ভারতবর্ষের প্রথম নিসর্গবিদ: সম্রাট জাহাঙ্গীর



 ODD বাংলা ডেস্ক:  মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯ – ১৬২৭) তাঁর চিত্রকলা, ওয়াইন ও সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতার কারণে বিদিত থাকলেও সম্রাটের আরেকটি বিশাল দুর্বলতা ছিল—তিনি বুনো জীবজন্তু ভালোবাসতেন এবং তাদের নানা মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করতেন। তাদের জীবনযাপন অতি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে একজন যথার্থ নিসর্গীর মতো সেই নিরীক্ষাগুলো লিপিবদ্ধও করতেন। যদিও সেগুলো সবসময়ই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হতো না!


জাহাঙ্গীরের সাথে বুনো জীবদের এই সম্পর্কের শুরু বলা যায় তাঁর জন্মেরও আগে। কিংবদন্তী বলে, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা মা প্রসববেদনায় অত্যধিক কাতর হলে তাঁর বাবা আকবর প্রতিজ্ঞা করেন যে স্ত্রীর যন্ত্রণার উপশম ঘটলে তিনি আর কোনদিনই শুক্রবারে চিতাদের নিয়ে শিকারে বেরোবেন না (মোগলদের কাছে চিতা ছিল কুকুরের মতোই)। তাঁর এই প্রার্থনা মঞ্জুর হয় এবং জাহাঙ্গীর ভূমিষ্ঠ হন। 


বাল্যকাল থেকে জাহাঙ্গীর চারপাশের জগত নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। সেইসাথে অতি বিত্তশালী পরিবারের কারণে অন্য কোনো সমস্যা না থাকায় দিন দিন তাঁর এই কৌতূহল বাড়তেই থাকে। বুনো পশু এবং পাখিদের প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ছিল এবং রাজকীয় চিত্রকরদের তিনি দেশ ও বিদেশের নানা পশুপাখির ছবি আঁকার আদেশ দেন। এর ফলেই অসাধারণ ও বাস্তব কিছু চিত্রকর্মের সৃষ্টি হয়। বলা হয়ে থাকে, ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিচিত্র জীবজন্তুর এমন ছবি আঁকার ইতিহাস জাহাঙ্গীরের আমলেই শুরু হয়।


লেখক পার্বতী শর্মা তাঁর লেখা সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে জাহাঙ্গীরের বাবা আকবর যেমন তাঁর সাম্রাজ্য আর উদার ধর্মবিশ্বাসের জন্য বিখ্যাত, তাঁর পুত্র শাহজাহান যেমন বিখ্যাত তাঁর নির্মিত অসাধারণ সব স্থাপত্যের জন্য, তেমনই জাহাঙ্গীরকে বলা যায় উপমহাদেশের প্রথম যথার্থ নিসর্গী। 


১৬০৫ সালে মসনদে বসার পরপরই জাহাঙ্গীর আঁকিয়েদের জন্য এক বিশ্বমানের স্টুডিওর ব্যবস্থা করেন, যার অন্যতম সেরা ছিলেন ওস্তাদ মনসুর, যিনি প্রাণিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ কয়েকটি চিত্রকর্মের জন্ম দেন।


১৬১২ সালে সম্ভবত গোয়া থেকে জাহাঙ্গীর একটি টার্কি সংগ্রহ করেন এবং মনসুর সেটি ক্যানভাসে এঁকে অমর করে রাখেন, যা নিয়ে নিজের জীবনীতে সম্রাট লিখেছিলেন, '১৬ তারিখে আমার প্রধান খাদেম মুকররব খাঁকে আদেশ দিলাম যে সে গোয়ার বন্দরে গিয়ে সেখান থেকে কিছু দুর্লভ বস্ত নিয়ে আসুক। আমার আদেশানুসারে সে ফিরিঙ্গিদের থেকে নামমাত্র দামে কয়েকটি দুর্লভ বস্তু খরিদ করে নিয়ে এল। এই বস্তুগুলোর মধ্যে কিছু পশুও ছিল যা বড়ই বিচিত্র ও আশ্চর্যজনক। আমি তাদের কখনোই দেখিনি এবং নামও জানতাম না। এদের মধ্যে একটি জীবের শরীর মুরগীর চেয়ে বড় এবং ময়ূরের চেয়ে ছোট। এ যখন গরম হয় তখন ময়ূরের মতো পেখম ছড়িয়ে নাচে।



'এর মাথা, ঘাড় এবং গলার নিচের অংশ প্রতি পলে পলে রং বদলাতে থাকে। গরম হলে এই অংশটি লাল হয়ে ওঠে, যেন লাল মুরগী। কিছুক্ষণ পর এই লালিমা শ্বেতবর্ণ ধারণ করে, তারপর নীলাভ। এটি গিরগিটির মতো বারবার রঙ বদলায়। এর ঠোঁট এবং পা মুরগীর মতো হয়। আর মাথা মুরগীর মতো সরু হয়। তবে যখন সে গরম হয়ে যায় তখন মুরগীর মতো মাথাটি হাতির শুঁড়ের মতো ঝুলে পড়ে এবং সেটা উঠিয়ে নিলে গণ্ডারের শিঙের মতো লাগে। তার চোখের চারিদিকে নীল বেষ্টনী থাকে, যেটার রঙ বদলায় না। তার পাখনা বিভিন্ন রঙের হওয়া সত্ত্বেও ময়ূরের পাখনার থেকে আলাদা।'



আফ্রিকা থেকে আনা জেব্রা

১৬১৯ সালে পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাসের কাছ থেকে তিনি Barbary Falcon উপহার হিসেবে পান, এবং এটিকে এতই কদর করতেন যে পাখিটির মৃত্যুর পর এর অবিকল ছবি আঁকার আদেশে দিয়েছিলেন। 


১৬২০ সালে কাশ্মীর ভ্রমণের সময় জাহাঙ্গীর একটি বাদামি-ডিপার দেখতে পান, যা নিয়ে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, 'ঝরনার ধারে saj-এর মতো দেখতে এক পাখি দেখলাম। সেটি দীর্ঘ সময় জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে এবং এক জায়গায় ডুব দিয়ে আরেক জায়গায় ওঠে। দুই-তিনটা পাখি ধরার নির্দেশ দেই, কারণ আমি জানতে আগ্রহী ছিলাম যে পাখিগুলো মুরগির মতো, নাকি হাঁসের মতো চ্যাপ্টা পায়ের পাতাওয়ালা, নাকি ভূচর পাখিদের মতো ছড়ানো আঙ্গুলের অধিকারী। দুটি পাখি ধরা হয়েছিল, একটা সাথে সাথেই মারা গেল, অন্যটি এক দিন বেঁচে ছিল। এদের পা হাঁসের মতো চ্যাপ্টা ছিল না, ওস্তাদ মনসুরকে এর প্রতিকৃতি আঁকতে বললাম।'


জাহাঙ্গীর নানা ধরনের প্রাণীও সংগ্রহ করতেন। একবার তাঁর অধীনস্থ মীর জাফর নামের এক কর্মকর্তা ইথিওপিয়া থেকে আসা তুর্কী ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে একটি জেব্রা সংগ্রহ করে সম্রাটকে উপহার দেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটি সাদা-কালো ডোরা আঁকা একটি ঘোড়া, এমনকি সেই ঘোড়ার রং তোলার জন্য আচ্ছাসে চামড়া ঘষাও হয়েছিল! পরে দেখা গেল যে প্রাণীটি জন্মাবধিই ডোরাকাটা! জেব্রাটির ছবি এঁকে ছিল মোগল শিল্পীরা, এবং পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর জেব্রাটিকে ইরানের শাহকে উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন, যার সাথে প্রায়ই তিনি দুর্লভ সব উপহার অদলবদল করতেন।


তবে জাহাঙ্গীরের প্রাণীপ্রেমের বিচিত্রতম কাহিনীটি এক জোড়া সারসকে ঘিরে। শিশুকাল থেকে লাইলী ও মজনু নামের এই দুটি সারস সম্রাটের সংগ্রহশালায় স্থান পায়, ৫ বছর পর এদের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী সম্রাটকে জানান যে সারস দুটোর মিলন ঘটেছে। লাইলীর দুটি ডিম পাড়ার কথা শুনে জাহাঙ্গীর বেশ উদ্বেলিত হয়ে উঠেন।



তিনি পাখি দুটোর বাসা গড়ার পদ্ধতি খুব কাছ থেকে অবলোকন করে লিখে রাখতে থাকেন, জানা যায় যে স্ত্রী সারসটি সারা রাত ডিমের উপরে বসে তা দেয় আর পুরুষ সারসটি জেগে পাহারা দেয়। একবার নেউল জাতীয় এক প্রাণী তাদের এলাকায় ঢুকে পড়লে পুরুষ সারসটি ভীমগতিতে সেটার দিকে দৌড়ে তাকে এলাকাছাড়া করে! সূর্যের আলো ফুটলে পুরুষটি স্ত্রীর কাছে যেয়ে তাকে ঠোঁট দিয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে পরে তার জায়গা নিয়ে ডিমে তা দেয়া শুরু করে।


ডিম ফোটার পরপরই সারস ছানাদের ব্যাপারে সম্রাট অত্যন্ত সতর্ক ভূমিকা অবলম্বন করেন, এবং তিনি যত বেশি সময় পারতেন এই ছানাদের বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করতেন, এবং কঠোর আদেশ দিয়েছিলেন যাতে ছানাদের কোনোমতেই কোনো আঘাত না লাগে।


জাহাঙ্গীর দেখেছিলেন যে পুরুষ সারসটি প্রায়ই তার ছানাদের উল্টো করে বহন করে! ছানাদের ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি পুরুষটিকে আলাদা করে রাখার আদেশ দেন, কিন্তু যখন পরে জানা যায় যে সেই আচরণ আসলেই সারস পিতার স্নেহের বহিঃপ্রকাশ, তখন আবার পিতা ও ছানাদের একসাথে রাখা হয়।


এছাড়া দুই ধরনের বুনো ছাগলের মিলনে শঙ্কর প্রজাতি তৈরিতে জাহাঙ্গীরের উৎসাহের কমতি ছিল না। মারখোর এবং বারবারি জাতের ছাগলের মিলনে যে বংশধর উৎপন্ন হয়েছিল, তা সম্রাটের বিশেষ স্নেহের বস্ত ছিল। তাঁর মতে এই বিশেষ ছাগ ছানাগুলি ছিল অত্যন্ত আমুদে প্রাণী, তারা এমন সব মজার কাজ করতে যে একজন তাদের দেখেই দিন কাটাতে পারে। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন তারা যেন সবসময়ই তাঁর আশেপাশেই থাকে। ছানাগুলোর সুন্দর নামও দেয়া হয়েছিল।


জাহাঙ্গীরের পর্যবেক্ষণ বলে যে সাধারণ ছাগশিশু মাতৃদুগ্ধ পানের আগে বেশ কান্না করত কিন্তু এই শঙ্কর জাতের শিশুরা মোটেও কাঁদত না, তারা ছিল অনেক স্বাধীনচেতা। তবে এত সময় ব্যয় করার পরও তাদের খেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না সম্রাট, কারণ তাঁর ধারণা ছিল এরা খেতেও বেশ সুস্বাদুই হবে।


যদিও জাহাঙ্গীর তাঁর সাম্রাজ্যে বৃহস্পতিবার সব ধরনের পশু জবাই নিষিদ্ধ করেছিলেন।



বাজপাখি হাতে জাহাঙ্গীর

শুধু প্রাণীদের বাহ্যিক রূপই নয়, জাহাঙ্গীর তাদের দেহতত্ত্ব নিয়েও খুব কৌতূহলী ছিলেন। সিংহের সাহসের মূল উৎস জানার জন্য তিনি দেহ ব্যবচ্ছেদের আদেশ দেন, এবং সেই নিয়ে লিখেছিলেন, 'অন্য প্রাণীদের পিত্তথলি যকৃতের বাহিরে থাকে, অথচ সিংহের পিত্তথলি যকৃতের ভিতরেই থাকে, হতে পারে এটিই তাদের এত সাহসী হবার কারণ!'


সিংহ নিয়ে জাহাঙ্গীরের অত্যধিক আগ্রহ ছিল। একবার তাঁর নাতি দারা তাকে বিচিত্র একজোড়া জন্তু এনে দিল—এক সিংহ ও এক ছাগল, যারা একই খাঁচায় থাকত, এবং পরস্পরের প্রতি তাদের অসাধারণ আবেগের জন্ম হয়েছিল। এই দেখেই জাহাঙ্গীরের মনে এই বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার চিন্তা আসে। 


তিনি প্রথমেই ছাগলটি সরিয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলতে আদেশ দেন, যার ফলে সিংহটি রাগে গর্জন করতে থাকে। তখন সম্রাটের আদেশে প্রায় একই রকম দেখতে, একই আকৃতির একটি ছাগল সেই খাঁচায় ঢোকানো হয়! কিন্তু সিংহ তাতে বোকা না বনে গর্জন করতেই থাকে। এরপর একটি ভেড়া ঢোকানো হয়, সেটিও সিংহের ক্ষেত্রে কাজ করেনি। 



অবশেষে সেই পরিচিত ছাগলটি খাঁচায় আনতেই সিংহ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছাগলের মুখে চেটে দেয়, যা সম্রাটের দরবারে বিশাল আনন্দের জন্ম দেয়। মু'তামাদ খান এই পুরো ঘটনাটিই লিপিবদ্ধ করে রাখেন।


মাঝে মাঝে জাহাঙ্গীরের এই সমস্ত কৌতূহল তাঁর কর্মচারীদের বেশ অপ্রস্তত অবস্থায় ফেলত। একবার তিনি বললেন যে চিকিৎসকরা বলেছে সিংহের দুধ চোখের জন্য ভালো। সেটি পরখ করার জন্য তিনি অন্যদের সিংহের দুধ দুইয়ে আনতে আদেশ দেন, কিন্তু তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়। 


তখন জাহাঙ্গীর এর কারণ হিসেবে দুইটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান। একটা হচ্ছে এমন অসম সাহসী প্রাণীদের বুকে তখনই দুধ আসে যখন তারা সন্তানের প্রতি আবেগ অনুভব করে। যখন সন্তানেরা দুধ খাবার চেষ্টা করে তখন এটা ঘটে। আর যখন এর বাইরে কিছু ঘটে তখন বুক শুকিয়ে যায় এবং সেখানে চিপেও দুধ পাওয়া যায় না।


জাহাঙ্গীরের খাবার ব্যাপারে বেশ বাছবিচারও ছিল। তিনি সবসময়ই আঁশযুক্ত মাছ খেতেন, কারণ তাঁর মতে আঁশছাড়া মাছ মরদেহ খায়, তাই তাদের তিনি বর্জন করতেন।


একবার এক সাপকে খরগোশ গিলতে দেখে জাহাঙ্গীর সেই পুরো ঘটনাটি চাক্ষুষ করতে চান বলে সেই সাপের মুখ থেকে খরগোশ কেড়ে নিতে বলেন, এবং পরে আবার সাপকে খেতে দিতে বলেন। কিন্তু পরেরবার সাপ আর খরগোশটি মুখে নিতে রাজি হচ্ছিল না, বরং অন্যদের জোরাজুরিতে সাপের মুখের একাংশ ছিঁড়েই যায়! পরে সাপটিকে কেটে তার পাকস্থলীতে আরেকটি খরগোশ পাওয়া যায়, যা সে সম্রাট দেখে ফেলার আগেই গিলে ফেলতে সমর্থ হয়েছিল। 


শেষ বয়সে জাহাঙ্গীর খাদ্য নিয়ে বেশ খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর উপস্থিতিতেই প্রাণীদের পরিষ্কার করা হতো, এবং তাদের পাকস্থলী নিজেই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতেন যে প্রাণীগুলো কী খেয়েছে। যদি কোনো প্রাণীর পাকস্থলী ঘেঁটে দেখা যেত যে সেটা সম্রাটের চোখে কোনো অরুচিকর খাবার খেয়েছে তাহলে সেটাকে মেন্যু থেকেই বাদ দেওয়া হতো। 


যেমন একবার পালাহাঁসকে কেঁচো খেতে দেখে সম্রাট সেটাকে বাদ দিতে বলেছিলেন। আরেকবার জলচর মুরগি-জাতীয় পাখির পাকস্থলীতে বিশাল এক পোকা দেখে তিনি বলেছিলেন, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না যে কেউ এত বড় পোকা খেতে পারে! আর এক বকের পাকস্থলীতে তো গোটা দশেক পোকা দেখলাম, সেই থেকে বকেদের নিয়ে চিন্তা করাও বাদ দিয়েছি।


জাহাঙ্গীর প্রাণিজগত নিয়ে নিজেই এত কৌতূহলী ও আগ্রহী ছিলেন যে অনেক সময়ই তাঁর পশুপাখি-বিষয়ক কর্মচারীদের চেয়েও ভালো জানতেন। একবার তাঁর প্রধান স্কাউট এক ধরনের কোয়েল পেয়েছিল যা পুরুষ নাকি স্ত্রী বোঝা যাচ্ছিল না। জাহাঙ্গীর নিশ্চিত ছিলেন যে এটি স্ত্রী কোয়েল, পরে ব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেল এর পেট ভর্তি ডিম, যা সম্রাটের জ্ঞানের পক্ষেই সাক্ষ্য দিল। জাহাঙ্গীরের যুক্তি ছিল স্ত্রী কোয়েলের মাথা ও চঞ্চু পুরুষ কোয়েলের চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির হয়। একমাত্র অসংখ্যবার পর্যবেক্ষণের ফলেই এমন নিখুঁত ধারণা গড়ে ওঠে।



সারস দম্পতি

পাঞ্জাবের শেখপুর জেলার হরিণ-মিনার ছিল মোগলদের নির্মিত এক অনন্য স্থাপত্য। এটি আসলে জাহাঙ্গীরের প্রিয় অ্যান্টিলোপ হংসরাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। অনেক অনেক শিকার অভিযানে হরিণটি তাঁর সঙ্গী ছিল। হরিণটির সন্মানে জাহাঙ্গীর এই এলাকার অ্যান্টিলোপ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।


জাহাঙ্গীর প্রায়ই জীবনের নানা রূপক হিসেবে প্রাণীদের কথা উল্লেখ করতেন। এলাহাবাদে যুবরাজ হিসেবে থাকার সময় তিনি কোকিল পর্যবেক্ষণ নিয়ে লিখেছিলেন 'কোকিল অনেকটা কাকের মতোই, কিন্তু ক্ষুদ্রতর। কাকের চোখ কালো রঙের কিন্তু কোকিলের চোখ লাল। পুরুষ কোকিল কুচকুচে কালো কিন্তু স্ত্রী কোকিলের সাদা ডোরা আছে। আর স্ত্রীর তুলনায় পুরুষটির কী সুন্দর কণ্ঠ!


'কোকিলের সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এরা নিজেদের ডিমে তা দেয় না! এদের যখন ডিম দেবার সময় হয়, কোনো না কোনো অরক্ষিত কাকের বাসায় যেয়ে তাদের ডিম ভেঙ্গে, বাসার বাইরে ফেলে দিয়ে সেখানে ডিম পেড়ে ভেগে যায়! কাক নিজের ডিম মনে করে তাদের তা দেয় ও ছানা ফোটায়। এলাহাবাদে থাকার সময় এই ঘটনা আমি বহুবার দেখেছি।'


ঐতিহাসিক হেনরি বেভেরিজের মতে, জাহাঙ্গীর একজন মোগল সম্রাটের বদলে নিসর্গ জাদুঘরের প্রধান হলেই হয়তো আরও সুখী মানুষ হিসেবে জীবন কাটাতে পারতেন। 


১৬২৭ সালে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শাহজাহান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সিংহাসনে বসেন। তিনি স্থাপত্যকলায় যতটা আগ্রহী ছিলেন প্রাণী ও তাদের চিত্রকর্ম নিয়ে ততটা ছিলেন, তাই এই ধারা বিলুপ্ত হয়ে যায় মোগল দরবারে। 


সম্রাট জাহাঙ্গীরের পশু-পাখি নিয়ে আগ্রহ এখনো অমর হয়ে আছে তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী' ও পশু-পাখিদের সেই অসাধারণ চিত্রকর্মগুলোর মাঝে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.