বহু নিখোঁজের পরও রহস্যময় টানে হিমাচলের ‘মৃত্যু’ উপত্যকায় ছোটে মানুষ

ODD বাংলা ডেস্ক: হিমাচল প্রদেশের পার্বতী উপত্যকা। এ উপত্যকার মধ্য দিয়ে বিপাশা নদীর সঙ্গে পার্বতী নদীর মিলিত ধারাপ্রবাহ বয়ে গেছে। পাহাড় ওবং জঙ্গলে ঘেরা এ উপত্যকা ভারতের অন্যতম সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র।

হিমালয়ের কোলে থাকা এ উপত্যকায় তুষার-ঢাকা পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। বছরের পর বছর প্রকৃতির টানে এ অঞ্চলে ভিড় জমান বহু পর্যটক। তবে সৌন্দর্যের জন্য যেমন বিখ্যাত তেমনই দুর্নাম রয়েছে এ উপত্যকার। ‘ডেথ ভ্যালি’ বা মৃত্যু উপত্যকা নামে কুখ্যাতি রয়েছে পার্বতী উপত্যকার।

বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক এ উপত্যকায় ঘুরতে এসে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার কারণে এর আরেক নাম ‘ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’। পার্বতী উপত্যকার রাস্তাগুলো এর প্রমাণ। এ উপত্যকার আশপাশে বি‌ভিন্ন বাড়ির দেওয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, শৌচালয়, সবই নিখোঁজ মানুষদের পোস্টারে ভরা।

বছরের পর বছর ধরে মৃত্যু উপত্যকায় পর্যটক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে ছিল দিল্লির ৩২ বছর বয়সী ধ্রুব অগ্রবালের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা।

২০২১-এর ৯ নভেম্বর উপত্যকার সৌন্দর্য দেখাতে পরিবারকে ভিডিও কল করেন ধ্রুব। কিন্তু দুর্বল নেটওয়ার্কের জন্য ভালো করে কথা বলা যাচ্ছিল না। হঠাৎ পরিবারের লোকজন দেখেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ধ্রুবের হাত থেকে তার ফোনটি পড়ে গেল। এরপর থেকে ধ্রুবের গলার আওয়াজ আর শুনতে পাননি তার পরিবারের লোকজন। সেদিন থেকে নিখোঁজ ধ্রুব।

ধ্রুবের মতো পার্বতী উপত্যকায় ঘুরতে এসে নিখোঁজ হন জাস্টিন আলেকজান্ডার শেটলার। ২০১৬ সালে ৩৫ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা জাস্টিন শুধুমাত্র ভ্রমণের নেশায় ঐ উপত্যকায় এসেছিলেন। গুটিকয়েক জামাকাপড় এবং একটি বাঁশি নিয়ে বাইকে চেপে উপত্যকায় পৌঁছান জাস্টিন।

পার্বতী উপত্যকায় গিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ একটি গুহায় বসবাস করেন জাস্টিন। সেখানে এক সাধুর সঙ্গেও আলাপ হয় তার। সাধুর সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটিয়ে একটি দূরবর্তী হ্রদের উদ্দেশে রওনা দেন জাস্টিন। আর এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। তাকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয়দের মতে জাস্টিন উপত্যকার ‘জাদুকরী ক্ষমতা’য় এতটাই মোহিত হয়ে পড়েন যে, তিনি নিজেই নিজের লিঙ্গ কেটে ফেলেন।

জাস্টিন নিখোঁজ হওয়ার পর স্থানীয় পুলিশ তার সঙ্গে থাকা সাধুকে গ্রেফতার করে। তবে পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে, ওই সাধুকে রহস্যজনকভাবে তার সেল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর সাড়ে পাঁচ বছর পর কেটে গেলেও জাস্টিনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত তিন দশকে এ এলাকায় নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা প্রায় দু’ডজন। তবে স্থানীয়দের মতে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। তবুও পর্যটকদের এ উপত্যকায় যেতে উৎসাহের কমতি নেই।

সৌন্দর্য ছাড়াও আরো অনেক কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবছর এ উপত্যকায় ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের বহু মানুষ। আর তা হলো বিভিন্ন ধরনের মাদকের চাষ এবং মাদক পার্টি।

স্থানীয়দের দাবি, এ উপত্যকায় নাকি পাওয়া যায় এক বিশেষ প্রজাতির মাদক। এটি বিশ্বের অন্যতম দামি মাদক এবং কাছের মানালা গ্রামের নাম অনুসারেই এর নামকরণও করা হয়েছে। এ মাদকের রমরমাও উপত্যকা থেকে পর্যটকদের উধাওয়ের অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

কসোলের এক স্থা‌নীয় সাংবাদিকের মতে, এখানে যারা আসেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই এক বিশেষ ধরনের জনপ্রিয় মাদকের খোঁজে এ উপত্যকায় আসেন। পাশাপাশি এ উপত্যকায় পাহাড়গুলি খাড়া এবং যাতায়াতের রাস্তা খুব সরু। তাই পাহাড় চড়তে গিয়েও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন বলে মনে করা হয়। এ-ও মনে করা হয়, পার্বতী উপত্যকার পাহাড় এবং জঙ্গলে থাকা অনেক হিংস্র প্রাণীর শিকার হতে হয়েছে পর্যটকদের।

বহু পৌরাণিক কাহিনিও শুনতে পাওয়া যায় এ উপত্যকাকে ঘিরে।

প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুসারে, শিব এ উপত্যকায় প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন। নাগা সাধুর রূপ ধারণ করে তিনি সেখানে ধ্যানমগ্ন হন। বহু যুগ পর ধ্যানভঙ্গের পর শিব তার চোখ খুলে এ উপত্যকার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যান। স্ত্রী পার্বতীর নামানুসারে এ উপত্যকার নামকরণ করেন পার্বতী উপত্যকা।

এ-ও বলা হয় যে, শিব এবং পার্বতী এ স্থানটির সৌন্দর্য দেখে এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, তারা এখানে আরো কিছু সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিংবদন্তি অনুসারে, শিব-পার্বতী এ অঞ্চলে প্রায় ১১০০ বছর এক সঙ্গে কাটান।

মাটি থেকে ১৭৬০ মিটার উচ্চতায় থাকা শিব-পার্বতীর বাসস্থান দেখতে প্রতিবছর প্রচুর পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। মনে করা হয়, এ উপত্যকার এক জায়গায় হাঁটতে হাঁটতে এক বার পার্বতী তার একটি কানের দুল হারিয়ে ফেলেন। শিব তার অনুচরদের এ দুলটি খোঁজার নির্দেশ দিলেও তারা এটি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। এর ফলে শিব ক্রুদ্ধ হন এবং বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় দেখা দেয়।

শিবকে শান্ত করার জন্য শেষনাগ ফুটন্ত জলের প্রবাহের মধ্যে থেকে এ সোনার দুল খুঁজে আনেন এবং তা পার্বতীকে ফিরিয়ে দেন। তখন থেকে ঐ জায়গার নাম হয় মানিকরণ।

পার্বতী উপত্যকার অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা হলো ক্ষীরগঙ্গা। এ জায়গা বিদেশিদের কাছে খুব প্রিয়। মনে করা হয়, শিব এবং দেবী পার্বতীর ছোট ছেলে কার্তিক এখানে হাজার বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন। তখন মাঝেমধ্যেই শিব-পার্বতী তাদের ছেলেকে দেখতে আসতেন। এখানে বসে পার্বতী পরিবারের জন্য ক্ষীর বানিয়েছিলেন বলে এ জায়গার নাম ক্ষীরগঙ্গা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সেই ক্ষীরের কারণেই এখানে গঙ্গার রং সাদা।

ক্ষীরগঙ্গার আশপাশের এলাকাতে ইসরায়েলের বাসিন্দাদের আনাগোনা বেশি। বেশ কিছু জায়গায় কলোনিও তৈরি করেছে ইসরায়েলের বাসিন্দারা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.