অভিশাপেই ধ্বংস হয়েছিল প্রাচীন এই নগরী
ODD বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীতে সভ্যতার বিবর্তনে নানা জাতি, নগরী, সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে। এর অনেক কারণই সামনে আনেন ইতিহাসবিদরা। বিভিন্ন সময় গবেষণা করতে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পেয়েছেন হাজার হাজার বছর পুরনো হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার নিদর্শন। তেমনই এক হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরী হাত্তুসা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অভিশাপেই নাকি ধ্বংস হয়েছিল এই নগরী। আজকের লেখা থাকছে এই নগরীর গোঁড়া পত্তন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আদ্যোপান্ত-
তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের ইওরুম প্রদেশের আধুনিক বোয়াজকালের নিকট অবস্থিত এই প্রাচীন নগরীটি। একসময় হাত্তুসা ছিল শক্তিশালী প্রাচীন হিট্টাইট সাম্রাজ্যের রাজধানী। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের অমারনা লেটারের নিদর্শন থেকে জানা যায়, মিশরীয় হিট্টাইটরা তৎকালীন শক্তিশালী ব্যবিলনীয় কিংবা আসেরীয় সভ্যতার সমান ছিল।
হিট্টাইটদের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন, অন্যান্য অঞ্চল থেকে এসে তারা হাত্তুসা অঞ্চলে নতুন সভ্যতা গড়ে তোলে। অন্য একটি মতবাদ প্রচলিত আছে, হিট্টাইটরা ছিল যুদ্ধবাজ জাতি। তারা অন্যের ভূমি দখল করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তবে কোনো মতবাদের পক্ষেই স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই এর গোঁড়া পত্তন নিয়ে গবেষকরা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের গবেষণা।
হিট্টাইটরা খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে হাত্তুসা কেন্দ্রিক একটি নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সে সময় এই অঞ্চলে আরো কয়েকটি ছোট ছোট নগর রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। হিট্টাইটদের প্রতিষ্ঠিত আরেকটি নগর হলো কানেশ। হাত্তুসার পাশেই এর অবস্থান। সে সময়ের লিখিত নথি থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ২ হাজার অব্দে এই অঞ্চলে অসেরিয়ানরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তবে এর কয়েক শতাব্দী পরই রহস্যজনকভাবে হিট্টাইটদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। সেই সময়ের তারিখের লিখিত নথি থেকে জানা যায় এই অঞ্চলের নাম হাত্তুসা।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দে কুসারার রাজা আনিত্তা হাত্তুসা দখল করেছিলেন।কুসারার অবস্থান কোথায় ছিল তাও খুঁজে পান নি কেউ। তবে তিনি এই অঞ্চলে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন নি। আনিত্তা অজানা কারণে শিলালিপিতে তার বিজয়ের ঘোষণা দেয়ার পর এই নগরের বিরুদ্ধে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তার অভিশাপ ছিল এই নগর কেউ পুনর্গঠন কিংবা রাজত্ব করতে পারবে না। এরপর থেকেই হাত্তুসা অভিশপ্ত নগরী হিসেবে আখ্যায়িত হয়। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় হাত্তুসা পরবর্তী সময়ে পুনর্গঠন হয়েছিল কিনা তাও জানা যায় না।
তবে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ পর হিট্টাইটদের রাজা হট্টুসিলি এই নগরীতে শাসন শুরু করেছিলেন। তাকে কুশার ম্যান বলে ডাকা হত। হাত্তুসায় প্রাচীন কালে হিট্টাইটরা একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল হাত্তুসা নগরী। সে সময় এখানে বেশ কিছু স্থাপনা এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। আজো স্থাপনাগুলোর ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে।
প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ আছে এই প্রাচীন নগরীতে এবং শত শত টাওয়ারের অস্তিত্বের নিদর্শন আছে। এগুলো নগরীর প্রতিরক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। পাথরের তৈরি এই দেয়ালে পাঁচটি প্রবেশদ্বার ছিল। সিংহ গেট এবং স্ফিংস গেট এর মধ্যে সব থেকে বেশি পরিচিত। প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা ছাড়াও হাত্তুসায় অনেকগুলো মন্দিরের চিহ্ন আছে। এর মধ্যে ১৩ শতাব্দীর গ্রেট টেম্পেলের কাঠামোর অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা ২০১৬ সালে হাত্তুসায় প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর পূর্বের একটি গোপন সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করেছেন। সেখানে প্রাপ্ত কিউনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে জানা যায় পুরোহিতরা এই গোপন সুড়ঙ্গে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন। প্রাচীন হাত্তুসার কারিগররা পাথরশিল্পে বেশ দক্ষ ছিল। তারও প্রমাণ মেলে পাথর কেটে সুনিপুণভাবে বিভিন্ন চিত্র কর্ম এবং অবয়ব নির্মাণের নিদর্শন থেকে।
প্রায় ৫০ টন ওজনের পাথর খণ্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে হাত্তুসায়। হাত্তুসার পাথর শিল্পের সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো স্থাপনায় ব্যবহৃত অনেক পাথরে নিখুঁত এবং মসৃণ গোলাকার ছিদ্র করা। আধুনিক যুগের ড্রিল মেশিনের দ্বারা এমন ছিদ্র করা সম্ভব।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাচীন হাত্তুসার কারিগররা কীভাবে এবং কেনো পাথরে এমন গোলাকার ছিদ্র করেছিল সে রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। প্রাচীন হাত্তুসার আরেকটি বিস্ময় হলো বিশাল আকারের সবুজ পাথর। পাথরগুলো মসৃনভাবে পলিশ করা। হাত্তুসায় এই সবুজ পাথর কোথা থেকে আনা হয়েছিল এবং কি কাজে ব্যবহৃত হত সে সম্পর্কে কোনো কিছুই জানা যায়নি। শহরটি মাত্র ৮ মাইল দৈর্ঘ্যের ছিল। একটি স্মৃতিচিহ্ন প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল পুরো নগরী। এর প্রবেশ দ্বারও ছিল। যেটির নাম সিংহ দ্বার। এসব তথ্যই পাওয়া যায় ধ্বংসাবশেষে পাওয়া নথি আর শিলালিপি থেকে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৩ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হিট্টাইট সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। তাদের প্রতিবেশী আসেরীয়দের কারণেই তাদের পতনের সূচনা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১১৯০ অব্দে এই নগরীর চূড়ান্ত পতন এবং ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। প্রায় ৪০০ বছর পরিত্যক্ত থাকার পর নগরটি পুনর্গঠিত হয়েছিল। হিট্টাইটদের সম্পর্কে ইতিহাস থেকে এরপরের সময়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। ১৯ শতকে তুরস্কের আধুনিক বোয়াজকালে প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট খননের পর হাত্তুসা নগরের সমৃদ্ধ নিদর্শন সম্পর্কে জানা যায়।
Post a Comment