মৃত্যুই যেন এই শিল্পীর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়
ODD বাংলা ডেস্ক: বিশ্বের বিখ্যাত এবং দামি কয়েকটি চিত্রের মধ্যে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের স্টারি নাইট একটি। চিত্রশিল্পের ইতিহাসে বহু উচ্চকিত একটি নাম। জীবদ্দশায় এই শিল্পীর দাম ছিল না কানাকড়িও। ভাগ্যাহত এ শিল্পী বেঁচে থাকতে মাত্র একটি ছবিই বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তার দাম ছিল মাত্র ৪০০ ফ্রাঙ্কে, যা বর্তমানের ১৬০০ ডলারের সমান। অথচ মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালে তার নিজের পোর্ট্রেটই বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৭১ মিলিয়ন ডলারে।
স্টারি নাইট ছবিটি আধুনিক সংস্কৃতিতে বহু আলোচিত। সবচেয়ে বেশিবার আঁকা হয়েছে এর প্রতিকৃতি। ১৮৮৯ সালে সেইন্ট রেমির একটি অ্যাসাইলামে থাকা অবস্থায় তিনি এটি আঁকেন। এতে উঠে এসেছে উথাল-পাতাল আকাশের নিচে ঘুমন্ত সেইন্ট রেমির দৃশ্যপট। এটির আগে আরো বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছেন একই দৃশ্যপট নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে। তবে এটিই শিল্পবোদ্ধাদের নজর কেড়েছে বেশি। ছবিতে বাম দিকের সাইপ্রেস গাছটি পরে যোগ করা হয়েছে।
তবে নিজের শিল্পের মতোই নিজের জীবনের জন্যেও বরাবর এসেছেন আলোচনা। মৃত্যুই যেন তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তবে জীবদ্দশয়া ছিলেন শুধুই হতাশায়। জীবনের শুরু থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল তার পুরোটা সময়। ছেলেবেলায় পিতৃবিয়োগ তাকে করেছিল কর্মমুখী। তবে ধ্যান জ্ঞান ছিল তার অন্যদিকে। ছবি আকার নেশা পেয়ে বসেছিল তার ছেলেবেলা থেকেই। তগবে সেভাবে সুযোগ হয়নি।
এতো নেশা বা প্রতিভা থাকলেও তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি কখনো। জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবি বিক্রি করতে পেরেছিলেন ভ্যানগগ। জীবনের শব সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। ভিনসেন্ট ভ্যান গগকে নিয়ে বেশ কিছু বছর ধরেই চলছিল গবেষষণা। এবার সদ্য প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেল এক চমকপ্রদ তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, অ্যালকোহল প্রত্যাহারের ফলে 'ডেলিরিয়াম' থেকে ভুগছিলেন শিল্পী।
শিল্পীদের মানসিক রোগ সংক্রান্ত একটি নতুন গবেষণায় সামনে এসেছে এই তথ্য। কী এই ডেলিরিয়াম? চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেলিরিয়াম হল মস্তিষ্কে হঠাৎ পরিবর্তন যা মানসিক বিভ্রান্তি তৈরি করে; স্বাভাবিক চিন্তাভাবনায় বিঘ্ন ঘটায়। মনোযোগে ঘাটতি পড়ে। স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়। ঘুমও হয় না ঠিক মতো। অ্যালকোহল প্রত্যাহারের সময় ‘উইথড্রয়াল সিনড্রোম’ হিসেবে, অস্ত্রোপচারের পরে অথবা ডিমেনশিয়া থাকলে এই ডেলিরিয়ামের মতো কঠিন ব্যাধি দেখা দিতে পারে।
ডাচ শিল্পী ভ্যান গগ, তারা ভরা আকাশের ছবি আঁকতেন যিনি অদ্ভুত নীল রঙের মায়ায়, আচমকাই আত্মহত্যা করেছিলেন ৩৭ বছর বয়সে। সালটা ১৮৯০। ততদিনে আঁকা হয়েছে সাকুল্যে ন’শোটার মতো ছবি। চিকিৎসকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন গুরুতর বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগে ভুগছিলেন তিনি। যদিও এই অসুস্থতাগুলো তার কখনোই ধরা পড়েনি।
ভিনসেন্টের মন খারাপের সন্ধান করতে বিশেষজ্ঞরা তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখেছেন শিল্পীর লেখা ন’শোরও বেশি চিঠি। এর মধ্যে ভাই থিওকেই লেখা অর্ধেকেরও বেশি। ভিনসেন্টের চিকিৎসা করা ডাক্তারদের বয়ানও দেখা হয়েছে খতিয়ে। বারবার দেখা হয়েছে মেডিক্যাল রেকর্ড।
নেদারল্যান্ডসের দ্য ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার গ্রোনিঞ্জেনের গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে ভ্যান গগ অন্তত দু’বার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালে নিজের কান কেটে ফেলার পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ভিনসেন্টকে। তার পরেই মদ বন্ধ হয়ে যায় তার। দেখা দেয় উইথড্রয়াল সিনড্রোম। চিকিৎসকদের মত, এই অ্যালকোহল প্রত্যাহারের ফলেই স্মৃতি নষ্ট হতে শুরু করে ভিনসেন্টের। আলু ক্ষেতের চাষীদের মুখ আর মনে পড়ছে না তখন ভিনসেন্টের। মন খারাপ হচ্ছে আরো। একাধিকবার গভীর ডিপ্রেসনে চলে গিয়েছিলেন শিল্পী, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরাও।
যদিও চিকিৎসকদের এই দলটি ভিনসেন্টের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘সিজোফ্রেনিয়া’ এবং ‘পোরফেরিয়া’ রোগদুটির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছেন। যদিও কোনো কোনো চিকিৎসকের সন্দেহ করা মৃগী রোগের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া হয়নি।
‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গত সোমবার প্রকাশিত গবেষণায় গবেষকরা বলেছেন যে, সম্ভবত ‘ফোকাল এপিলেপসি’তেও ভুগেছিলেন ভিনসেন্ট। এর ফলে উদ্বেগ, বিভ্রান্তি এবং হ্যালুসিনেশনের বিভিন্ন স্তরে সমস্যা তৈরি হতে পারে শিল্পীর। ভ্যান গগের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অত্যধিক মদ্যপান, অপুষ্টি, প্রায় না ঘুমানো এবং মানসিক ক্লান্তি। এগুলি অকথ্য চাপ তৈরি করতে পারে মস্তিষ্কে।
যদিও ভ্যান গঘের অসুস্থতা এবং আত্মহত্যার একদম সঠিক কারণ কী, সেই নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করতে চাননি গবেষকেরা। এই অনুসন্ধান আরো চলিয়ে নিতে চান তারা। তারপর আরো অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে গবেষকদলের। আদৌ আত্মহত্যা, না খুন! এই বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দিক গবেষণার পর।
কয়েকজন গবেষকের স্থির বিশ্বাস, খুন করা হয়েছিল ভ্যান গগকে। কিন্তু কেন তাদের মনে এই ভাবনা। তাও জানা যাবে বিস্তর গবেষণার পর। তবে তারায় মিশে যাওয়া একটা মানুষের মনের সন্ধান পাওয়া কতটা সহজ হবে গবেষকদের পক্ষে! সে আশাতেই বিশ্ববাসী। শীঘ্রই হয়তো জানা যাবে এই শব প্রশ্নের উত্তর।
Post a Comment