দানবদের জননী, ভালবাসা আর আদরের দেবীর সহচরী, ইভের আগে নাকি এঁকে বিয়ে করেন আদম
ODD বাংলা ডেস্ক: দেবী না দানবী তিনি? নাকি তিনি রক্তমাংসেরই মানবী? উত্তর মেলে না। কাহিনি, কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি ইত্যাদিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন তিনি। আজও তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক বিদ্যমান। কারও কাছে তিনি মূর্তিমতী অশুভ। আবার অনেকেই মনে করেন, তিনি নারী স্বাধীনতার প্রথম সৈনিক। তাঁর নাম লিলিথ। তাঁর খোঁজ পেতে গেলে পাড়ি দিতে হবে সুদূর অতীতে। সেই মেসোপটেমীয় বা ইহুদি পুরাণসমূহ রচনার কালে। (সঙ্গের ছবিটি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেত্তির আঁকা ‘লিলিথ’, ১৮৬৬-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ)
ইহুদি কিংবদন্তি অনুসারে, লিলিথ প্রথম মানব আদমের প্রথমা পত্নী। হিব্রু ‘বাইবেল’-এর ‘বুক অব ইসাইয়া’-য় তাঁর উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলে হয়েছে, ইভের আগে লিলিথই ছিলেন আদমের স্ত্রী। কিন্তু আদমের আনুগত্য স্বীকার না করায় ঈশ্বর তাঁকে স্বর্গোদ্যান থেকে বিতাড়িত করেন। (সঙ্গের ছবিটি মাইকেলেঞ্জেলো-অঙ্কিত ক্রুদ্ধ ঈশ্বরের)
‘বাইবেল’-এর ‘জেনেসিস’ অধ্যায়ে লিখিত আছে যে, ঈশ্বর আদমের পাঁজর থেকে ইভকে তৈরি করেছিলেন। আর আদম নির্মিত হয়েছিলেন মাটির দ্বারা। ইহুদি কিংবদন্তি জানায়, লিলিথকেও ঈশ্বর সেই মাটি দিয়েই তৈরি করেন, যা থেকে আদম নির্মিত হয়েছিলেন। অনেক কিংবদন্তি আবার এ কথাও বলে যে, লিলিথকে নির্মাণের সময়ে ঈশ্বর মাটির সঙ্গে কিছু ময়লাও মিশিয়ে দিয়েছিলেন। (সঙ্গের ছবিটি ১৫১৫ সালে পিটার পল রুবেন্স এবং জাঁ ব্রুঘেল দ্য এল্ডার অঙ্কিত ‘দ্য গার্ডেন অব এডেন উইথ দ্য ফল অব ম্যান’)
আদমের সঙ্গে মিলনে লিলিথ দানবের জন্ম দেন। সে হিসাবে দেখলে তিনিই দাকন্যারা ‘সাকুবাস’নবদের জননী। ইহুদি পুরাণ অনুযায়ী লিলিথের পুত্ররা ‘ইনকুবাস’ এবং নামে পরিচিত। ইনকুবাসরা ঘুমন্ত নারীদের সঙ্গে মিলিত হয় এবং সাকুবাসরা ঘুমন্ত পুরুষের সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হয়। এমন মিলনে জাদুকর, ডাইনি প্রমুখের জন্ম হয়।
অন্য দিকে আবার, প্রাচীন সুমেরিয়ার ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যে লিলিথের উল্লেখ রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবতারে। সেখানে লিলিথ প্রেম, যুদ্ধ, সৌন্দর্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা, ন্যায়বিচার এবং যৌনতার দেবী ইনান্না বা ইসথারের সহচরী হিসেবে বর্ণিত। (সঙ্গের ছবিটি আক্কাদে প্রাপ্ত একটি সিল-এ খোদিত দেবী ইনান্নার)
দেবী ইনান্নার উপাসনা পদ্ধতির মধ্যে যৌনতা ছিল এক অপরিহার্য অঙ্গ। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষের বিশ্বাস ছিল, লিলিথ নাকি উপাসকদের ইনান্নার যৌন মহোৎসবের উপচারগুলি শিখিয়ে দিতেন। হিব্রু কিংবদন্তিতে লিলিথকে কোথাও যৌন আবেদনময়ী দুষ্ট প্রকৃতির নারী বা কোথাও সাকুবাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সঙ্গের ছবিটি অগুস্ত রদাঁর ১৮৮৯ সালের ভাস্কর্য ‘দ্য সাকুবাস’)
পরবর্তী কালে লিলিথকে ‘নিশীথ-দানবী’ বা ‘নাইট ডেমন’ হিসেবে বর্ণনা করা হতে থাকে। এমন কথাও তাঁর নামে প্রচলিত হয় যে, তিনি নাকি শিশুদের হত্যা করেন।
লিলিথের যে রূপগুলি প্রত্ন-নিদর্শন থেকে পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, তিনি সুন্দরী, নগ্ন এবং তাঁর হাতে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে একটি দণ্ড বিরাজ করছে। অনেক মূর্তিতে লিলিথের সঙ্গে ‘আনজু’ নামে এক বিশেষ পাখিকে দেখা যায়। মেসোপটেমীয় কিংবদন্তি অনুসারে, ‘আনজু’ বা ‘জু’ আধা সিংহ-আধা পাখি-জাতীয় এক কল্পিত প্রাণী।
সুমেরিয়ার প্রাচীন সাহিত্য ‘গিলগামেশ’ থেকে জানা যায়, ইনান্না বা ইসথার তাঁর নিজস্ব উদ্যানে একটি উইলো বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। সেই গাছের কাঠ দিয়ে এক জাদু-সিংহাসন নির্মাণ করবেন, এমনই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু গাছটি কাটতে গিয়ে ইনান্না দেখেন, তার ভিতরে একটি সাপ, তার শাখায় একটি আনজু বা জু পাখি এবং ‘অন্ধকারের কুমারী’ (সম্ভবত লিলিথ) অবস্থান করছে। ইনান্না তাঁর জাদুশক্তি দিয়ে এদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। বীর গিলগামেশ সাপটিকে হত্যা করেন। এবং লিলিথ উড়ে পালিয়ে যান (সম্ভবত আনজু-র পিঠে চড়ে)। লিলিথের বেশ কিছু মূর্তিতে তাই আনজু-কে দেখা যায়।
ইহুদি পুরাণ ‘তালমুদ’-এ লিলিথকে আদমের প্রথম স্ত্রী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বর তাঁকে আদমের নিঃশর্ত আনুগত্য স্বীকারের নির্দেশ দিলে তিনি সেই আদেশ অমান্য করে নিজেই স্বর্গোদ্যান ছেড়ে চলে যান (লক্ষণীয়, ঈশ্বর তাঁকে বিতাড়িত করেননি)। লিলিথের খোঁজে তিন জন দেবদূতকে পাঠানো হয়। মরুসাগরের তীরে লিলিথ ও তাঁর দানববাহিনীর সঙ্গে দেবদূতদের যুদ্ধ হয়। সেখানে প্রতি দিন লিলিথ শতাধিক দানবের জন্ম দিয়ে বাহিনীর শক্তি বাড়ান এবং দেবদূতদের হঠিয়ে দেন। (সঙ্গের ছবিটি আয়ারল্যান্ডের একটি গির্জায় তিন প্রধান দেবদূতের স্টেনড গ্লাস প্রতিকৃতি)
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, লিলিথ শয়তানের দোসর। শয়তানের সঙ্গে তাঁর মিলনের ফলে জিনদের জন্ম হয়। সৃষ্টিকর্তা প্রতি দিনই বেশ কিছু অশুভ শক্তিসম্পন্ন জিনকে হত্যা করেন। এর প্রতিশোধ নিতে লিলিথও আদমের সন্তানদের, অর্থাৎ সদ্যোজাত মানবশিশুদের (বিশেষ করে পুত্রসন্তানদের) প্রতি রাতে হত্যা করেন।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে আদম ও ইভের ছবি সম্বলিত এক প্রকার তাবিজ সদ্যোজাত শিশুদের গলায় পরিয়ে শক্তিশালী দেবদূতদের নামোচ্চারণ করার রেওয়াজ চালু হয়। বিশ্বাস, এর ফলে ‘দুষ্ট’ লিলিথ ও তাঁর অশুভ অনুচররা কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
১৩) প্রাচীন গ্রিক কিংবদন্তিতে লামিয়া নামে এক শিশুভক্ষণকারিণী নিশীথ-দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়, তাকে লিলিথের নামান্তর বলে অনেকে মনে করেন। লামিয়ার দেহের ঊর্ধ্বাংশ সুন্দরী নারীর মতো কিন্তু নিম্নাঙ্গ সাপের। লামিয়া দেবরাজ জিউসের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত হলে দেবরানি হেরা তাতে ক্ষুব্ধ ও ঈর্ষান্বিত হন এবং লামিয়ার সন্তানদের হত্যা করেন। সুন্দরী লামিয়া ক্রোধে এক দানবীতে পরিণত হন এবং মানবশিশুদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকেন। লামিয়াও নাকি ঘুমন্ত পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হন।
লিলিথের কাহিনি থেকে পরবর্তী কালে এক অন্য ‘সত্য’-কে তুলে আনেন মানবীচেতনাবাদী গবেষকরা। তাঁদের মতে লিলিথ পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের একতরফা অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। তিনি একই সঙ্গে ঈশ্বর ও আদমের আনুগত্য অস্বীকার করে নারীর স্বাতন্ত্র্যকে ব্যক্ত করেছিলেন। (সঙ্গের ছবিটি ‘কুইন অব দ্য নাইট’ নামে পরিচিত এক প্রাচীন মেসোপটেমীয় টেরাকোটা ভাস্কর্যের। ১৮০০-১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ মূর্তিটি লিলিথের বলেই ধরে নেওয়া হয়)
উনিশ শতক থেকে লিলিথ বার বার উঠে আসতে থাকেন ইউরোপের সাহিত্য ও চিত্রকলায়। পরবর্তী কালে লিলিথের অনুষঙ্গ নিয়মিত দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ইউরোপের ফ্যান্টাসি সাহিত্যে। সিএস লিউইসের মতো লেখক তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া’-য় মুখ্য খলনায়িকাকে লিলিথের বংশধর বলে বর্ণনা করেছিলেন। আমেরিকান ভয়াল সাহিত্যের দিশারিপুরুষ এইচপি লাভক্র্যাফটের ‘দ্য হরর অ্যাট রেড হুক’ গল্পেও দেখা মেলে লিলিথের। (সঙ্গের ছবিগুলি যথাক্রমে লিউইস এবং লাভক্র্যাফটের)
লিলিথকে নিয়ে আজও রচিত হয় কবিতা। লিখিত হয় ডেথ মেটাল বা অ্যাসিড রক ঘরানার গান। লিলিথ অনেকটাই বৈগ্রহিক হয়ে বিরাজ করছেন পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে। কিন্তু, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের গবেষকরা লিলিথের মধ্যে খুঁজে পান এক সন্তানহারা মা-কে, এক তীব্র স্বাধীনচেতা বিদ্রোহিনীকে বা মানবীচেতনার প্রথম উদ্গাতাকে।
Post a Comment