জীবনে অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়


ODD বাংলা ডেস্ক: কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ নামে বইয়ে অনুপ্রাণিত হয়েই পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ‘বিধান’ নামকরণ করেছিলেন। মুখ দেখেই রোগ নির্ণয় করার এমন ‘অলৌকিক বিদ্যা’ রপ্ত করেছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যে হতদরিদ্র থেকে রাজা-উজিরের কাছে তিনি ছিলেন ধন্বন্তরি চিকিত্সক। কেউ কেউ বলতেন তাঁর দিব্যদৃষ্টি রয়েছে। তা হয়তো ছিল। মহাত্মা গান্ধী বলতেন,  “বিধান, দ্য সেফ্টি হ্যান্ড অব ইন্ডিয়া।” দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যাওয়ার পর, কলকাতায় তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর মুখোমুখি বিধান রায় দাঁড়ালে, মিসেস দাশ কাতর আর্তিতে বলেছিলেন, “বিধান তুমি থাকতে উনি বিনা চিকিত্সায় এভাবে চলে গেলেন।” নিশ্চুপ ছিলেন বিধান। ডঃ শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরও তাঁর মা এমনই কথা বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন।

নিজেকে শুধু চিকিত্সার গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখেননি বিধানচন্দ্র রায়। শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতি, দর্শন সব ক্ষেত্রে সমান দক্ষতা রেখে গেছেন। তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ডে ৩ জন মানুষের বিশেষ প্রভাব ছিল। বলা যায়, তাঁদের গুরু হিসাবেই দেখতেন বিধান। চিকিত্সা শাস্ত্রে কর্নেল লুকিস। যিনি বিধানকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ইংরেজদের সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে। বিধান বলেছিলেন, “তিনি আমার মধ্যে পৌরুষ জাগিয়ে তুলেছিলেন। আত্মসম্মান বোধ তৈরি করেন।”  রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। যাঁর হাত ধরে জাতীয় রাজনীতিতে আসা। গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাত্। আর শেষে শিক্ষা প্রসারে বাংলার বাঘ তথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এই মানুষটির কাছে তাঁর বিবেক-চেতনা আত্মসমর্পণ করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হওয়ার সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তত্কালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি সে পথে না হেঁটে সেনেট নির্বাচনে দাঁড়ান এবং মন্মথনাথ রায়চৌধুরী, চারুচন্দ্র বিশ্বাসের মতো ব্যক্তিদের হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।


এরপর থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে বিধানের। একদিন গভর্নর লর্ড লিটন তৃতীয় বারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু শর্ত। বিধানকে তিনি এতটাই ভরসা করতেন যে সেই চিঠি দেখিয়ে তাঁর মতামত জানতে চান আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।  বিধান বলেন, যে শর্তগুলি রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত অপমানজনক। এরপর লাটসাহেবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা চিঠিতে আশুতোষের সেই বিখ্যাত জবাব, ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকন্ড অ্যান্ড ফ্রিডম অলয়েজ। আশুতোষের সংস্পর্শে এসেই বিধান আরও নির্ভীক ও অনাপোষী হয়েছিলেন।

জানা যায়, আশুতোষই বিধান রায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন ১৯২২ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার। নির্দল প্রার্থী হিসাবে বিধানকে উত্তর কলকাতা মিউনিসিপ্যাল (বারাকপুর) কেন্দ্র বেছে দেন তিনি। বিধান রায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার এই কেন্দ্রের নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাজনীতিতে নবাগত বিধানকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কংগ্রেস স্বরাজ্য দলের হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেন চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর সেই প্রস্তাব বিধান রায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন একটাই কারণে। পাছে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। তবে, বিধানের এই সিদ্ধান্তে রুষ্ট হলেও বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। মজার বিষয়, এই কেন্দ্রের ফলাফল কী হয়, তা জানতে কৌতুহল ছিল গোটা দেশের। কারণ, লড়াইটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জাতীয় স্তরের। একদিকে স্বয়ং রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যদিকে দেশবন্ধু- বাংলার বাঘ সমর্থিত বিধান। শেষমেশ বিপুল ভোটে জয়ী হন বিধানচন্দ্র রায়। প্রায় ৩ হাজারের বেশি ভোটে হারতে হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে। বলা যায়, সেদিন থেকেই মূল রাজনীতির সরণি থেকে সরতে শুরু করেন রাষ্ট্রগুরু। আর সেই রাজনীতির রাজপথে অভিষেক ঘটে নবাগত বিধানের।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.