দুর্ধর্ষ ‘গুলাবি গ্যাং’ ! রাস্তায় বেরলেই...

ODD বাংলা ডেস্ক: উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ২০০৫-০৬ সালের দিকে সাম্পাত পাল দেবী নামে এক গৃহবধূ নারী অধিকার রক্ষায় একটি সংগঠন শুরু করেন।

ঐ গ্রামে এবং আশপাশে যারা স্ত্রীদের মারধর করতো, নারীদের উত্যক্ত করতো, বলাৎকার করতো, তাদের বিরুদ্ধে বা এলাকার দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ঐ নারী সংগঠন। তাদের সদস্যরা রীতিমত লাঠি-সোটা নিয়ে মারপিট করতো।

বর্তমানে গুলাবি গ্যাং নামে ঐ সংগঠন দেশের বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, যাদের সদস্যরা মূলত গৃহবধূ, পরনে থাকে গোলাপি রংয়ের শাড়ি, হাতে লাঠি। তাদের নিয়ে বলিউডে একটি চলচ্চিত্র পর্যন্ত তৈরি হয়েছে।

তার জন্ম ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত বুন্দেলখান্ডে। এই অঞ্চলে সমাজে-সংসারে নারীর মর্যাদা খুবই নিচুতে। স্বামী বা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার, মারধর নিত্যদিনের ঘটনা। সেই সঙ্গে রয়েছে নারীদের উত্যক্ত আর ধর্ষণের জন্য তৎপর অপরাধী চক্র।

মাত্র ১২ বছর বয়সে সাম্পাত দেবীকে স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেখার স্পৃহা তার যায়নি। গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে সে পড়াশোনা শিখতো। তারপর ১৬ বয়সে সে প্রথম অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো। গ্রামের এক পুরুষ প্রায় নিয়মিত তার বউকে পেটাতো। তাকে ঠেকানোর জন্য তিনি পরিবারের কাছে অনেক অনুরোধ করেন, কিন্তু কেউই কোনো পাত্তা দিলো না।নিজেই এগিয়ে গেলেন। মানুষটিকে মুখের ওপর জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে প্রতিদিন তার বউকে পেটায়। রেগে গিয়ে মানুষটি তাকে গালাগাল শুরু করলো। গ্রামের অন্য কয়েকবন নারীর সাহায্যে মাঠের মধ্যে সেদিন লোকটিকে পিটিয়েছিলেন সাম্পাত দেবী। সেটাই ছিল শুরু। 

এরপর তিনি গ্রামের আরো কয়েকজন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করলেন, তারা বউকে মারধর করার ঘটনার ওপর নজরদারি শুরু করলো। তাদের হাতে থাকতো বাঁশের লাঠি। তিনি জানতাম জোটবদ্ধ হলে বাইরের কারো কোনো সাহায্য লাগবে না। যখন একজন নারী একা কিছু করতে পারবে না, হাজার নারী তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে এমনটায় বিশ্বাস করেন সাম্পাত দেবী।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেই গান বাধতের সাম্পাত। গানের ভাষা ছিল এরকম - ‘অনেক দিন হয়ে গেছে। ভারতের নারীরা তোমরা এখন জাগো, উঠে দাঁড়াও। আমরা ঘরে কখনই শান্তিতে থাকতে পারিনি। সুতরাং একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াও’ সাম্পাত দেবী চাইলেন এই সংগঠনের নারীদের যেন মানুষজন চিনতে পারে। পোশাকের জন্য একটি রং বাছলেন তারা।

মেয়েদের কাছ থেকে একমো রুপি করে চাঁদা নিয়ে কানপুর থেকে শাড়ি অর্ডার করলেন। তাদের বললেন, চলো সবাই একরঙা শাড়ি পরি, যাতে মনে হয় আমরা ইউনিফর্ম পরছি। এরপর দেখলেন একমাত্র গোলাপি রং কোনো রাজনৈতিক দল এখনো ব্যবহার করছে না। প্রথমেই পাঁচশো গোলাপি রংয়ের শাড়ি অর্ডার করলেন। তখন থেকেই এই সংগঠনকে বলা শুরু হয় গুলাবি গ্যাং। 

২০০৬ সালে নাগাদ এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার। সেই বছরই পুলিশের দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে গুলাবি গ্যাং স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে।পুলিশ একজন নিরপরাধ মানুষকে ১১ দিন ধরে আটকে রেখেছিল। কারণ তার স্ত্রী গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। মহিষ চুরির মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ লোকটিকে আটকে রেখেছিল। এরপর সাম্পাত দেবী থানায় গিয়ে জানতে চাইলেন কেন এটা করা হচ্ছে? কিন্তু থানার ইন-চার্জ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তিনি ফিরে যান, কিন্তু গুলাবি গ্যাংয়ের ৩০০ সদস্যকে আশপাশের রাস্তার কুকুর সঙ্গে করে থানায় কাছে জড় হতে বলেন। সাম্পাত পুলিশকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তাদের চাইতে রাস্তার কুকুরের ওপর বেশি বিশ্বাস করা যায়, আস্থা রাখা যায়।

পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি,ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায় গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যদের। পুলিশ তাকে ধরার চেষ্টা করে। সাম্পাত তাদের চড় মারেন। তারপর এই গ্যাংয়ের নারীরা থানার ইন-চার্জকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেন।

গুলাবি গ্যাং সেদিন এতো হৈ-চৈ করেছিলো যে ভারতের কেন্দ্রীয় পুলিশের বড় একটি দলকে ঐ গ্রামে পাঠাতে হয়েছিল।সিবিআই এর লোকজন সাম্পাতকে জিজ্ঞাসা করেছিল,  কুকুর কেন নিয়ে আসলে? তিনি তাদের উত্তর দিয়েছিলেন পুলিশ যখন বড় কোনো অপরাধ তদন্ত করে তারাও তো তখন কুকুর সঙ্গে রাখে। পুলিশ যদি তা পারে, আমরা পারবো না?

ছড়িয়ে পড়ছিল গুলাবি গ্যাংয়ের কথা
পুলিশ শেষ পর্যস্ত ঐ নিরপরাধ ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়। গুলাবি গ্যাংয়ের সেই বিজয়ের ঘটনা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয় সেই খবর।

গুলাবি গ্যাংয়ের আন্দোলনের ফলে অপরাধী এবং প্রভাবশালী একজন স্থানীয় রাজনীতিকের বিচার হয় এবং তার ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। শুধু ঘরে সহিংসতাই নয়, গুলাবি গ্যাং সমাজের অন্যান্য অনাচার যেমন বাল্য বিবাহ এবং সতীদাহের মত অনাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে তৎপর হয়। তিনি তার এলাকার নারীদের বলেছিলেন, অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কার বন্ধ করতে হবে, এবং অধিকারের জন্য লড়াইয়ে নামতে হবে। আরো অনেক নতুন নতুন নারী গোলাবি গ্যাংয়ের সঙ্গে একমত হলো। ফলে তাদের সংগঠন বড় হতে থাকে।

২০১০ সালে আবারো গুলাবি গ্যাং খবরে আসলো। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিক অল্প বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনে। প্রতিবাদে গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় জেলখানার সামনে টানা ১১ দিন ধরে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিল মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে আসল অপরাধী পুরুষোত্তম দিবেদিকে ধরে বিচার করতে হবে। পরে ঐ রাজনীতিকের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।

ঐ কদিনে ১০ হাজার মানুষ ঐ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। শীতের সময় ছিল তখন। ট্রেনে চড়ে দলে দলে নারীরা আসতো প্রতিবাদে অংশ নিতে। পালাক্রমে একদল আসতো, একদল বাড়ি যেত। গুলাবি গ্যাংয়ের কার্যক্রম এখন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তাদের প্রধান তৎপরতা উত্তর প্রদেশে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.