কিসের আশায় সাগরতলে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন ক্লিওপেট্রা?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার মিশরের পরতে পরতে রয়েছে রহস্য। বিশেষ করে আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগেকার তৈরি পিরামিড আর মমি তৈরির কৌশল। ফারাওরাও ছিলেন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে নারী ফারাওরা। ফারাও হচ্ছে মিশর শাসনের ভার যাদের হাতে ছিল অর্থাৎ রাজা। মিশরের শাসক বা রাজাদেরকে বলা হয় ফারাও। মিশরের রাজা বা ফারাওদের কথা বললে তৎক্ষণাৎ আমাদের চোখে নীল আর সোনালি মুকুট পরে সিংহাসনে বসে থাকা একজন পুরুষের অবয়বই ভেসে ওঠে। যদিও মিশরের শাসকদের বেশিরভাগই পুরুষ ছিলেন।

তারপরও ফারাও শব্দটা বিরলভাবে নারী শাসকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হত। মিশরের ইতিহাসে নারী ফারাওরা বেশখানিকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে। মিশরের সমৃদ্ধিতে তাদের অবদানও অনেক। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মাঝে সাত জন ছিলেন নারী। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সমালোচিত ছিলেন ক্লিওপেট্রা। সৌন্দর্য আর বুদ্ধিমত্তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এই নারী। সারা বিশ্বের অভিজাত পুরুষ, রাজা, এমনকি সাধারণ পুরুষেরাও পাগল ছিল ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ক্লিওপেট্রা তার সৌন্দর্যের অসৎ ব্যবহার করেছেন। আবার অনেকের মনে খুবই অসহায় নারী ছিলেন এই ক্লিওপেট্রা।


আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মিশর জয়ের পর তার সেনাপতি টলেমি মিশর শাসন শুরু করেন। ক্লিওপেট্রা টলেমির বংশধর। ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান। তবে তার আগে টলেমি মারা গেলে এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার কে হবেন সে নিয়ে চারদিকে আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে তিনি বেছে নেন ক্লিওপেট্রা ও তার পুত্র টলেমিকে। ক্লিওপেট্রার বাবা সপ্তম টলেমির মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা তার ছোট ভাই টলেমি ত্রয়োদশের সঙ্গে যৌথভাবে মিশর শাসন শুরু করেন। ধারণা করা হয় ক্লিওপেট্রা টলেমি ত্রয়োদশকে বিয়েও করেন। ক্লিওপেট্রা মাত্র ৩৯ বছর বেঁচে ছিলেন যার ২২ বছর তিনি মিশর শাসন করেন। এই শাসন কালেই তিনি মিশরকে প্রগতী এবং উন্নতির শিখরে নিয়ে যান।



এর মধ্যেও নাকি নিজের আখের গোছাতে ভোলেননি এই রহস্যময় নারী। কথিত আছে মিশরীয় রানি ক্লিওপেট্রার সাগরতলে গুপ্ত রাজপ্রাসাদ ছিল। প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর পর ভূমধ্যসাগরের গভীরে পাওয়া যায় এই প্রাসাদের অস্তিত্ব। মাত্র ৩৯ বছরের জীবনে ক্লিওপেট্রা তার সৌন্দর্য, মোহনীয়তা, ক্ষমতা আর প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী জীবন যাপন নিয়ে প্রাচীন মিশরের আলোচিত এক নাম ছিল। তাকে সর্বকালের সেরা নারী শাষকদের অন্যতম বলেও দাবী করেন কেউ কেউ। ফলে নারী শাষককে নিয়ে মিথ আর লোককথার ফুলছড়ি হরহামেশায় শোনা যায়। সাগরতলে গুপ্ত রাজপ্রাদ সেই মিথের অংশ কিনা, সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছর।


মিশর কাঁপানো এই ক্ষমতাধরকে নিয়ে ইতিহাস বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার তাকে ঘিরে লিখেছেন শত শত গল্প, উপন্যাস, নাটক। মঞ্চে উঠেছে তার ট্র্যাজেডি। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্র’, জর্জ বার্নাড শর ‘সিজার ক্লিওপেট্রা’, জন ড্রাইডেনের ‘অল ফর লাভ’, হেনরি হ্যাগাডের ‘ক্লিওপেট্রা’। শুধু তার সময়েই নয়, এখনো ইতিহাস কাঁপানো এ কিংবদন্তী নারী বহু পুরুষের কাছেও আকাঙ্খিত।


ক্লিওপেট্রার বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্যের কথা তখন রাজ্য থেকে রাজ্যে ছড়িয়ে গেছে। লোকমুখে সে কথা অ্যান্টনির কানেও পৌঁছেছিল। অ্যান্টনি চাইলেন যে কোনোভাবেই হোক ক্লিওপেট্রার সঙ্গে দেখা করবেন। রোম থেকে অ্যান্টনি এলেন ক্লিওপেট্রার রাজকীয় প্রাসাদে। এ মিথ কে না জানে, প্রথম দেখাতেই ক্লিওপেট্রার মন জিতে নেন অ্যান্টনি। অবশ্য কারও কারও মতে মিশর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান রোমান বীর অ্যান্টনি। প্রেমের আগুনে তখন পুড়ছেন দুজনেই। এদিকে হিসাব বেশ পাল্টে গেছে। ক্লিওপেট্রা শুধু প্রেমই পেলেন না, সঙ্গে পেয়েছেন সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন।


ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে সেই কৌতূহলের শেষ নেই আজও। এখনো আগ্রহীরা খোঁজ করেন তার চিহ্নটুকু। ক্লিওপেট্রা এবং তার শাসন পদ্ধতি সবই যেন রহস্যময়। ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ এবং সাম্রাজ্যের বড় অংশ এখন ঘুমিয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের নিচে। গ্রিক ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর লেখায় জানা যায় ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ছিল মিশরের অ্যান্তিরহোদোস দ্বীপে। এই দ্বীপের অস্তিত্ব বহুদিন আধুনিক পৃথিবী জানতে পারেনি। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদসহ এই দ্বীপটিকে গ্রাস করে নিয়েছে ভূমধ্যসাগর। প্রায় এক হাজার ছয়শ বছর আগে ভূমিকম্প ও সুনামিতে তলিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘরও। তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় সাগরতলে গুপ্ত রাজপ্রাস ছিল না রানির। এটা কালের পরিক্রমায় ধ্বংস হয়েছে। সাগর তলে ডুবে গেছে।



মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার একদল ডুবুরি হঠাৎ করেই পেয়ে যান ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এই ডুবুরি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সের প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্র্যাঙ্ক গর্ডিও। ১৯৯০ থেকে তারা সাগর চষে বেড়ান শুধু ক্লিওপেট্রার হারিয়ে যাওয়া সাম্রাজ্যের খোঁজে। ১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরের গভীরে পাওয়া যায় ক্লিওপেট্রার প্রাসাদের অস্তিত্ব। কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে বলা হলো, এই প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল রানির জন্মেরও ৩০০ বছর আগে।


জলের অতলে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন নগরী, লাল রঙের মিশরীয় গ্র্যানাইটে তৈরি দেবী আইসিসের মূর্তি ক্লিওপেট্রার পরিবারের সদস্যদের মূর্তি প্রচুর অলঙ্কার বাসনপত্র এবং স্ফিংক্সের দুটি মূর্তি। রয়েছে সে সময়ের মুদ্রা থেকে শাসকদের মূর্তি। ডুবুরিরা তুলেও এনেছেন মিশরের শেষ রানি ক্লিওপেট্রার রাজ্যের অনেক মূর্তি, মুদ্রা ইত্যাদি। প্রত্নতত্ত্ববিদ গর্ডিও ও তার দল ক্লিওপেট্রা এবং তার প্রেমিক জুলিয়াস সিজারের ছেলে সিজারিয়ানের মাথার পাথরের মুকুট উদ্ধার করে। সাগরের নিচে প্রায় এক হাজার ৪০০ বছরের কাদা মাখা ইতিহাসের অমূল্য এই দলিলের বেশ কিছু নিদর্শন তুলে আনা হয়েছে জনসমক্ষে। তবে নানান প্রতিকূলতার জন্য বেশির ভাগই রয়ে গেছে জলের নিচে।


প্রথমে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা বেশ কৌতূহলী হয়ে ছিলেন এই গুপ্ত প্রাসাদ নিয়ে। পড়ে অবশ্য বহু পরীক্ষা নিরিক্ষার পর জানা যায়, এই প্রাসাদ রানি তৈরি করেন নি। তার গুপ্ত কোনো প্রাসাদ বা সাম্রাজ্য ছিল না। বরং তার বাবার প্রাসাদে থেকেই তিনি ২২ বছর শাসন করেছেন তার সাম্রাজ্য। সবচেয়ে বেশি মিশরের উন্নতি ঘটিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রাই। এজন্য প্রজাদের কাছে প্রিয় ছিলেন তিনি। তবে বর্তমান বিশ্বেও আলোচিত এই রানির শেষটা ছিল খুবই করুণ। মৃত্যু নিয়েও রয়েছে নানান বিতর্ক। সেই সঙ্গে সমাধিরও খোঁজ মেলেনি আজো। কেউ বলেন সাপের কামড়ে, কেউ বলেন বিষ পানে আত্মহত্যা করেছিলেন ক্লিওপেট্রা। তার সমাধি অই একই ভূমিকম্প আর সুনামিতে হারিয়ে গেছে সাগরতলে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.