কলকাতা থেকে সরিয়ে ভারতের রাজধানী কেন দিল্লিতে?

ODD বাংলা ডেস্ক: কলকাতা। ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল এটি। অপরদিকে দিল্লির অবস্থান দেশের উত্তরাঞ্চলে। তাই ব্রিটিশ সরকারের মনে হয়েছিল, দিল্লি থেকে ভারত শাসন করা অপেক্ষাকৃত সহজতর হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রস্তাব ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে রাখা হয়েছিল।
চিঠিটি ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট পাঠানো হয়েছিল সিমলা থেকে লন্ডনে। প্রাপকের ঘরে নাম লেখা ছিল তৎকালীন সেক্রেটারি অভ স্টেট ফর ইন্ডিয়া, আর্ল অভ ক্রুইর। হার্ডিঞ্জ সেখানে গুরুত্বারোপ করেছিলেন ভারতের চরমভাবাপন্ন এলাকা কলকাতা থেকে গোটা অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্ভূত বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে। তিনি সেখানে আরো লিখেছিলেন, রাজধানী হিসেবে ভারতবর্ষের প্রয়োজন আরো কেন্দ্রীভূত একটি শহর।

ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে স্বভাবতই বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি চলে আসে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কিংবা অর্থনীতি ও বাণিজ্য, সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কিন্তু ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর, প্রশাসনিক সুবিধার্থে, বাংলাকে ভেঙে দুইভাগ করে দেয় ব্রিটিশরাজ। এক অংশে ছিল মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা, অন্য অংশে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা।

“ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতি অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল। কিন্তু এ নীতি পশ্চিম বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আঘাত হানে। তখন তারা সব বিদেশি পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেয়। বঙ্গভঙ্গ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এক পর্যায়ে এমন চরম রুপ নেয় যে, বোমাবাজি ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কলকাতার নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়। কলকাতার আকাশ-বাতাস যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ বেশ ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন কলকাতা আর তাদের জন্য শাসনকার্য পরিচালনার উপযোগী, মিত্রাভাবাপন্ন শহর নেই। তাই তিনি চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ত্যাগ করতে হবে। হার্ডিঞ্জ তার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে। তিনি ঘোষণা দেন কলকাতার পরিবেশ ঠাণ্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার এবং সেই সঙ্গে রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তরের।

অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়া দিল্লি যাত্রা শুরু করে। তবে এ যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে দিল্লি দরবার নামক রাজকীয় অনুষ্ঠানে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। এর ২০ বছর পর, ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

এসময় দিল্লির নাম প্রস্তাবের পাশাপাশি এর কারণগুলোও উল্লেখ করা হয়। কারণ হিসেবে প্রাধান্য পায় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রসহ দিল্লির অবস্থান। কলকাতা যেখানে অবস্থিত দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে, সেখানে দিল্লির অবস্থান দেশের উত্তরাঞ্চলে। তাই ব্রিটিশরাজ বিশ্বাস ছিল কলকাতা অপেক্ষা দিল্লি থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষ শাসন করা তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। নতুন রাজধানীটিকে বের করে নিয়ে আসা হয় তৎকালীন অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে, এবং ১৯২৭ সালে এর নামকরণ করা হয় “নয়া দিল্লি” হিসেবে।

প্রাথমিকভাবে সবার ধারণা ছিল নতুন রাজধানীটিকে প্রস্তুত করে ফেলতে প্রয়োজন হবে বড়জোর চার বছর। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে নষ্ট করে দেয় যাবতীয় পরিকল্পনা। তাই তো চার বছর শেষমেষ গিয়ে স্পর্শ করে বিশ বছর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরাজ। তাই তাৎক্ষণিকভাবে নয়া দিল্লিতে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে ছিল না।

যেমনটি বলা হয়ে থাকে, প্রথমে সিভিল লাইনসে সরকারের একটি অস্থায়ী আসন স্থাপন করে ব্রিটিশরা। ১৯১২ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য একটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-ও তৈরি হয়ে যায় এবং রাইজিনা হিলে স্থাপিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ব্লকগুলো।

যেভাবে কাজ এগোচ্ছিল, তাতে লুটিয়েনস ও বেকারের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে খেই হারিয়ে ফেলেন তারা এবং নয়া দিল্লি পুরোপুরি সংস্কার হতেই লেগে যায় ১৯৩১ সাল। কেবল তারপরই সম্ভব হয় এটিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন। সব মিলিয়ে কলকাতা থেকে যাবতীয় প্রশাসন নয়া দিল্লিতে স্থানান্তরের পেছনে খরচ হয়েছিল চার মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.