এক নারীর রুমালে লেখা চিঠির কারণে পতন হয়েছিল যে সভ্যতার

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সিন্ধু সভ্যতা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম এক সভ্যতা। বিশ্বের আধুনিকতার উৎকর্ষ শুরু হয়েছিল এই সভ্যতা থেকেই, এমনটা ধারণা করেন অনেক ইতিহাসবিদ। সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা (৩৩০০-১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ; পূর্ণবর্ধিত কাল ২৬০০ – ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের। এই সভ্যতার পতনের ফলে আমূল পরিবর্তন এসেছিল ভারতবর্ষে। এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত ইতিহাসের অনেক পরতে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার ছিল বেলুচিস্তান থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় সমগ্র পাকিস্তান, আধুনিক ভারতের গুজরাত, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব রাজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামিক শাসকদের রমরমা শুরু হ‌‌ওয়ার কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকদের একাংশ সিন্ধুরাজ দাহিরের পতনকে দায়ী করেন। তাদের মতে সপ্তদশ বর্ষীয় মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে এই হিন্দু রাজা যদি পরাজিত না হতেন, তবে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যরকম হতেও পারত। রাজা দাহিরের পতন নিয়ে বেশকিছু আবেগপূর্ণ লেখা পাওয়া যায়। তার রাজ্যে প্রজাদের একাংশের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল, যারা যুদ্ধের সময় বিদ্রোহ করে কাসিমকে সমর্থন করে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অষ্টম শতাব্দীর প্রথমদিকে সিন্ধু প্রদেশের এই রাজার পতনের মূল কারণ ছিল অন্য। এক পিতৃহীন অসহায় কন্যার দুঃখের ঘটনা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।


অনেক আগে থেকেই ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় আরব বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করত। এমনকি বেশ কিছু আরব বণিক পরিবার নিয়ে তৎকালীন সিংহলে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে তৎকালীন সিংহল রাজের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। ইসলাম ধর্ম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে সিংহলে বসবাসরত আরবরা এই ধর্ম গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে বেশ কিছু মসজিদ গড়ে ওঠে। পুরুষরা নিয়ম করে প্রতি বছর সমুদ্র পেরিয়ে মক্কায় যেতেন হজ করার জন্য।


আবুল হাসান ছিলেন সিংহলে বসবাসরত আরবদের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান ও সম্পদশালী বণিক। ৭০৭ সালে হজ করার উদ্দেশ্যে তিনি একটি জাহাজ নিয়ে সিংহল থেকে রওনা দেন আরবের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই জাহাজ বা আবুল হাসান কেউই আর মক্কায় গিয়ে পৌঁছাননি। দীর্ঘ এক বছর জুড়ে চারিদিকে খোঁজখবরও করা হয়, কিন্তু কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।


এই ঘটনার কথা সিরিয়ার তৎকালীন উমাইয়া খলিফার কানে পৌঁছায়। তিনি পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য জুবায়ের নামে এক আরব তরুণকে সিংহলে পাঠান। কিন্তু তাও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আবুল হাসান বা তার সঙ্গী সাথীদের। এ সময় অভিভাবকহীন একদল আরবি নারী সিংহল থেকে আরবে চলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাদের এই ইচ্ছার কথা জেনে জুবায়ের জাহাজ প্রস্তুত করে তাদের আরবে ফিরিয়ে আনবেন বলে ঠিক করেন। সেই কথা শুনে সিংহল রাজ খলিফাকে উপহার স্বরূপ এক জাহাজ ভর্তি ধনরত্ন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। দুটি জাহাজ নিয়ে জুবায়ের আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ঐতিহাসিকরা পরে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে প্রমাণ পান তাদের এই জাহাজ সিন্ধু প্রদেশের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিল সেই সময়ের রাজা দাহিরের সেনাবাহিনী স্থানীয় মেট উপজাতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই জাহাজ দুটি আটক করে ও লুটপাট চালায়।


৭১১ সালের কথা। সিন্ধু সেনাদের হাত থেকে আবুল হাসানের কন্যা ও জুবায়ের সহ মাত্র কয়েকজন পালাতে পেরেছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে এক পুরনো ভাঙ্গাচোরা দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নেয়। কথিত আছে আবুল হাসানের অবিবাহিত মেয়ে সহ বাকি নারীরা রুমালের ওপর তাদের দুঃখের কথা লিখে জুবায়ের হাতে তুলে দেয়। সাহায্য লাভের আশায় খলিফার বিশেষ দূত জুবায়ের কোনোরকমে সিন্ধু সোনার চোখে ধুলো দিয়ে অনেক কষ্টে বসরায় এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন।


বসরার শাসক ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মুসলিম নারীদের এই দুর্দশার কথা জেনে প্রচন্ড ক্ষেপে যান তিনি। এমনিতেই তার সঙ্গে সিন্ধুরাজ দাহিরের পুরনো শত্রুতা ছিল। তিনি ঠিক করেন উমাইয়া খলিফার সাহায্য নিয়ে সিন্ধুরাজকে পরাজিত করে মুসলিম নারীদের উদ্ধার করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ, জুবায়েরের সঙ্গে নিজের সেনাপতি তথা সপ্তদশ বর্ষীয় ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিমকে দামাস্কাসে খলিফার কাছে পাঠান। রুমালের ওপর লেখা মুসলিম রমণীদের করুণ চিঠি পড়ে খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালেক তৎক্ষণাৎ সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। তার মূল সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধরত থাকায় এই অভিযানের জন্য কেবল মাত্র ৫ হাজার সেনা দিতে পেরেছিলেন খলিফা।


তবে জুবায়ের ও কাশেম দামাস্কাস এবং বসরায় প্রচার চালিয়ে অনেক সাধারন মানুষকে সেনাবাহিনীর অন্তর্গত করে। তারা সবাই মুসলিম রমণীদের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও হাজারে হাজারে সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আবেগের বশবর্তী হয়ে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে বসরার শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মাকরানের শাসক মুহাম্মদ ইবনে হারুনের সঙ্গে পরামর্শ করে কুড়ি সদস্যের এক প্রতিনিধি সিন্ধুরাজ দাহিরের কাছে পাঠান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার পর সিন্ধুরাজ যদি ভালোভাবে আটকে পড়া মুসলিম রমণীদের ফেরৎ দিয়ে দেয় তাহলে তারা আর অভিযান চালাবে না। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিশজন সদস্যের প্রতিনিধিদলের মাত্র দুজন প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিল। বাকি ১৮ জনকে সিন্ধু সেনারা রাজদরবারেই হত্যা করে।


স্বাভাবিকভাবেই প্রবল ক্ষুব্দ হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৭১১ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ১৭ বছর বয়সী কাসিম বীরত্ব এবং সুনিপুণ যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে দাহিরকে পরাজিত করেন। ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে দাহির রাজধানীর দেবলের দুর্গের আগেই কাসিমের বাহিনীকে আটকে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে কাসিমের দুরদর্শী বুদ্ধির কাছে সফল হননি দাহির। কাসিম সেনাবাহিনী নিয়ে টানা ছয় মাস দেবল দুর্গ অবরোধ করে রাখেন।


বাধ্য হয়ে দাহির রাওয়াল দুর্গে পালিয়ে যান। এই পর্যায়ে সিন্ধুর অত্যাচারিত নিপীড়িত বৌদ্ধ, মেট, জেঠ-দের মতো সম্প্রদায়ের মানুষরাও কাসিম বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। ৭১২ সালের ১২ জুন রাওয়াল দুর্গের পতন ঘটে এবং রাজা দাহির নিহত হন। তার স্ত্রী পুত্র সন্তানকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। দাহিরের সঙ্গে সঙ্গে পতন হয় সিন্ধু সভ্যতার।


তবে কেউ বলেন মহামারীতেই গ্রাস করেছিল সিন্ধু সভ্যতা। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগই ধ্বংসের কারণ। অনেকে বলেন যাযাবর আর্যদের আক্রমণ শেষ করেছিল সিন্ধু সভ্যতা। জলবায়ুর পরিবর্তনকেও দায়ী করা হয়। ৫,৭০০ বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হয়। এখনো বিজ্ঞানীরা এর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে চলেছেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.