তেলাপোকা হয়ে উঠেছে সোনার মতো মূল্যবান!
ODD বাংলা ডেস্ক: তেলাপোকা। নামটি শুনলেই অনেকের গা ঘিনঘিন করে ওঠে। অনেকে একে বেজায় ভয়ও পায়। এই পতঙ্গটির বাস যাবতীয় ময়লা আবর্জনা ও অন্ধকারে। রোগ ছড়িয়ে বেড়ায়। অনায়াসেই যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে পতঙ্গটির। তাই অতিকায় ম্যামথ পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলেও তেলাপোকা টিকে আছে ৫ কোটিরও বেশি বছর ধরে।
ঘরদোর তেলাপোকামুক্ত রাখার জন্য আমাদের কতই না চেষ্টা। অথচ অনেকের কাছে এই তেলাপোকাই হয়ে উঠেছে সোনার মতো দামি—এবং 'মুখরোচক' খাবার!
খাবার হিসেবে তেলাপোকার চাহিদাও রয়েছে বিপুল। আর সেই চাহিদার জোগান দেবার জন্য রীতিমতো খামার করে তেলাপোকা চাষ করা হচ্ছে একাধিক দেশে।
তেলাপোকার বাজার
খাবার হিসেবে তেলাপোকা বেশ ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বাস্তুসংস্থান-সংক্রান্ত সংকটের সমাধান হতে পারে পতঙ্গ (যার মধ্যে আছে তেলাপোকাও) চাষ।
এতে আফ্রিকা আর্থিকভাবেও লাভবান হতে পারবে। এছাড়া পতঙ্গের বেশ কিছু দারুণ পুষ্টিগুণও আছে। ফলে আফ্রিকার অপুষ্টিতে ভোগা ২০ শতাংশ মানুষ এ থেকে দারুণ উপকৃত হতে পারবে।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, আফ্রিকার শূকর, ছাগল, মাছ ও পোল্ট্রির মোট যত ক্রুড প্রোটিনের চাহিদা রয়েছে তার ১৪ শতাংশ পতঙ্গ চাষের মাধমে মেটানো সম্ভব।
আর আফ্রিকার পতঙ্গ খাওয়ার ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ। যদিও সেখানে পতঙ্গ চাষ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বর্তমানে বিশ্বে ২,১০০ প্রজাতির পঙ্গতকে ভক্ষণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই দুই সহস্রাধিক প্রজাতির পতঙ্গের ২৫ শতাংশই খায় আফ্রিকার মানুষ।
শুধু আফ্রিকা নয়, চীনেও হচ্ছে তেলাপোকা চাষ। আফ্রিকার আগে থেকেই চীনে তেলাপোকার ব্যবসা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে।
চীনাদের কাছেও তেলাপোকা সুস্বাদু খাবার হিসেবে বেশ সমাদৃত। তাছাড়া এশিয়ায় ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরিতেও তেলাপোকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মুরগি ও মাছ চাষিদের কাছেও তেলাপোকার চাহিদা রয়েছে ব্যাপক।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ মানুষের ও প্রাণীর খাবার হিসেবে পতঙ্গের বৈশ্বিক বাজারের আকার দাঁড়াবে ৮০০ কোটি ডলার। উগান্ডার মাছ চাষিদের মধ্যে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি চাষি মাছের খাবার হিসেবে পতঙ্গ ব্যবহার করতে ইচ্ছুক।
আফ্রিকার 'নতুন তেল' তেলাপোকা
কয়েক হাজার ভক্ষণযোগ্য পতঙ্গ প্রজাতির মধ্যে প্রায় ১৮টি প্রজাতিকে চাষোপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রজাতিগুলোকে ব্যাপকভাবে উৎপাদন করে প্রাণী বা সরাসরি মানুষ খেতে পারে।
এই ভক্ষণযোগ্য প্রজাতিরই দলভুক্ত তেলাপোকা। আফ্রিকাজুড়ে এ ধরনের পতঙ্গ চাষ ধীরে ধীরে বাড়ছে। অনেক সংবাদমাধ্যমই তেলাপোকাকে আফ্রিকার 'নতুন তেল' হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। অনেকের কাছে তেলের মতোই দামি হয়ে দেখা দিয়েছে পতঙ্গটি।
আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ায় তেলাপোকা চাষের পথিকৃত ড্যানিয়েল রোয়েহুরা। এই তরুণের চোখে ছয়পেয়ে পতঙ্গটি সোনার মতোই দামি। প্রতি কেজি তেলাপোকা তিনি ৫ ইউরোতে বিক্রি করেন।
ড্যানিয়েল রোয়েহুরা জানান, খুব অল্প খরচেই তেলাপোকা চাষ করা যায়। আর পতঙ্গটি যেকোনো জায়গাতেই চাষ করা যায়। তিনি মূলত পোল্ট্রি খামারি ও মাছ চাষিদের কাছেই সিংহভাগ তেলাপোকা বিক্রি করেন। তবে মাঝেমধ্যে নিজে খাওয়ার জন্যও কেউ কেউ পতঙ্গটি কেনে।
তাঞ্জানিয়ায় সম্প্রতি তেলাপোকা চাষ করে আলোচনায় এসেছেন লুসিয়াস কাওগো নামের আরেক তরুণ।
লুসিয়াস পেশায় কাঠমিস্ত্রি। তার পাশাপাশি তেলাপোকা চাষ করেন।
তবে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে লুসিয়াস যত টাকা আয় করেন, তেলাপোকা চাষ করে আয় করেন তার চেয়ে বেশি।
প্রথমে তিনি তেলাপোকা চাষ শুরু করেছিলেন নিজের পোষা প্রাণীদের খাওয়ানোর জন্য। পরে দেখলেন চীনা খাবার হিসেবে তেলাপোকার ভালো চাহিদা রয়েছে। এ কারণে তিনি চাষের পরিধি বাড়ান।
যেসব প্রজাতির তেলাপোকা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেগুলোই চাষ করেন লুসিয়াস। এসব তেলাপোকায় আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। ফলে প্রোটিনের চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব এই পতঙ্গ খেয়ে। এছাড়া তেলাপোকা থেকে প্রাপ্ত তেলও খুব স্বাস্থ্যকর।
প্রথম যখন তেলাপোকা চাষ করেন, লুসিয়াসের সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে পাগল ঠাওরেছিল। তাই বিশ্ববাজারে লুসিয়াসের চাষ করা তেলাপোকা জনপ্রিয়তা পেলেও নিজ সম্প্রদায় তাকে এখনও অতটা সহজভাবে নিতে পারছে না। লুসিয়াস অবশ্য লোকের ভ্রু কোঁচকানোর তোয়াক্কা না করে তেলাপোকা চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ড্যানিয়েল ও লুসিয়াস দুজনেই জানিয়েছেন, ময়লা ছাড়া তেলাপোকাকে আর কোনো খাবার দিতে হয় না।
তবে আফ্রিকায় তেলাপোকার চাষ এখনও প্রাথমিক অবস্থায়ই আছে।
চীনে তেলাপোকা চাষের রমরমা
আফ্রিকায় প্রারম্ভিক অবস্থায় থাকলেও চীনে তেলাপোকা চাষের রীতিমতো রমরমা চলছে। দেশটিতে প্রায় ১০০ তেলাপোকা খামার আছে। এসব খামারে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি তেলাপোকা উৎপাদিত হয়।
২০১৮ সালে চীনা ওষুধ কোম্পানি গুডডক্টর দাবি করে, ওই বছর তেলাপোকা থেকে তৈরি 'ওষুধ' বিক্রি করে তারা ৬৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।
তবে চীনে তেলাপোকা শুধু ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রোটিনসমৃদ্ধ এই পতঙ্গ কিছু চীনা রেস্তোরাঁয় স্পেশাল রেসিপি হিসেবেও পরিবেশন করা হয়।
চীনে তেলাপোকা চাষ রীতিমতো লোভনীয় ব্যবসা। ছোটখাটো একটা তেলাপোকা খামার স্থাপনের খরচ খুবই কম, এতে সরঞ্জামাদিও লাগে অল্প। এছাড়া তেলাপোকা বাচ্চাও দেয় অত্যন্ত দ্রুত। এরা অসুস্থও হয় না এত সহজে, আর বিশেষ কোনো খাবারের চাহিদাও নেই।
চীনের অন্যতম তেলাপোকা চাষি ওয়াং ফুমিং ২০১৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রথাগত চাষে লাভের মার্জিন খুবই কম। কিন্তু তেলাপোকায় ২০ ইউয়ান বিনিয়োগ করে ১৫০ ইউয়ান ফেরত পাওয়া সম্ভব।
গুডডক্টরের মালিকানাধীন বিশ্বের বৃহত্তম তেলাপোকা উৎপাদন কারখানাটি চীনের জিচ্যাংয়ে অবস্থিত। ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গুডডক্টরের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আওতায় নিয়ন্ত্রিত খামারে বছরে ৬ হাজার কোটি তেলাপোকা উৎপাদিত হয়।
চীনের বহু মানুষের বিশ্বাস, তেলাপোকা থেকে তৈরি এসব পণ্য জখম, টাক, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, এমনকি টিউমারের বিরুদ্ধেও ভালো কাজে দেয়। যদিও এ বিশ্বাসের সপক্ষে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কমই আছে। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, নিজেদের দেহে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক থাকে বলেই তেলাপোকা নোংরা পরিবেশেও সুস্থাবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে।
চীনে তেলাপোকা থেকে তৈরি ওষুধের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে গুডডক্টরের প্রতিনিধি ওয়েন জিয়াঙ্গু দাবি করেন, 'ওরাল ও পেপটিক আলসার, ত্বকের ক্ষত, এমনকি পেটের ক্যান্সার সারানোর জন্যও তেলাপোকার নির্যাস উপকারী।'
তেলাপোকা ব্যবসা শুধু বড় প্রতিষ্ঠানই নয়, ছোট চাষি, মানবতাবাদী এবং উদ্যোক্তাদেরও নজর কেড়েছে।
যেমন চীনের সিচুয়ান প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মোবাইল ফোন বিক্রেতা লি বিংচাই তেলাপোকা চাষি বনে গেছেন। তিনি এখন শূকর ও মৎস্য খামার এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে তেলাপোকা বিক্রি করে ভালো লাভ করছেন। এছাড়া তিনি মানুষের খাওয়ার জন্যও তেলাপোকা চাষ করেন। বিংচাইয়ের খামারের অনতিদূরেই একটি রেস্তোরাঁ তার কাছ থেকে তেলাপোকা কেনে। রেস্তোরাঁটিতে তেলাপোকা ফ্রাই বেশ জনপ্রিয় খাবার।
হেনান প্রদেশের ঝাংকিউ জেলায় আছে আরেকটি বড় তেলাপোকা খামার। প্রথমে এই খামার তৈরি করা হয়েছিল রান্নাঘরের বর্জ্য, অর্থাৎ খাদ্য-বর্জ্য সমস্যার সমাধানের জন্য। কিন্তু পরে খামারটির মালিক, সবুজ উদ্যোক্তা লি ইয়ানরং একে তেলাপোকার খামারে পরিণত করেন। ইয়ানরং আগে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরে তিনি খাদ্য-বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করার উদ্দেশ্যে তেলাপোকা চাষের জন্য করপোরেট চাকরি ছেড়ে দেন।
ইয়ানরং জানান, তার ফার্মের তেলাপোকা দৈনিক ৫০ হাজার কেজি খাদ্য-বর্জ্য খায়। অর্থাৎ গোটা জেলার প্রতিদিনের এক-চতুর্থাংশ খাদ্য-বর্জ্য খায় তার তেলাপোকারা।
চীন বছরে অন্তত ৬০ মিলিয়ন টন খাদ্য-বর্জ্য উৎপাদন করে। এই বর্জ্যের সিংহভাগই প্রক্রিয়াজাত করা হয় গাঁজনের মাধ্যমে, যা বেশ ব্যয়বহুল। তাছাড়া এতে পরিবেশদূষণও হয়।
লি জানান, খাদ্য-বর্জ্য নিকাশের বিকল্প, দূষণবিহীন এবং অর্থকরী পথ দেখিয়েছে তেলাপকারা।
আছে ঝুঁকি আর বাধাও
অনেকে অবশ্য কিছু ঝুঁকির দোহাই দিয়ে তেলাপোকা চাষের বিরোধিতাও করছেন। কল্পনা করুন, ঢাকা বা চীনের ব্যস্ত কোনো নগরীর সড়ক ছেয়ে গেছে অযুত-নিযুত তেলাপোকায়। কেমন অনুভূতি হবে তখন? নিশ্চয় তেলাপোকা খামারের মালিকের চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে জান হাতে নিয়ে পালাবেন?
২০১৩ সালে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল চীনের দাফেং জেলায়। ওই বছর শহরটির এক খামার থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বেরিয়ে পড়ে কয়েক লাখ তেলাপোকা।
পলাতক তেলাপোকাগুলো গিয়ে আশ্রয় নেয় আশপাশের শস্যখেত, ঘরবাড়ি ও ভবনে। লাখ লাখ তেলাপোকা দেখে ওই এলাকার বাসিন্দারা পালায়। রোগবালাই যাতে না ছড়ায়, সেজন্য গোটা এলাকায় ব্যাপক হারে জীবাণুনাশক ছিটাতে হয় জিয়াংসু বোর্ড অভ হেলথকে।
এরকম দুর্ঘটনা ঠেকানোর জন্য গুডডক্টর তাদের খামারের চারপাশে পরিখা খনন করে তাতে তেলাপোকাখেকো মাছ ছেড়ে দিয়েছে।
অবশ্য অনেকেই তেলাপোকা খাওয়াকে ভালো চোখে দেখে না বলে চীনে অনেক তেলাপোকা খামারই গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করে।
তবে কিছু ঝুঁকি ও মানুষের ভ্রু কোঁচকানো সত্ত্বেও তেলাপোকা চাষকে চীনের অনেক কোম্পানি ও উদ্যোক্তাই লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দেখে। এরইমাঝে তেলাপোকাজাত অন্যান্য পণ্যও—যেমন তেলাপোকার দুধ—দিন দিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
গবেষকরাও গবেষণা করে যাচ্ছেন, তেলাপোকাকে আরও লাভজনক উপায় কাজে লাগানোর উপায় বের করার জন্য। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আফ্রিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের বেকারদের মুখে হাসি ফোটাবে তেলাপোকা।
Post a Comment