ব্রহ্মাণ্ডের শত কোটি তারার ভিড়ে এবার সন্ধান চলবে ভিনগ্রহী প্রাণের

 


ODD বাংলা ডেস্ক: চলতি সপ্তাহে নতুন ইতিহাস গড়েছে আমেরিকার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। মানুষের তৈরি এবং মহাশূন্যে স্থাপিত সবচেয়ে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে এটি আমাদের চারপাশের অসীম মহাবিশ্বের তুলনামূলক ক্ষুদ্র অংশের অসামান্য সব ছবি তুলেছে। ছবির নিখুঁত দৃশ্যধারণের বিচারে যা এক কথায় অসাধারণ। এমন ছবি আগের প্রযুক্তির কোনো স্পেস টেলিস্কোপ থেকে মেলেনি। তাই দুনিয়ার বাঘা বাঘা জ্যোতির্বিদেরা যেমন অভিভূত, তেমনি তারা সাধুবাদ জানাচ্ছেন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-কে।


মহাকাশ বিজ্ঞানী মহলে জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবি অনেককে করেছে বাকরুদ্ধ, কেউ বা আনন্দের অশ্রুতে ভিজিয়েছেন দু চোখ। আর আমার মতো মহাকাশ জীববিজ্ঞানী– যারা জীবনের উৎস, বিবর্তন, বিতরণ এবং মহাবিশ্বে জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধ্যয়ন করি, তারাও বেশ উত্তেজিত।


সময়ের শুরু কি মহাবিশ্বের সূচনালগ্ন থেকেই? তাই ধরে নেওয়া হলে, জেমস ওয়েব সেই সূচনালগ্নের কিছুকাল পরের অনেক রহস্য তুলে ধরার মতো ছবি তুলেছে। চিত্রে স্পষ্টতা ছিল গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গড়ন নিয়েও; যা হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে পুরনো প্রশ্নের উত্তর আবিষ্কারের সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে। সত্যিই কি মানুষ মহাবিশ্বে একা? নাকি আমাদের মতো বা তার চেয়েও বুদ্ধিমান জীব বিচরণ করছে দূর কোনো গ্রহের অচেনা জগতে?


পৃথিবীর বুকে একটি বালুকণা যতটুকু আয়তনের, ডিপ ফিল্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাবিশ্বের সুদূরতম এক অঞ্চলের ততটুকু স্থানের ছবি তুলেছে জেমস ওয়েব। অথচ সেই এক কণার মধ্যেই দেখা গেছে স্ম্যাক্স ০৭২৩ (SMACS 0723) নামক এক ছায়াপথ গুচ্ছ। এই গুচ্ছে কেবল ছায়াপথের সংখ্যাই হাজার হাজার। 



এই ছায়াপথগুলোতে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র; অধিকাংশেরই আছে নিজস্ব গ্রহ ও উপগ্রহ। এসব গ্রহ আবার ঘুরছে নিজ নিজ নক্ষত্রের চারপাশে। এভাবে তৈরি হয়েছে এক একটি সৌরজগৎ। এখন একবার ভাবুন, প্রতিটি ছায়াপথে যদি গড়ে ১০ হাজার কোটি নক্ষত্রও থাকে, তাহলে এই একটি ছবিতে ঠিক কতগুলো সৌরজগত রয়েছে!


আমরা আকাশগঙ্গা (মিল্কিওয়ে) ছায়াপথের বাসিন্দা। আমাদের সূর্য এবং তার সৌরজগতের অবস্থান এই ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ বাহুতে। আমাদের সৌরজগতে বাসযোগ্য গ্রহ- পৃথিবী। সম্ভাব্য বাসযোগ্যদের কাতারে আছে- মঙ্গল, ইউরোপা, এনসেলাডুস ও টাইটান। বাসযোগ্য জগতের এই মেলার দিকে তাকিয়ে ধারণা করাই যায় যে, নতুন ছায়াপথগুচ্ছের গ্রহ ও উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। এটাও মনে রাখা উচিত, মহাবিশ্বে এমন ছায়াপথগুচ্ছের অভাব নেই। অর্থাৎ, ভিনগ্রহের জীবন নিছক কোনো কল্পনা নয়, বরং অপেক্ষা করছে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের।


মিড-ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্ট বা মিরি নামের পৃথক একটি যন্ত্রের মাধ্যমে এসব নক্ষত্র ও তাদের ছায়াপথের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যায়। যেমন, ছায়াপথে বয়স্ক নক্ষত্র কম থাকলে সেখানে ধুলিমেঘ থাকে কম, ফলে তাদের সমষ্টিকে উজ্জ্বল নীল বর্ণের দেখায়। অন্যদিকে, নবীন তারকার সংখ্যা কম, এমন ছায়াপথে ধূলিমেঘ এত বেশি থাকে যে তাকে লালচে দেখায়। আমার মতো নভো-জৈববিজ্ঞানীর কাছে সবচেয়ে আকর্ষক হলো- সবুজরঙ্গা ছায়াপথগুলো। কারণ সবুজ রঙ সেখানে হাইড্রোকার্বনসহ প্রাণের অস্তিত্ব সৃষ্টির জন্য দরকারি অন্যান্য রাসায়নিকের উপস্থিতির প্রমাণ।



ফাইন গাইডেন্স সেন্সর, নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার ও স্লিটলেস স্পেকটোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে জেমস ওয়েবের তোলা ছবির ইনফ্রারেড বর্ণচ্ছটা বিশ্লেষণ করেছেন নাসার গবেষকরা। পৃথিবী থেকে ১,১৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ওয়াস্প-৯৬বি (Wasp-96b) নামক বৃহস্পতির মতো একটি সুবিশাল উত্তপ্ত গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসা সুদূর নক্ষত্রের আলোকে এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। গ্রহটি আমাদের সৌরজগতের বুধ গ্রহের মতোই ঘুরছে নিজ নক্ষত্রের অনেক কাছে।


ওয়াস্প-৯৬বি গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসা আলোতে ঢেউ খেলানো এক অবস্থা লক্ষ করা গেছে, যা ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতির প্রমাণ। গ্রহটি অত্যন্ত উত্তপ্ত হওয়ায় সেখানে তরল জল থাকতে পারে না, পুরোটাই বায়ুমণ্ডলে বাষ্পাকারে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই আবিষ্কার ছিল উৎসাহজনক, এখন আমাদের সামনে মূল লক্ষ্য দক্ষ গোয়েন্দার মতো অন্যান্য ছোট ও পাথুরে গ্রহে জীবনের উপযুক্ত পরিবেশ সন্ধান। এবং এমন গ্রহ খুঁজে বের করা যেখানে প্রাণের আবির্ভাব ও বিকাশ লাভ করতে পারে।


কৌতূহল জাগতে পারে, কীভাবে আমরা মহাকাশ জৈব বিজ্ঞানীরা এ কাজ করব? আসলে আমরা খুঁজছি, আমাদের পৃথিবীর মতোই আবহাওয়ামণ্ডল– যেখানে থাকবে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলের উপস্থিতি। আসলে পৃথিবীর মতো পরিবশই বিজ্ঞানের কাছে বর্তমানে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানের আদর্শ মাপকাঠি।


তবে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল চিরকাল আজকের মতো উপাদানের গড়নে গঠিত ছিল না। তাই আমাদের ধারণা, অন্যান্য বায়ুমণ্ডলীয় গড়নও বাসযোগ্য গ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা এসব সম্ভাবনাময় অনুঘটককে বলি 'হ্যাবিটাবিলিটি মার্কার্স' বা যারা প্রাণের উপযুক্ত পরিবেশ ইঙ্গিত করতে পারে। এমন গ্রহে সমুদ্র বা গাছের আচ্ছাদন থাকলে তা গ্রহটির প্রতিফলিত আলোতে এক ধরনের ছাপ ফেলে- যা আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে শনাক্ত করতে চাইছি।



আমরা মহাকাশ জৈব বিজ্ঞানীরা এসব গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জৈব-চিহ্ন বহনকারী গ্যাসের অস্তিত্বও খুঁজছি। আসলে এসব গ্যাস হলো জৈবচক্র গতিশীল থাকার ইঙ্গিত। যেমন আমাদের আজকের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণে রয়েছে অক্সিজেনের উপস্থিতি– যা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন হয়। বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত আরেকটি গ্যাস হচ্ছে মিথেন–এটি উৎপন্ন হয় ক্ষুদ্র জৈবপ্রাণের পরিপাক প্রক্রিয়া বা মিথেনোজেনেসিসের মাধ্যমে।


তবু বলে রাখা ভালো, এসব বায়ো-নির্দেশক গ্যাসের উপস্থিতি নির্ণয় মানেই কোনো গ্রহে নিশ্চিতভাবে জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া নয়। বরং সে কাজটি আরও কঠিন। কারণ এসব গ্যাস অনেকসময় জৈব উৎস থেকে না হয়ে- আগ্নেয়গিরি, জল ও পাথরের একে-অন্যের সংস্পর্শে আসার মিথস্ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হতে পারে। আবার মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর কর্মকাণ্ডেও এসব গ্যাস নিঃসৃত হয়।


আপাতত বৈশ্বিক আকারে নিঃসৃত এসব জৈবচিহ্নের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু, এসব হ্যাবিটাবিলিটি মার্কার্স বা জৈবচিহ্নকে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অসাধারণ শক্তিশালী ক্ষমতার সাহায্যে আরও স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে ভবিষ্যতে। বর্তমানে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি তাতে এই সম্ভাবনাই যথেষ্ট চাঞ্চল্যকর।


জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সচল হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আমরা যেভাবে মহাবিশ্বকে দেখতাম- তাতে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আগামীতে এটি আমাদের কোনো গ্রহের রাসায়নিক ও খুব সম্ভবত জৈবিক গড়নের দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দেবে। হয়তো বা আমরা অনন্ত মহাবিশ্বে নতুন প্রাণের সন্ধান পেয়েও চমকিত হব। কারণ আমি সর্বদাই বিশ্বাস করেছি, ব্রহ্মাণ্ডের এই চরাচরে আমরাই একমাত্র প্রাণধারক গ্রহের বাসিন্দা নই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.