ভক্ষক যখন রক্ষক, মাসাইদের সিংহ রক্ষার পেছনের রহস্য

ODD বাংলা ডেস্ক: আফ্রিকান উপজাতিদের মধ্যে মাসাইদের কথা অনেকেই জানেন। যাদের কাছে এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। এখনো যেখানে যেতে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম পথ। তাদের গন্ডির বাইরে যে এতো বড় পৃথিবী রয়েছে। রয়েছে মানুষ আর আলো ঝলমলে এক জগত। তার কিছুই জানেন না এই উপজাতির মানুষগুলো। 

কেনিয়া এবং তানজানিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে এদের বাস। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর এ অঞ্চল ক্রমেই নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠছে আকর্ষণের কেন্দ্র। এ পরিস্থিতিতে তারা কতদিন নিজেদের শেকড় ধরে রাখতে পারবে, তা বলা যায় না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাসাইরা প্রাথমিকভাবে বাস করতো দক্ষিণ সুদানে। তারা বরাবরই যাযাবর জীবনযাপন করে।

ষোড়শ শতাব্দীতে উর্বর জমির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে তারা বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থানে পৌঁছায় আঠারো বা উনিশ শতাব্দীর দিকে। সেই সময় এ অঞ্চলে আগে থেকেই অন্য গোষ্ঠীর বাস ছিল। তাদের সঙ্গে কিছুটা কলহ, কিছুটা সমঝোতা মিলিয়ে শেষে তারা মিলেমিশে বসবাস শুরু করে।

মাসাই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীতে। এই সময়ে তারা বিখ্যাত রিফট ভ্যালির প্রায় সবটুকু অংশ জুড়েই নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে নেয়। এখন কেনিয়া এবং তানজানিয়া জুড়ে মাসাইদের জনসংখ্যা এক মিলিয়নের কাছাকাছি। বনের পশু শিকার করেই তাদের খাদ্যের যোগান হত। সিংহ ছিল শিকারের প্রধান পছন্দ।   

এক দশক আগের কথা। ২০০৭-২০০৮ সাল। পরিবেশবিদদের অন্যতম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেনিয়া। সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে আফ্রিকার এই দেশ থেকে মুছে যাবে সিংহের অস্তিত্ব। তবে সেই আশঙ্কা বাস্তবায়িত হয়নি। গত তিন বছরে সিংহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আজ সেই সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। আর এই পরিবর্তনের পিছনেই রয়েছে ‘সিংহ শিকারি’-দের অনস্বীকার্য অবদান।

হ্যাঁ, শিকারিরাই এখন সিংহের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন কেনিয়ায়। একটু তলিয়ে বলা যাক। মাসাই জনগোষ্ঠীর নাম মোটামুটি সকলেরই জানা। মূলত কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছেন এই জনজাতির প্রায় ১০ লাখ মানুষ। প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়েও আজ প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরেই বসবাস তাদের। বেঁচে থাকা মূলত অরণ্যকে কেন্দ্র করেই। গৃহপালিত পশুর মাংসের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর মাংসও তাদের খাদ্য তালিকার একটা বড়ো অংশ। তবে সিংহ শিকারের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ অন্য এক কারণ। না কোনো চোরাশিকার নয়। দৈনন্দিন জীবনে সিংহের সঙ্গে সংঘাতই এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে তাদের সম্পর্ক।

তবে বহু যুগ ধরে আফ্রিকার ভূখণ্ডে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর কারণে হঠাৎ করেই কেন অবলুপ্ত হয়ে বসল সিংহের জনসংখ্যা? আসলে এর পিছনেও রয়েছে সভ্যতার হাত। ক্রমশ সাধারণ মানুষের জনবসতি আর শহরের বাড়বাড়ন্ত সংক্ষিপ্ত করে আনছে আফ্রিকার বনভূমি বা তৃণভূমি অঞ্চলকে। সেইসঙ্গে কয়েক দশক আগে মূল বসবাসের জায়গা থেকেও উৎখাত করা হয় মাসাইদের। আশির দশকে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল অ্যাম্বোশেলি ন্যাশনাল পার্ক। এর বদলে তাদের থাকার জন্য দেয়া হয়েছিল পাথুরে জমি। 

চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীলতা তাই আরও বেড়ে যায় মাসাইদের। আর সেইসব প্রাণীরা মাঝেমধ্যেই সিংহের খাদ্য হয়ে উঠত। ফলে, গবাদি পশুদের নিরাপত্তা দিতেই মাসাইরা অস্ত্র তুলে নিত বনের রাজার বিরুদ্ধে। পরিসংখ্যান বলছে, এক দশক আগেও প্রতি বছর কমপক্ষে ২০০ সিংহ মারা যেত মাসাইদের হাতে।

চিত্রটা বদলাতে শুরু করে গত দশকের শেষদিক থেকে। ‘লায়নস গার্ডিয়ান’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বেশ কিছু অধ্যাপক এগিয়ে আসেন সিংহ সংরক্ষণে। পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণের পর এই বীর যোদ্ধা, সিংহ শিকারিদের হাতেই তুলে দেয়া হয় গুরুদায়িত্ব। বদলে নিশ্চিত করা হয়, এই কাজের জন্য তাদের অর্থের পাশাপাশি খাবারেরও বন্দোবস্ত করা হবে। 

জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজন নিশ্চিত হতে সাগ্রহেই এগিয়ে আসেন মাসাই যোদ্ধারা। বর্তমানে সব মিলিয়ে শুধু কেনিয়াতেই রয়েছেন এমন ২৭ জন মাসাই সংরক্ষণকর্মী। রেডিও টেলিমেট্রি অ্যান্টেনার ব্যবহার শেখানো হয়েছে তাদের। এর মাধ্যমে সিংহের অবস্থান নির্ণয় করে আগে থেকেই সাধারণ মানুষকে সাবধান করে দেন তারা। শুধু তাই নয়, সাভানায় দিনরাত টহল দিতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে সিংহের গতিবিধি তাদের নখদর্পণে থাকায় এ-কাজে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না তাদের। আর এই রক্ষাকর্তাদের সৌজন্যে বর্তমানে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে চোরাশিকারও।

অথচ প্রতি মাসাইকর্মীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কারোর কারোর জীবনে সিংহ শিকারের সংখ্যা ২০ কিংবা তারও বেশি। সিংহের সঙ্গে সেই শত্রুতাই আজ পাল্টে গেছে বন্ধুত্বে। মাসাই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বদলেছে বীরত্বের সংজ্ঞা। অরণ্যের প্রতিরক্ষার মাধ্যমেই সহাবস্থানের নতুন দিশা দেখাচ্ছেন তারা। মাসাইদের শরীরের উচ্চতা অনেক বেশি হওয়ায় এদের শিকার করা অনেক সহজ ছিল। মাসাইর নারী-পুরুষরা সাধারণত লম্বা হয়ে থাকে। এদের জীবনযাত্রার ধরনের কারণে শরীর পেশিবহুল হয়। ছেলেমেয়ে উভয়ের মধ্যেই মাথা কামিয়ে রাখবার একটা প্রচলন আছে। মাসাইদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হচ্ছে, তারা যোদ্ধা। মাসাই যোদ্ধারা বড় চুলের অধিকারী হন। এছাড়াও আছে লিঙ্গ নির্বিশেষে শরীরে উল্কির প্রচলন।

নিজেদের মাতৃভাষা 'মা'তেই কথা বলে। এই ভাষা তাদেরকে একই ধরনের অন্য কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করে। সামবুরু গোষ্ঠী হচ্ছে মাসাই গোষ্ঠীর সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে যুক্ত একটি গোষ্ঠী। তাদের জীবনধারণ, অর্থোপার্জনের পথ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ঘরবাড়ি, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশুর প্রচলন, গান-বাজনা, ধর্মবিশ্বাস এবং এদের ভেতরের প্রচলিত মিথ সবই মাসাই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। তবে ক্রমেই কমে আসছে এদের সংখ্যা। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.