ভয়ানক মৃত্যু উপত্যকা, ২৩ টি পারমানবিকে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল নিজেই

 


ODD বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই এর পরতে পরতে রহস্যাবৃত। সেই থেকেই মানুষ কৌতূহলবসত বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব রহস্যের কিনারা করছেন। এখনো কিছু স্থান আছে যেগুলো সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি তথ্য পাননি বিজ্ঞানীরা। পাহাড়, পর্বত, আগ্নেয়গিরি, বন, সাগরসহ কতকিছু যে আছে এই পৃথিবীতে। এসবের মধ্যে রয়েছে ভয়ংকর সুন্দর কিছু মৃত্যু উপত্যকাও।

উপত্যকা হচ্ছে দুইটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত সমতল হতে পারে বা অসমতল হতে পারে , ঢালু, প্রশস্ত ভূমিক্ষেত্র। এর ভেতর দিয়ে নদী প্রবাহিত হতে পারে আবার না-ও পারে। পর্বতের শীর্ষ থেকে যখন বরফ গলা জল বা বৃষ্টির জলের স্রোত যখন পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে দ্রুতবেগে নেমে আসে, তখন পাহাড়ের শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে, হাজার হাজার বছর ধরে উপত্যকার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হিমবাহ অর্থাৎ বরফের নদী পর্বতের শীর্ষ থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামার সময় উঁচু নিচু শিলাপাথরগুলোকে সরিয়ে চূর্ণ করে সমতল মাটির স্তর তৈরি করে এবং ফলে উপত্যকার জন্ম হয়। আবার কখনো কখনো কোনো নদী গতিপথ বদলালে এর পুরাতন অববাহিকাটি উপত্যকার জন্ম দেয়।


তবে এই সুন্দর উপত্যকাই যখন মৃত্যু ফাঁদ, তখন এটিকে বলাই যায় ভয়ানক সুন্দর। যেটি দূর থেকেই উপভোগ করা ভালো। কাছে গেলে প্রাণটা বিসর্জন দিতে হতে পারে। তেমনই কয়েকটি মৃত্যু উপত্যকার কথাই জানাবো। চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বের অন্যতম সুন্দর এই জায়গাগুলো কীভাবে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করে আছে।


বিকিনি আটোল মার্শাল আইল্যান্ড


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিকিনি আটোল ‘মার্শাল আইল্যান্ড’ নামে অধিক পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই বিকিনি আটোল বেশি আলোচিত তার পারমাণবিক ইতিহাসের কারণে। এই দ্বীপেই চল্লিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। একসময় এই দ্বীপ হয়ে ওঠে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ পরীক্ষা কেন্দ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বীপে ২৩টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।


১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে এমন এক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, যা হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও ১,১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। এমন ক্রমাগত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এ দ্বীপ হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। এখনও এই দ্বীপের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনেক বেশি। এখানকার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তায় দীর্ঘসময় থাকলে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যান্সারও।


ভ্যালি অফ ডেথ, কামচাটকা, রাশিয়া


পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানের মধ্যে এটি একটি। রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে এ মৃত্যু উপত্যকার অবস্থান। রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তে সাইবেরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত আগ্নেয় পর্বতময়, তুষারাচ্ছন্ন উপদ্বীপ কামচাটকায় অনেকগুলো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে। এই উপদ্বীপের পূর্বাংশে রয়েছে কেহিন্নাইক আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরির পাদদেশেই তৈরি হয়েছে এ মৃত্যু উপত্যকা।


১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে এ মৃত্যু উপত্যকা আবিষ্কারের পর থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত রিজার্ভ কর্মীরা নিয়মিতভাবে এলাকাটি পরীক্ষা করে দেখেন। তারা প্রায় ২০০টি মৃত প্রাণী এবং পাখি সংগ্রহ করেন। মৃত এসব প্রাণীদের মধ্যে ছিল ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৫ টি প্রজাতির পাখি এবং নানাপ্রকার কীটপতঙ্গ। এমনকি রিজার্ভ কর্মীদের সঙ্গে যেসব কুকুর সেখানে গিয়েছিল, সেসব কুকুরও মারা যায়।


এখানকার মৃত্যু যাত্রা অনেকটা চক্রের মতো চলতে থাকে। বসন্তের সময় এক প্রকার ছোট চড়ুই পাখি মারা যেতে থাকে। মৃত পাখিদের দেহের গন্ধে আকৃষ্ট হয় শিয়াল, ভলভেরিন, ভালুক, কাক এবং গোল্ডেন ঈগল এবং খাদ্যের সন্ধানে এখানে পাড়ি জমায়। তবে এই লোভই তাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। এখানে এসে একে একে সবাই মারা যায়।



গবেষণায় দেখা যায়, মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠার মূল কারণ এখানকার বিষাক্ত বাতাস। আগ্নেয়গিরির বিষাক্ত গ্যাসই এখানকার বাতাসকে এতটা বিষাক্ত করে তুলেছে। এই বিষাক্ত গ্যাসের কারণে এখানে জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব। প্রধানত হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাসের উপস্থিতিই এখানকার বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলেছে।


কারো কারো মতে উপত্যকায় গ্যাসের উপাদানগুলো আংশিক পক্ষাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, এর ফলে প্রাণীগুলো নড়াচড়া বা চলাফেরা করতে পারে না। তবে এটি এখনও প্রমাণিত হয়নি। গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরাও এই গ্যাসে আক্রান্ত হন। আর এর প্রভাবে তাদের মাথা ব্যথা, দুর্বলতা, জ্বর, ঝিমুনি ভাব দেখা দেয়। তবে তারা উঁচুস্থানে যেখানে বায়ু প্রবাহ আছে সেখানে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের প্রভাব কমে যায়।


আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞরা অনেক নমুনা এবং বিশ্লেষণ সংগ্রহ করেছেন। তাদের মতে উপত্যকাটি এই বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনের পথে অবস্থিত। এলাকাটি সালফারের পুরু স্তরে ভরাট। তবু কামচাটকার ভ্যালি অব ডেথ তার অপরূপ সৌন্দর্যে মৃত্যুর হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে।


ডেথ ভ্যালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র


রহস্যপ্রেমী মানুষদের কাছে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ডেথ ভ্যালি খুবই পরিচিত এক নাম। পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় এই স্থানটির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। কিন্তু এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান। ১৯৭২ সালে এখানকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল প্রায় ২০০ ফারেনহাইট। ডেথ ভ্যালির এ তাপমাত্রা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিকেও হার মানায়। তবুও ডেথ ভ্যালি দেখতে প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ সেখানে ভিড় করেন।


নানা রহস্য ও বিস্ময়ের দেখা মিলে এই ডেথ ভ্যালিতে। ডেথ ভ্যালিতে চলন্ত পাথর দেখা যায়। যে পাথরগুলোকে দেখলে মনে হয় এরা নিজেরাই নিজেদের স্থান পরিবর্তন করেছে। পাথরগুলোকে অবশ্য চলমান অবস্থায় কেউ কখনো দেখেনি। বালুর উপর রেখে যাওয়া ছাপ থেকেই আন্দাজ করে নেয়া হয়েছে। কয়েকশ পাউন্ড ওজনের এসব ভারি পাথরগুলো কীভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় সে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।


ডেথ ভ্যালির রহস্যময় এই পাথরগুলো নিয়ে আছে নানান কল্পনা। কেউ কেউ মনে করেন, এখানে এক বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, যার প্রভাবে পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করে। আবার কারো কারো ধারণা, এগুলো আসলে এলিয়েনদের কারসাজি।


দ্য দানাকালি ডেজার্ট


‘দ্য দানাকালি ডেজার্ট’ ইথিওপিয়ার ইরিত্রিয়ায় অবস্থিত। ইথিওপিয়ার সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এ মরুভূমি পৃথিবীর বিপজ্জনক পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভূতাত্ত্বিক নানা প্রতিকূল পরিবেশের জন্য এ মরুভূমিকে বলা হয়ে থাকে ‘এলিয়েনদের স্থান’। কেননা সাধারণ মানুষদের পক্ষে এ মরুভূমিতে থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার স্থানগুলোর একটি এটি। এখানকার তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এ মরুভূমির মাঝে নদীর মতো বয়ে গেছে লাভার হ্রদ। বিশাল মরুভূমির মাঝে নানা জায়গা থেকে ক্রমাগত লাভা নির্গত হয়। লাভার সঙ্গে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত গ্যাস। আর এই বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে বিষাক্ত করে তোলে এ মরুভূমির পরিবেশ।


তবু পর্যটকের অভাব নেই এ মরুভূমিতে। দানাকালি মরুভূমির সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। তবে চাইলেই যে কেউ একা যেতে পারবেন না এখানে। ভয়ংকর সুন্দর এ মরুভূমি উপভোগ করতে চাইলে সঙ্গে অভিজ্ঞ গাইড নিয়ে যেতে হবে। গাইড ছাড়া এ মরুভূমিতে পা রাখার অনুমতি দেবে না ইথিওপিয়া সরকার।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.