মিশরে মাছ এবং শূকর খাওয়া নিষিদ্ধ যে কারণে



 ODD বাংলা ডেস্ক: খাদ্য হিসেবে মাছ পৃথিবীর প্রায় দেশের মানুষের কাছে পরিচিত ও প্রিয় খাবার। কিন্তু ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, মাছ ছিল প্রাচীন মিশরীয় ফারাও এবং পুরোহিতদের জন্য নিষিদ্ধ একটি খাদ্য। কারণ, এটি দেবতা সেথের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আবার উনিশতম রাজবংশের ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের সময়ে লিখিত হ্যারিস প্যাপিরাসে মন্দিরে উৎসর্গীকৃত একটা খাদ্য তালিকা পাওয়া গেছে, যেখানে শূকরের মাংসের উল্লেখ নেই।  শুকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মাছ আর শূকর না খাওয়ার যে সব কারণ আছে জেনে নেয়া যাক।

কায়রো পঞ্জিকা অনুসারে, প্রাচীন মিশরে খাবার হিসেবে মাছকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওসাইরিসের পুরাণে বর্ণিত আছে,দেবতা সেথ ওসাইরিসের জননাঙ্গ কেটে তা নীল নদে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ওই অঙ্গ লেপিডোটাস, অক্সিরিনচাস, এবং ফ্র্যাগাস মাছ মিলে খেয়ে ফেলেছিল। তাই প্রাচীন মিশরীয়রা এই তিন ধরনের মাছ আহার থেকে বিরত থাকত। এছাড়াও মনে করা হয় যে, মাছ বেশিরভাগ সময় অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। মাছ খাবার পর মুখ থেকে গন্ধ আসে- এই ধারণা থেকেই পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য মাছ খাওয়ার উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আসে।


মিশরীয় দেব-দেবী এবং কিছু পৌরাণিক কিংবদন্তিতে মাছের কথা স্থান পেয়েছে।মন্দিরে খোদাই করা বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিক্স ইঙ্গিত দেয়, মাছ নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকায় ছিল। তবে, ফাইয়ুম অঞ্চলের মানুষ এই নিষেধাজ্ঞার ধার ধারেনি। তাদের পাত্রে অক্সিরিনচাস মাছ ছিল জনপ্রিয় একটি খাদ্য উপাদান। মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে এর বাসস্থান। মাছ পাওয়া যেত সমুদ্রে, আর মিশরীয় পুরাণ মতে সমুদ্র হচ্ছে বিশৃঙ্খলার জন্মস্থান। স্টেলায় লিপিবদ্ধ করা আছে, ব-দ্বীপের অধিকাংশ রাজপুত্র খৎনা না করা এবং তারা মাছ খেতেন বলে, তাদের প্রাসাদে অনেকেই প্রবেশ করতেন না। এই কর্মকাণ্ড ছিল প্রাসাদের জন্য ভীষণ অপমানজনক। এই স্টেলা বর্তমানে কায়রো জাদুঘরে লিপিবদ্ধ আছে। 


বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন,  প্রাচীন মিশরে খাদ্য হিসেবে মাছের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। মিশর গড়ে উঠেছিল নীল নদের অববাহিকায়। এই নদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সাথে ডেল্টা সাগর এবং নলখাগড়ার সাগর থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করা হতো। বাজারে তখন মাংসের চড়া দাম থাকায়, মাংস ছিল দরিদ্রদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই, তারা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মাছ দিয়ে প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাত।


শৈল্পিক ও সাহিত্য নথি থেকে জানা গেছে, রাজস্ব এবং অর্থ প্রদানের মাধ্যম হিসেবে মাছ ছিল বেশ জনপ্রিয়। দেইর-এল-মদিনাতে প্রাপ্ত এক নথি অনুসারে জানা যায়, রাজ সমাধিকর্মী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের খাদ্য সরবরাহের জন্য জেলেদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মন্দিরের মূল খাদ্য গুদামেও বহু মাছের কাঁটার সন্ধান পেয়েছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণ করে পবিত্র স্থানেও মাছ খাওয়ার প্রচলন ছিল।


গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে সর্বপ্রথম জানা যায়, প্রাচীন মিশরে শূকরকে মনে করা হতো অপবিত্র, নাপাক, এবং দেবতা সেথের সাথে সম্পৃক্ত। ভুলবশত কেউ শূকরকে স্পর্শ করলে, পবিত্রতা অর্জনের জন্য তাকে নীল নদে স্নান করতে হতো। মিশরীয় সমাজে শূকর পালকেরা সমাজ থেকে আলাদাভাবে বসবাস করত। তাদেরকে নিম্ন বংশের বলে গণ্য করা হতো, এবং তারা শুধু অন্য শূকর পালকের মেয়ের সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত।


কিন্তু প্যাপিরাস বলছে অন্য কথা। কোনো কোনো মন্দিরের খাদ্য উৎসর্গের তালিকায় শূকরের মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। শূকরের মাংস বেশি ভক্ষণ করতে দেখা গেছে সাধারণত দরিদ্র পল্লীতেই। শ্রমিকদের গ্রাম দেইর-এল-মদিনার কসাইখানাতে শূকরের হাড় এবং এর পাশেই শূকরের খামারের সন্ধান পাওয়া গেছে।


 মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যে অন্যান্য গবাদিপশু পালনের সাথে শূকর পালনেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রমাণ করেছেন, প্রাচীন সাম্রাজ্যে এটি ছিল আমিষ জাতীয় খাদ্যের অন্যতম উৎস। ধারণা করা হয়, শূকর সম্বন্ধে প্রাচীন মিশরে এমন কাহিনি প্রচলিত ছিল যে, জবাই করার সাথে সাথে এটি না খাওয়া হলে পেটে ব্যথা হবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যই সম্ভবত শূকর খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চলে এসেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.