যামেরায়। ঘণ্টা পাঁচেকের ম্যারাথন আড্ডায় উঠে এল তার রোমাঞ্চকর জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র।


মায়ের ক্যামেরা দিয়ে শুরু


ছবি তোলার নেশা আদনানের ছোটবেলা থেকেই। বাসায় তার মায়ের একটা ফিল্মের ক্যামেরা ছিল। ওই ক্যামেরার ফিল্মের বেশিরভাগই খরচ করতেন কিশোর আদনান—মুরগি, কাক, ছাগলের ছবি তুলে। পরে ফিল্ম নষ্টের ব্যাপারটি মা যখন টের পেতেন, আদনানের কপালে জুটত পিটুনি।


অবশেষে ক্লাস নাইনে উঠার পর ভাগ্নের ছবি তোলার শখ দেখে আদনানের খালা দেশের বাইরে থেকে একটা ফিল্ম ক্যামেরা (মিনোল্টা) পাঠালেন। সেটা দিয়েই আদনানের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির শুরু। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর, ১৯৯৮ সাল থেকে, প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে পাখির ছবি তোলা শুরু করেন। ওই সময় থেকেই তিনি বনে যাওয়া শুরু করেন ছবি তোলার জন্য।


শুরুতে নিজ এলাকা বগুড়ার বন-জঙ্গলে ছবি তুলতেন আদনান। তারপর ধীরে ধীরে ফটোগ্রাফি করার দামি ক্যামেরা কেনেন।



বন্য জীবনের নেশায়…


এরপর থেকেই দেশ ও দেশের বাইরের বনাঞ্চলে ছুটে বেড়াচ্ছেন ছবি তোলার নেশায়। আদনানের তোলা ছবি প্রথম পত্রিকায় ছাপা হয় ২০০৪-০৫ সালের দিকে, দৈনিক জনকণ্ঠে। এরপর থেকে দেশের প্রথম সারির প্রায় সমস্ত দৈনিকেই নিয়মিত ছাপা হয়ে আসছে তার তোলা বন্যপ্রাণীর ছবি।


আদনান জানালেন, তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব বনেই একাধিকবার, কোনো কোনো বনে শতাধিকবার গেছেন ছবি তোলার জন্য। এছাড়া ভারতের মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় ন্যাশনাল পার্ক, উত্তরখণ্ডের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক, রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কসহ বেশ কিছু বনে গিয়েও ছবি তুলেছেন। 


এছাড়া আদনানের তোলা ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিবিসি আর্থসহ দেশের বাইরের বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছে।।


আড্ডার এক পর্যায়ে আদনান কিছুটা আফসোসের সুরে বললেন, পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির বড় বাজার থাকলেও বাংলাদেশে এই বাজার নেই বললেই চলে। বললেন, 'আগামীতে বাংলাদেশের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি মার্কেট কখনো হবে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করা ভীষণ কঠিন। কারণ বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বনের ঘনত্ব এত বেশি যে এক হাত দূরে কী আছে, তা-ও দেখতে পাবেন না।'



আদনান আজাদের তোলা বন মোরগের ছবি

বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজের জন্য ছেড়েছেন অভিনয়ও


অভিনয়-জগতেও ভালো অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন আদনান। ২০০৮ সালে অভিনয় শুরু করেন তিনি। এরপর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কাজ করেছেন ৮৮টি বিজ্ঞাপনচিত্রে।


২০১৭ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজ করেছেন আদনান। কিন্তু একসময় দেখলেন অভিনয় তার কাছ থেকে অনেক বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছে, বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার সময় পাচ্ছেন না। সে কারণে অভিনয় থেকে বিরতি নিয়ে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেন। তবে সামনে আবারও অভিনয়ে ফেরার ইচ্ছা আছে বলে জানালেন তিনি।


একাই ৫০০-র বেশি সাপ উদ্ধার


ছোটবেলা থেকেই আদনান অন্যদের চেয়ে একটু অন্যরকম কাজ করার চেষ্টা করতেন। তাদের বাড়ির চারপাশে ছিল তিনটা পুকুর। বর্ষায় দাঁড়াশ, ঘরগিন্নী, গোখরা প্রভৃতি সাপ চলে আসত তাদের বাড়িতে। ঘরে ঢুকলে বড়রা প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতেন। তখন সাপগুলোর জন্য আদনানের খুব মায়া হতো।


আদনান তখন খুব সম্ভব প্রথম শ্রেণিতে পড়েন। একদিন একটা গোখরা সাপের বাচ্চা ঢুকে পড়ে তাদের ঘরে। ছোট্ট আদনান সাপটার লেজ ধরে নিয়ে গিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি তখন কোনটা কী সাপ, তা চিনতেনও না।


একটু বড় হওয়ার পর আদনান সাপ-সম্পর্কিত বই পড়তে শুরু করেন। সাপুড়ে বা বেদেদের দেখে সাপ কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করতেন। বাড়িতেই দড়ি বা ফিতাকে সাপ বানিয়ে সাপ ধরার প্র্যাকটিস করতাম। বিভিন্ন বাড়িতে সাপ ঢুকলে বড় বাঁশ বা লাঠির ডগায় উঠিয়ে সেগুলোকে বাইরে ফেলে দিতেন। এভাবেই তার সাপ উদ্ধার শুরু।


এরপর ২০১৪ সালে বন্ধু ও সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ শাহরিয়ার সিজার রহমানের কাছ থেকেই খাতায়-কলমে সাপ ধরা শেখেন আদনান। 


এ পর্যন্ত একাই পাঁচশোর বেশি সাপ উদ্ধার করেছেন আদনান। তার উদ্ধার করা সাপের তালিকায় আছে—রাজগোখরা, গোখরা, খৈয়া গোখরা, দাঁড়াশ, ঘরগিন্নী, দুধরাজ, শঙ্খিনী, কেউটে প্রভৃতি।




জী বাংলার মিরাক্কেল চ্যাম্পিয়ন আবু হেনা রনি উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আদনান আজাদের সঙ্গে একটি অজগর উদ্ধার করে অবমুক্ত করেন | ছবি: সংগৃহীত

সাপ উদ্ধারের ঝুঁকি কেমন, জানতে চাইলে আদনান বলেন, 'সাপ উদ্ধারকাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটু ভুল বা অসাবধানতায় নিজের জীবন চলে যেতে পারে। তবু ভালো লাগে যখন ভাবি লোকালয় থেকে সাপ উদ্ধারের মাধ্যমে সাপ মানুষ উভয়ের জীবন বাঁচে।'


কুমিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা


এবার আদনানের কাছে জানতে চাইলাম তার কুমিরপ্রেমের উৎস কোথায়। আদনান জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ স্টিভ আরউইনের ভক্ত। টিভিতে বারবার তার সাপ ধরা, কুমির ধরা দেখতেন। ফেসবুকে পোস্ট করা ছবির মন্তব্যের ঘরেও অনেকেই আদনানকে বাংলাদেশের স্টিভ অরউইন বলে ডাকেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বিনয় করে বললেন, 'স্টিভ একজন কিংবদন্তি, আমার ছোটবেলার আইডল। তার সঙ্গে আমার কোনোভাবেই তুলনা চলে না।'


২০১০ সালের দিকে বছর রাজশাহীর একটি গ্রামে কুমির আটকানো হয়। ওই কুমিরটিকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন আদনান। সেটাই তার প্রথম কুমির সামলানোর ঘটনা।


তবে আদনান আনুষ্ঠানিকভাবে কুমির চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন ২০১৭ সালে। আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেসবুকে তার বন্ধুতালিকায় ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বন্য প্রাণী নিয়ে আদনানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারেন।


একদিন তিনি আদনানকে তার মতিঝিলের অফিসে ডেকে নিয়ে নিজের কুমিরের খামার সম্পর্কে জানান। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কুমিরের খামার মাত্র দুটি। একটি ময়মনসিংহের ভালুকায়, যার মালিক ছিলেন প্রয়াত লেখক মুশতাক আহমেদ; অপরটির মালিক আকিজ গ্রুপ।


এছাড়া দেশে একটি সরকারি কুমির খামারও আছে, সুন্দরবনের করমজলে। এটি বাংলাদেশের প্রথম কুমির খামার। এখানে উৎপাদিত কুমিরগুলো সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়, সেখানকার কুমিরের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।


কুমিরের প্রজনন কীভাবে করতে হয়, শিখলেন কীভাবে? সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম দিলাম আদনানের উদ্দেশে।


তিনি বললেন, 'আমি ছোটবেলা থেকেই খাঁচার পাখি পালতাম এবং খাঁচার পাখির বাচ্চা প্রজনন করতাম। এতে করে সেই ছোটবেলা থেকেই পাখির ব্রিডিংয়ের ওপর আমার ব্যাপক দখল চলে আসে। এখান থেকেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করার ওপর আমার একটা সহজাত দখল চলে আসে। এই অভিজ্ঞতা দারুণ কাজে লেগেছে পরে কুমিরের ব্রিডিংয় করার সময়।


'এছাড়া ভারতে একটি বড় ব্রিডিং সেন্টার আছে। সেখানে গিয়ে আমি দেখে এসেছি কীভাবে কুমির চাষ করা হয়। তাছাড়া কুমির বিশেষজ্ঞ হাসান জাহিদ চৌধুরী ও প্রয়াত মুশতাক আহমেদের কাছ থেকেও কুমির বিষয়ে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। হাসান জাহিদ চৌধুরী ছিলেন আমার মেন্টর।'


কুমিরের সঙ্গে বসবাস


যাহোক, কক্সবাজারের নাইক্ষ্যংছড়িতে অবস্থিত আকিজ গ্রুপের কুমির খামারের দায়িত্ব নিলেন আদনান। ১০০ বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত খামারটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কুমির খামার।


আদনান যখন খামারের দায়িত্ব নেন, তখন সেখানে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা প্যারেন্টস স্টকের ৫০টা কুমিরসহ মোটমাট ৫০০-র মতো কুমির ছিল। এরপর গত পাঁচ বছরে অক্লান্ত পরিশ্রমে সেখানে কুমিরের সংখ্যা বাড়িয়ে কয়েক হাজারে নিয়ে গেছেন তিনি।


আদনান জানালেন, ব্রিডার কুমিরদের থাকার ব্যবস্থা আলাদা। একজোড়া পুরুষ ও স্ত্রী কুমিরকে আলাদা একটি বেষ্টনীর ভেতরে রাখা হয়। বেষ্টনীর ভেতরে আট ফুট গভীর ও ত্রিশ ফুট লম্বা চৌবাচ্চা থাকে। বর্ষায় ডাঙায় উঠে জলের পাশে স্ত্রী কুমির বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। তারপর পেছনের পা দিয়ে আঁচড়ে মাটি খুঁড়ে লতাপাতা দিয়ে ডিমগুলোকে ঢেকে দেয়। সেখান থেকে ডিম তুলে ইনকিউবেটরে প্রজনন করা হয়। ব্রিডিং কুমিরের জোড়া সারাবছর একসঙ্গেই থাকে।



ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার আগপর্যন্ত পুরো সময়টা স্ত্রী কুমির ডিম পাহারা দেয়, যাতে অন্য কোনো প্রাণী ডিমগুলো খেয়ে ফেলতে না পারে। তাই অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ডিম সংগ্রহ করতে হয়।


বাংলাদেশের কুমির


আদনান জানালেন, বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে তিন ধরনের কুমির পাওয়া যায় বা যেত। একটি হচ্ছে, সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল বা লোনা জলের কুমির। এর আরেক নাম ইন্দো-প্যাসিফিক ক্রোকোডাইল। বাংলাদেশে একে কেবল সুন্দরবনেই পাওয়া যায়। 


দ্বিতীয় যে প্রজাতিটি বাংলাদেশে পাওয়া যেত, সেটি ফ্রেশওয়াটার ক্রোকোডাইল বা মিঠা জলের কুমির। এটি মার্শ ক্রোকোডাইল নামেও পরিচিত। এই প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কালেভদ্রে পদ্মায় এর দেখা পাওয়া যায় দশ-পনেরো বছর পরপর। সম্ভবত ভারত থেকে বন্যায় ভেসে আসে। 


বাংলাদেশে তৃতীয় যে প্রজাতির কুমির আছে, সেটির নাম ঘড়িয়াল। ঘড়িয়াল খাবারের জন্য পুরোপুরি মাছের উপর নির্ভরশীল। এদের মুখটা অনেক লম্বাটে। ঘড়িয়ালও বাংলাদেশ থেকে বলতে গেলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কালেভদ্রে কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ—এই জেলাগুলোর জেলেদের জালে ঘড়িয়ালের বাচ্চা ধরা পড়ে। 


আর বাংলাদেশে সরকার শুধু লোনা জলের কুমির চাষের অনুমতি দিয়েছে। যদিও বহির্বিশ্বে অন্যান্য প্রজাতির কুমিরও চাষ হয়। 



আদনান জানালেন, বিশ্বের যে ২৩ প্রকার কুমির রয়েছে, তার মধ্যে লোনা জলের কুমিরের চামড়ার গুণগত মান সবচেয়ে ভালো। এর চামড়া অন্যান্য কুমিরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। আর গোটা বিশ্বে এই প্রজাতির কুমিরের চামড়া চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। এবং এরাই আকারে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে হিংস্র ও সবচেয়ে টেরিটোরিয়াল। 


কুমিরের প্রজনন


আদনান জানালেন, কুমির প্রথম বর্ষায় মিলন করে এবং ডিম দেয়। ডিম দেওয়ার প্রায় ৮৩ দিন পর বাচ্চা ফোটে। ৮৩ দিনের মধ্যে বাচ্চা ফুটলে সেগুলো সাধারণত পুরুষ হয়। ৮৫ দিন বা ৮১ দিনে যে বাচ্চাগুলো ফোটে সেগুলো সাধারণত স্ত্রী বাচ্চা হয়।


কুমির একবারে গড়ে ৬০টি ডিম দেয়। প্রাকৃতিকভাবে শেষ পর্যন্ত ৮-১০ শতাংশ ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাকি ডিমগুলো নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়। যেমন বিভিন্ন পাখি, গুইসাপ, শেয়াল, সাপ, কুকুর প্রভৃতি প্রাণী কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলে; আবার বাচ্চা ফোটার পর অন্যান্য কুমিরও সেটিকে খেয়ে ফেলে।


আদনান অবশ্য কৃত্রিমভাবে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ডিম ফোটাতে পেরেছেন বলে জানালেন।


তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কুমির ডিম দেওয়ার পর সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে ডিমটাকে উঠিয়ে ফেলতে হয়। ডিমে সরাসরি সূর্যের আলো লাগানো যায় না। সেই ডিম সুন্দরমতো পরিষ্কার করে ইনকিউবেটরে নিতে হয়। 


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—কুমির নিজ বাসায় যে অ্যাঙ্গেলে ডিম পাড়ে, ডিমগুলোকে ঠিক সেই অ্যাঙ্গেলেই ওঠাতে হয় এবং সেভাবেই ইনকিউবেটরে বসাতে হয়। ডিম ওঠানোর সময় ডিমের অ্যাঙ্গেল বদলে গেকে সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।


আরেকটা মজার তথ্য জানালেন আদনান—কুমিরের কোনো সেক্স ক্রোমোজোম নেই। ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে কুমিরের বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। ডিম যদি ৩১.৫ থেকে ৩১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ফোটানো হয়, তাহলে সমস্ত বাচ্চা পুরুষ হবে। এ কারণে পুরুষ কুমির উৎপাদন ভীষণ কঠিন। তাপমাত্রা এর চেয়ে কম-বেশি থাকলে মেয়ে বাচ্চা হবে।



আদনান আজাদের ক্যামেরায় বর্ষার সুন্দরবনে হরিণ।

আদনান বললেন, 'প্রাকৃতিকভাবেও কুমিরের সব বাচ্চা ডিম ফুটে নিজে নিজে বেরোতে পারে না। ৩০-৪০ শতাংশ বাচ্চা নিজে থেকে বেরোয়, বাকি ডিমগুলোকে মা কুমির কামড়ে ভেঙে বাচ্চা বের করে। ইনকিউবেটরেও যে বাচ্চাগুলো নিজে থেকে ডিম ফুটে বেরোতে পারে না, সেগুলোকে আমরা নিজেই ডিমের খোসা ভেঙে বের করি। ওই সময়টা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। কেননা বাচ্চা ডিম থেকে বের হয়েই হাতে কামড় দিয়ে দেয়। সদ্য ডিম ফোটা কুমির ছানার চোয়ালেও অনেক শক্তি থাকে। ওটার কামড়েও হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে পারে। ডিম থেকে প্রায় ৮-১০ ইঞ্চি লম্বা বাচ্চা বের হয়। খালি হাতেই ডিম ভাঙতে হয়, কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।'


কুমিরের খাবারদাবার


কুমির সম্পূর্ণ মাংসাশী প্রাণী। একটি প্রাপ্তবয়স্ক কুমির প্রতি মাসে তার শরীরের ওজনের বিশ শতাংশ খাবার খায় বলে জানালেন আদনান। 


ব্রিডিং কুমির সপ্তাহে একদিন খাবার খায়। কুমিরপ্রতি তিনটা করে মুরগি বা চার-পাঁচটা করে পাঙাশ মাছ দেওয়া হয়।


বছরের বারো মাসের মধ্যে নয় মাস কুমিরকে সপ্তাহে এক দিন খাবার দিতে হয়। আর বাকি তিন মাস প্রাণীটিকে কোনো খাবারই দিতে হয় না। তবে ছোট বাচ্চাদের প্রতিদিন খাবার দিতে হয়। 


বাচ্চাদের খাবার হিসেবে দেওয়া হয় মাংসের কিমা। আর বড় কুমিরকে দেওয়া হয় মুরগির মাংসের পাশাপাশি গরুর মাংস ও মাছ।


কুমিরের আর্থিক মূল্য


একটি ভালো মানের কুমিরের চামড়ার প্রতি বর্গসেন্টিমিটারের দাম সাধারণত ২ ডলার পড়ে বলে জানালেন আদনান। বাণিজ্যিক খামারে সাধারণত পুরুষ বাচ্চার চাহিদা একটু বেশি। কেননা মেয়ে কুমিরের চেয়ে পুরুষ কুমির দৈর্ঘ্যে প্রায় দু-ফুট লম্বা হয়। এ কারণে পুরুষ কুমির থেকে চামড়াও বেশি পাওয়া যায়।


পায়ের নখ থেকে শুরু করে চামড়া পর্যন্ত কুমিরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণীটির নখ দিয়ে কানের দুল, লকেটের মতো মূল্যবান অলঙ্কার তৈরি হয়। বাইরের দেশগুলোতে কুমিরের মাংস বেশ জনপ্রিয় খাবার। আর চামড়া দিয়ে তৈরি হয় নানা পণ্য।


আদনান বললেন, বিদেশে প্রতি কেজি কুমিরের মাংস বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। কুমিরের হাড় দিয়ে তৈরি হয় পারফিউম। বিশ্বের সবচেয়ে দামি বিউটি অয়েল তৈরি হয় কুমিরের হাড়ের গুঁড়ো থেকে।


সরীসৃপটির দাঁতও ফেলনা নয়—লকেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কুমিরের হাতের প্যাড ও মাথার খুলি ব্যবহার হয় স্যুভেনির হিসেবে। প্রাণীটির লেজ থেকে তৈরি হয় মানিব্যাগ, বেল্ট। অপেক্ষাকৃত কম বয়সি—এক বছরের কম বয়সি—কুমিরের লেজ থেকে তৈরি হয় ঘড়ির বেল্ট।


কুমিরের চামড়া থেকে তৈরি সবচেয়ে দামি পণ্য হচ্ছে লেডিস পার্স। প্রাডা কোম্পানির একেকটি লেডিস পার্সের দাম ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা।


তবে বাংলাদেশ সরকার কেবল কুমিরের চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু চামড়া ছাড়া শরীরের অবশিষ্ট অংশ এমনিতেও মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। আর কোনো কাজে লাগে না। তাই চামড়ার পাশাপাশি কুমিরের মাংস, হাড়সহ অন্যান্য অঙ্গও রপ্তানির অনুমতি দেওয়া উচিত বলে মত দিলেন আদনান। এই অনুমোদন দিলে বাংলাদেশের সামনে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ খুলে যাবে।


কুমিরের চামড়ার সর্ববৃহৎ ক্রেতা ইউরোপিয়ানরা। এছাড়া চীন, হংকং, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসের ব্যাপক চাহিদা আছে। বিশ্বে কুমিরের চামড়ার মোট বার্ষিক চামড়ার চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ পূরণ করতে পারছে বাণিজ্যিক খামারগুলো। বাকি ৬০ ভাগ চাহিদা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। 


কুমিরের আক্রমণে ছিঁড়েছেন লিগামেন্ট


কুমিরের প্রজনন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ডিম সংগ্রহের জন্য কুমিরের খুব কাছাকাছি যেতে হয়। এ পর্যন্ত আদনান ছয়-সাতবার কুমিরের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবারই ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছেন।


তবে একবার কুমিরের চোয়ালের বাড়ি খেয়ে আদনানের দু-পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এখনও ছিঁড়ে যাওয়া লিগামেন্ট পুরোপুরি ঠিক হয়নি। সেজন্য চলাফেরা করতে তার বেশ কষ্ট হয়।


সচরাচর স্ত্রী কুমিরকে বেঁধেই ডিম তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাতৃত্বকালীন অবস্থায় এরা প্রচণ্ড হিংস্র থাকে। এজন্য বেঁধে রাখা সত্ত্বেও চোয়ালের বাড়ি খান তিনি।


কুমিরপ্রেমের মাত্রা


কুমির কোলে নিয়ে, কুমিরের পাশে শুয়ে ছবি তুললেন কীভাবে? এর রহস্য কী? প্রশ্ন করলাম আদনানকে।


তিনি বললেন, 'পুরোটাই সাহসের ব্যাপার না, কিছু কৌশলও আছে। যেমন শীতকালে কুমির শীতনিদ্রায় থাকে বলে তখন নড়াচড়া খুব কম করে। তার মানে এই না যে, শীতের সময় কুমিরের পাশে গেলে সে আপনাকে কিছু বলবে না।


'জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমি স্টান্টগুলো করি। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে ওয়াইল্ডলাইফটাকে জনপ্রিয় করা।'


কুমিরের পাশে শুয়ে ভাইরাল হওয়া ছবিটি তোলার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, 'করোনাকালে মানুষকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমি ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ১৬ ফুট লম্বা একটা পুরুষ কুমিরের পাশে শুয়ে ছবি তুলেছি।'


তবে এ ধরনের ছবি তোলার সময় কিছু কৌশল অবলম্বন করেন আদনান। তবে তার মতে, কৌশলের চেয়ে বেশি জরুরি 'ট্যাকটিক' বোঝা। 'একটা কুমিরকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সে কখন কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না, এই বিষয়গুলো অনেক সময় নিয়ে আয়ত্তে আনতে হয়,' বলেন তিনি।


সম্ভব হলে পোষা কুকুর-বেড়ালের মতো পোষা কুমির নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন আদনান, কুমির তার এতটাই প্রিয়। কিন্তু লোনা জলের কুমিরকে পোষ মানানো অসম্ভব বলে সেই ইচ্ছেটা জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে তাকে।


সম্প্রতি কুমির খামারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন আদনান। চাকরি ছাড়লেও বন্য জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং সামনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও গবেষণা নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা আছে তার। তিনি বলেন, 'কুমির খামারে চাকরি করে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে ছিলাম। অন্য বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার সুযোগ হচ্ছিল না। তাছাড়া এগুলো বন্দি কুমির। আমি দেশের বুনো কুমির সংরক্ষণে কাজ করতে চাই। চার দেয়ালে নিজেকে আটকে রাখতে চাই না। সম্প্রতি সুন্দরবনের কুমিরের প্রজনন বিষয়ে কাজ করছি। তাছাড়া সাপ ও কুমির নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাপত্রও প্রকাশের অপেক্ষায়।'


আড্ডা শেষ করে যখন উঠলাম, তখন বন্য জীবনপ্রেমী এই তরুণ সম্পর্কে খসরু চৌধুরীর মন্তব্যটা যথার্থই মনে হলো: 'যখন একজন তরুণ তার গ্লামারাস ক্যারিয়ার ছেড়ে নির্জন বনবাস বেছে নিয়ে বন্যপ্রাণের চর্চা করে, সেটা অনেক সুস্থ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তরুণদের মধ্যে অনেকেই এমনটা হতে চান। তেমন স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু নেশা আর পেশাকে এমনভাবে মিলিয়ে নিয়েছেন আদনান, যেটা অনেকের আরাধ্য। তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন তরুণদের আইকন। আদনান কাজ করে চলেছেন সরীসৃপ নিয়ে। এ কাজে পদে পদে বিপদের হাতছানি থাকে। মৃত্যুভয় থাকে। একাধারে তিনি হাতে ধরে ক্ষেত্র সমীক্ষায় ব্যস্ত, অন্যদিকে বন্যপ্রাণের নিয়ত আলোকচিত্রী, বণ্যপ্রাণ রক্ষায় অক্লান্ত সৌনিক। এটা দেশ ও জাতির জন্য গর্বের বিষয়। আশা, আদনানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও অনেক তরুণ এগিয়ে আসবেন। তবেই আমাদের মতো গবেষণাবিমুখ জাতি বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।'

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.