বাংলা চ্যানেলে যেভাবে জনপ্রিয় তুর্কি সিরিয়াল

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সুলতান সুলেমান, বাহার, ফেরিহা কিংবা ফাতেমাগুলের মতো তুর্কী সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা ভারতে সীমাহীন। নিখুঁত সম্পাদনা করা এ সিরিয়ালগুলো নানা কারণে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কী করেই-বা বাংলা চ্যানেলে এসেছে এসব সিরিয়াল!

বিশ্বের নানা দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে তুর্কি সিরিয়ালের ক্যাটালগ পাঠায় তুরস্কের বিভিন্ন কোম্পানি। একইভাবে ভারতের চ্যানেলগুলোও পেয়ে থাকে সিরিয়ালের ক্যাটালগ। ক্যাটালগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঐ নাটকের জনপ্রিয়তা কেমন, কতো মানুষ দেখেছে, কতো পুরস্কার পেয়েছে, রেটিং কেমন এমন তথ্য দেওয়া থাকে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে কয়েকটি সিরিয়াল দেখে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে তারা কোনটি প্রচার করবেন। এক্ষেত্রে তারা ভারতের দর্শকদের পছন্দ হতে পারে এমন সিরিয়ালকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এরপর ঐ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর প্রথমেই অনুবাদ ও স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজ হয়। এরপর প্রতিটি চরিত্রের নেপথ্যে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য অডিশনের মাধ্যমে মানানসই বাচিক শিল্পীকে বেছে নেয়া হয়। এরপর ডাবিং, সাউন্ড মিক্সিং এবং এডিটিং শেষে সিরিয়ালটি টেলিভিশনেসম্প্রচারের জন্য প্রস্তুত করা হয়। সম্প্রচারের আগে এ প্রতিটি ধাপে দীর্ঘমেয়াদে কঠোর পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।


ভারতে আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশীয় ধারাবাহিক নাটকের বেশ চল থাকলেও নব্বইয়ের শেষের দিকে ভারতীয় সিরিয়ালের আধিপত্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ভারতীয় ধারাবাহিকের বেশ বড় ধরনের প্রভাব দেখা যায় এক দশকের বেশি সময়। ভারতের বিপুল সংখ্যক টেলিভিশন দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ভারতীয় চ্যানেল। তবে সেই ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের সূচনা হয় ২০১৫ সালের পর।


দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি ‘সুলতান সুলেমান’ তুর্কি সিরিয়াল বাংলা ডাবিংয়ে প্রচার করলে ভারতের সিরিয়াল বিমুখ হন দেশীয় দর্শক। ইসলামের ইতিহাসভিত্তিক, আরেক দিকে এ নাটক কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া নানা উপকথা ও রহস্যঘেরা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেও বাংলার দর্শক চোখ রাখেন এ ধারাবাহিকটিতে। সম্রাট সুলেমান ও তার স্ত্রী হুররেম সুলতানের জীবনগাঁথা ও অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনামলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এটি। সুলতান সুলেমান সিরিয়াল সম্প্রচারের পর থেকে রাতারাতি সাড়া পড়ে যায়। কয়েক মাসের মাথায় সিরিয়ালটি দেশের টিভি অনুষ্ঠানমালার তালিকার শীর্ষে উঠে আসে।


পরবর্তীতে অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলও একাধিক তুর্কি সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু করে। এগুলোর বেশিরভাগ দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। এতে দেখা যায়, ভারতীয় সিরিয়াল থেকে মানুষ সরে এসে এসব ভিন্ন ঘরানার তুর্কি সিরিয়াল দেখতে দেশীয় টেলিভিশনে বেশি ঝুঁকছেন দর্শকরা।


তুর্কি নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এসব নাটকে গল্পের বৈচিত্র্য, অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, তুরস্কের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-আভিজাত্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ, রাজত্ব-রাজা আর শাসন ব্যবস্থার নান্দনিক উপস্থাপন, সংলাপ, অভিনয়, সংগীত আয়োজন, পোশাক ও সেট ডিজাইন বেশ নজরকাড়া। যার ফলে তুর্কি সিরিয়ালগুলো বর্তমানে দর্শকপ্রিয়তায় বেশ দাপুটে অবস্থানে আছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা, যা প্রতিযোগিতার বাজারে বড় একটা অবস্থান করে নিয়েছে।


তুরস্কের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিরিয়াল অটোম্যান সাম্রাজ্য, ওসমানিয়া সাম্রাজ্য, তুর্কি মুসলিমদের জীবনধারা, ওসমানিয়া খেলাফত পূর্ববর্তী তুরস্কের নানা ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। এসব সিরিয়ালের বিষয়বস্তু ও সংলাপের মাঝে ইসলামী ভাবধারা এবং মুসলমান শাসকদের ইতিহাসের কিছু বিষয় প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।।


ধারণা রয়েছে যে, অটোম্যান সাম্রাজ্য বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়কে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিল। এ কারণে অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মতো ভারতেও এ তুর্কি সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবা রহমান।


কল্পকাহিনী বা পুরাণের চাইতে মানুষের স্বভাবগতভাবেই ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ দেখার ও তথ্য জানার আগ্রহের কমতি নেই। তুর্কি সিরিয়ালে মানুষ সেই খোরাক মেটাতে পারছে। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য তারা বোধ করে। সেটা থেকে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়।


সেক্ষেত্রে তুর্কি সিরিয়ালগুলোর পোশাক পরিকল্পনা, সেট ডিজাইন, রাজ ষড়যন্ত্র, কলহ-বিবাদে ভিন্নতা আছে। কিন্তু সেটাও একঘেয়ে হয়ে পড়লে মানুষ আগ্রহ হারাবে। বিষয়ের ভিন্নতা থাকলে মানুষ তা সহজে গ্রহণ করে।


তুর্কি সিরিয়ালগুলো বেশ বড় বাজেটে নির্মাণ হয়ে থাকে। এর সেটের নকশা, আলো প্রক্ষেপণ, শব্দ সম্পাদনা, অ্যাকশন পরিচালনা বেশ উচ্চমানের। সেইসঙ্গে সুদর্শন অভিনেতা অভিনেত্রীদের বিচরণ এবং তাদের অনবদ্য অভিনয় ও সংলাপ আরো ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।


সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে গানের যে আবহ সংগীত তৈরি করা হয়, সেগুলোও বেশ মনোমুগ্ধকর। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সিরিয়ালগুলোর ভাষার ব্যবহার অন্তত সুনিপুণ এবং মাধুর্যপূর্ণ । এতে করে যেকোনো দর্শক সিরিয়ালগুলোর প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.