যে দেশে পোষা প্রাণী থাকলেই হতে পারে কারাদণ্ড!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: "আমার পোষা কুকুরটা আমার দিকে তার সুন্দর-নিরীহ চোখে তাকায়। সে ভাবে, একটু পরেই আমি তাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বেরোবো। কিন্তু তা সম্ভব নয়, আমার সেই সাহস নেই। কারণ রাস্তায় বেরোলেই আমাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে", দুঃখভারাক্রান্ত মনে কথাগুলো বলছিলেন ইরানের রাজধানী তেহরানের অধিবাসী মাশা। কুকুর নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া যায় না- শুনে অনেকে বিস্মিত হলেও, সম্প্রতি সেই নিয়মই জারি করেছে ইরান। তাই নিজের প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে নিয়ে বিড়ম্বনায় আছেন বহু ইরানি নাগরিক।


সম্প্রতি পোষা কুকুর নিয়ে পার্কে যাওয়াকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইরানি পুলিশ। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে তারা 'জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা'কে উল্লেখ করেছে। একই সময়ে ইরানের সংসদে 'প্রোটেকশন অব দ্য পাবলিক রাইটস অ্যাগেইনস্ট অ্যানিমেলস' বিল পাশ হওয়ার কথা রয়েছে, যেটি পোষাপ্রাণী মালিকদের অধিকার আরো সীমাবদ্ধ করবে।


পশ্চিমাকরণের প্রতীক কুকুর!


প্রস্তাবিত আইন অনুসারে, একটি বিশেষ কমিটির জারি করা অনুমতি সাপেক্ষে পোষা প্রাণীর মালিকানা ঠিক হবে। শুধু তাই নয়, বিড়াল, খরগোশ ও কুকুরের মতো সাধারণ পোষা প্রাণী আমদানি, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন এবং নিজের মালিকানায় রাখার ক্ষেত্রে কারণভেদে সর্বনিম্ন ৮০০ ডলার জরিমানা করা হতে পারে।


কিন্তু পোষা প্রাণী নিয়ে ইরানের এই বিতর্ক প্রায় এক দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে বলে জানান ইরান ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট পায়াম মোহেবি। তিনি সংসদে প্রস্তাবিত বর্তমান বিলের ঘোর বিরোধী। মোহেবি জানান, এক দশক আগে একদল সংসদ সদস্য দেশের সব কুকুর বাজেয়াপ্ত করে সেগুলো চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়ার বা মরুভূমিতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে একটি আইন পাশ করতে চেয়েছিলেন। 


"বিগত বছরগুলোতে তারা এই আইনের ধারণা একটু একটু করে পরিবর্তন করেছে, এমনকি যারা কুকুর পালে, তাদেরকে কর্পোরাল শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনো কূলকিনারা হয়নি", বলেন মোহেবি।


ইরানের গ্রাম্য এলাকাগুলোতে কুকুর পোষা অতি পরিচিত একটি ব্যাপার, কিন্তু বিশ শতকে এসে এটি শহুরে জীবনেরও প্রতীক হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানই ছিল প্রথম, যারা ১৯৪৮ সালে প্রাণী অধিকার আইন পাশ করে এবং সরকারি অর্থায়নে প্রাণী অধিকার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এমনকি দেশটির রাজপরিবারেও পোষা কুকুর ছিল।


কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে উৎখাতের পর ইরানের সাধারণ মানুষ ও তাদের পোষা প্রাণীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।


ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী প্রাণীদের নাপাক হিসেবে দেখা হয়। এছাড়াও, নতুন শাসনামলে কুকুরকে 'পশ্চিমাকরণ' এর প্রতীক ধরা হয়। তেহরানের একজন ভেটেরিনারিয়ান ডা. আশকান শেমিরানির ভাষ্যে, "কুকুর পোষা যাবে কিনা তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনই প্রণীত হয়নি। কিন্তু কেউ কুকুর নিয়ে রাস্তায় বেরোলে, এমনকি গাড়িতে কুকুর দেখলেও পুলিশ জোরপূর্বক মালিককে গ্রেপ্তার করে। কারণ তাদের চোখে কুকুর পশ্চিমাকরণের প্রতীক!"


তিনি জানান, জব্দকৃত কুকুরগুলো রাখার জন্য আলাদা একটি 'কারাগার'ও বানিয়েছে কর্তৃপক্ষ এবং সেখানে প্রাণীগুলোকে অত্যাচার করা হয় বলে নানারকম গল্প রয়েছে- "প্রাণীগুলোকে খোলা জায়গায় খাবার-জল না দিয়েই দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয় এবং কুকুরের মালিককে আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়।"


বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইরান। পোষা প্রাণী নিয়ে প্রস্তাবিত বিলের পেছনে এটিরও ভূমিকা রয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষিত রাখতে গত তিন বছর যাবত পোষাপ্রাণীর খাদ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইরান।


এদিকে, আগে বাজারে বিদেশী ব্র্যান্ডের আধিক্য থাকায় এই নিষেধাজ্ঞার পর দেশীয় পেট ফুডের (পোষা প্রাণীর খাদ্য) দাম বাড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এবং পেট ফুডের কালোবাজার গড়ে উঠেছে।


তেহরানে একটি ভেটেরিনারি ক্লিনিকের মালিক মাশাদ বলেন, "আমরা কালোবাজার থেকে পোষা প্রাণীর খাদ্য কিনতে বাধ্য হই। তারা চোরাই পথে এই খাবারগুলো দেশে আনে। এক মাস আগেও খাবারের যে দাম ছিল, এখনকার দাম তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। আবার দেশে উৎপাদিত পেট ফুডের মান ভালো না। তারা নিম্নমানের মাছ-মাংস দিয়ে এসব খাবার তৈরি করে।"


বিড়ালেও আছে বিপত্তি!


তবে ইরানের সংসদে প্রস্তাবিত আইনে শুধু যে কুকুরের জন্যই হাজারো নিয়মনীতি, তা কিন্তু নয়। তালিকায় বিড়াল, এমনকি কুমির পর্যন্ত আছে!


বিশ্বখ্যাত প্রজাতির পার্সিয়ান ক্যাটের জন্মভূমি হিসেবে বিবেচিত ইরানে এখন বিড়াল অবাঞ্ছিত। তেহরানভিত্তিক একজন পশু চিকিৎসক বলেন, "শুনলে বিশ্বাস করা কষ্ট যে আপন ঘরেই এখন পর হয়ে গেছে আমাদের বিখ্যাত পার্সিয়ান বিড়াল।"


তিনি মনে করেন, এই আইনের পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই। শুধু ক্ষমতাবানরা তাদের ক্ষমতার জোরে এই আইন চাপিয়ে দিতে চাইছেন। ডা. মোহেবিও এই আইনি প্রস্তাবকে 'লজ্জাজজনক' বলে আখ্যা দিয়েছেন।


"এই বিলটা যদি সংসদে পাশ করা হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদের কিভাবে মনে রাখবে? তারা ভাববে এই দুজন লোকের জন্যই কুকুর-বিড়াল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি আমার 'ছেলে'র (কুকুর) জন্য সব করতে পারি, আমি তার জন্য আবারও আবেদন করবো", প্রিয় কুকুরকে পাশে নিয়ে ক্ষুদ্ধ স্বরে বললেন মাশা।


কিন্তু যদি আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়? 'তাহলেও আমি ওকে কোনোভাবেই রাস্তায় ফেলে রাখতে পারবো না!" জোর গলায় বললেন মাশা। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.