খুনের দানব রেড ক্যাপ
ODD বাংলা ডেস্ক: মানুষের কল্পনায় যুগে যুগে নানা ধরনের ভীতিকর, রহস্যময় ও ধ্বংসাত্মক প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই কল্পিত সৃষ্টিগুলো মানবমনে ভীতি আর কৌতূহলের সঞ্চার করেছে। এই বিচিত্র তালিকার একটি রক্তপিপাসু দানবের নাম রেড ক্যাপ (Red Cap)। রেড ক্যাপের উপকথাটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি, বরং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই আবদ্ধ। ব্রিটিশ সীমান্ত উপকথায় (Border Folklore) এই বিপজ্জনক প্রাণীটির উৎপত্তি হয়েছে।
সীমান্ত উপকথা বা বর্ডার ফোকলোর বলতে রূপকথার সেই শাখাটিকে বুঝানো হয়, যেটির উৎপত্তি হয়েছে বর্তমান যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরে অবস্থিত ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের সীমান্তে। অতীতে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড দুইটি পৃথক ও শত্রুভাবাপন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, এবং ইঙ্গ–স্কটিশ সীমান্ত ছিল অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ ও তৎসংশ্লিষ্ট সহিংসতার সাক্ষী। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের কল্পনাতেই গড়ে উঠেছে ক্ষতিকারক রক্তপিপাসু দানব ‘রেড ক্যাপ’–এর কাহিনী। রেড ক্যাপরা ‘রেডকম্ব’ (Redcomb) বা 'ব্লাডি ক্যাপ' (Bloody Cap) নামেও পরিচিত, কিন্তু রেড ক্যাপ নামটিই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সীমান্ত উপকথা অনুযায়ী, রেড ক্যাপরা হচ্ছে একধরনের গবলিন (goblin) বা ডুয়ার্ফ (dwarf) জাতীয় প্রাণী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রূপকথার গবলিন বা ডুয়ার্ফরা আকৃতিগতভাবে মানবসদৃশ কিন্তু মানুষ থেকে পৃথক ও জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী। রেড ক্যাপদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বর্ণা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
রেড ক্যাপরা দেখতে খর্বকায় ও স্থূলকায় বৃদ্ধ মানুষদের মতো। তাদের রয়েছে লম্বা ও ধারালো দাঁত, ঈগলের নখরের মতো নখযুক্ত ছোট্ট ছোট্ট আঙুল, আগুনে লাল রঙের বড় বড় চোখ এবং কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা বিকটদর্শন চুল। তারা পায়ে ভারী লোহার বুটজুতো পরিধান করে, এবং তাদের মাথায় থাকে রক্তিম লালবর্ণের টুপি। আর তাদের হাতে থাকে তাদের প্রধান অস্ত্র, একটি ভারী মুগুর।
সীমান্ত উপকথায় প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে, ইঙ্গ–স্কটিশ সীমান্তবর্তী পরিত্যক্ত প্রাসাদগুলোতে রেড ক্যাপরা বসবাস করে। বিশেষত যে প্রাসাদগুলোয় অত্যাচারী রাজা বা সামন্তদের বসবাস ছিল এবং যেগুলোতে মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে, সেই প্রাসাদগুলোয় রেড ক্যাপদের উপস্থিতির সম্ভাবনা বেশি। যখন কোনো মানুষ ভুলক্রমে এই প্রাসাদগুলোয় প্রবেশ করে, তখন রেড ক্যাপরা সেই মানুষকে আক্রমণ করে। তারা দূর থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে অথবা তাদের হাতের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে অনুপ্রবেশকারীকে হত্যা করে। এরপর তারা নিহত মানুষের রক্ত দিয়ে নিজেদের টুপি ভিজিয়ে লাল করে নেয়। এর থেকেই 'রেড ক্যাপ' (বা 'লাল টুপি') নামটির উৎপত্তি।
রেড ক্যাপরা ভারী মুগুর বহন করে এবং ভারী লোহার বুটজুতো পরিধান করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে। ফলে তাদের হাত থেকে দৌড়ে পালানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল তাই নয়, পেশিশক্তি প্রয়োগ করে বা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করে রেড ক্যাপদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়, কারণ এগুলো তাদের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলে না।
কেবল তাদের সামনে বাইবেলের বাণী উচ্চারণ করে বা ক্রুশ চিহ্ন প্রদর্শন করেই তাদের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব। কোনো রেড ক্যাপ যদি বাইবেলের বাণী শ্রবণ করে বা ক্রুশ চিহ্ন দেখতে পায়, তাহলে সে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং আগুনের শিখা জ্বেলে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কেবল তার একটি বড়সড় দাঁত তার চিহ্ন হিসেবে সেখানে থেকে যায়।
সাধারণভাবে সীমান্ত উপকথায় রেড ক্যাপদের একটি খুনে দানব প্রজাতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন: স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ার বা পার্থ কাউন্টির উপকথায় রেড ক্যাপকে একটি উপকারী অলৌকিক প্রাণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপকথায় রেড ক্যাপ হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতির একটি প্রাণী যে সমভূমি থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত প্রাসাদে বসবাস করে। কোনো মানুষ যদি তাকে দেখতে বা শুনতে পায়, তাহলে সে ঐ মানুষকে সৌভাগ্য প্রদান করে। এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, রেড ক্যাপের উপকথাটি ব্রিটেনের সর্বত্র একই রকম নয়, বরং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ধরনের রূপ ধারণ করেছে।
রেড ক্যাপের উপকথাটি কার্যত একটি আঞ্চলিক উপকথা। ইঙ্গ–স্কটিশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই এর ব্যাপ্তি। বাঙালি রূপকথায় প্রচলিত ব্রহ্মদৈত্যের উল্লেখ যেমন অন্যকোনো রূপকথায় পাওয়া যায় না, রেড ক্যাপের উপকথাও অনুরূপভাবে ব্রিটেনের বাইরে তেমন পরিচিত ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে রেড ক্যাপের উপকথাটি ব্রিটিশ সীমান্ত উপকথার তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন লেখক তাদের ফ্যান্টাসি বা কল্পকাহিনীমূলক বইয়ে রেড ক্যাপের উপকথাকে সংযোজিত করেছেন, এবং এর মধ্য দিয়ে উপকথাটিকে নানাবিধ নতুন আঙ্গিকে ও বৈশিষ্ট্যে সাজিয়ে তুলেছেন।
রাউলিং তার 'ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়্যার টু ফাইন্ড দেম' বইয়ে রেড ক্যাপের উপকথাটিকে সম্প্রসারিত করেছেন। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, রেড ক্যাপরা হলো ক্ষুদ্র বামন জাতীয় প্রাণী, যারা পুরনো যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত গর্তে এবং রক্তপাত হয়েছে এমন স্থানে বসবাস করে। সাধারণত উত্তর ইউরোপে রেড ক্যাপদের বেশি দেখা যায়। একাকী সাধারণ মানুষ বা মাগলদের জন্য রেড ক্যাপরা খুবই বিপজ্জনক, কারণ তারা মানুষদেরকে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে থাকে।
ব্রিটিশ সীমান্ত উপকথা অনুযায়ী, রেড ক্যাপদের প্রতিহত করার জন্য বাইবেলের বাণী উচ্চারণ করতে হয় বা ক্রুশ চিহ্ন দেখাতে হয়। এটি ছিল ব্রিটেনের খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য তথা খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্যের একটি নমুনা। অর্থাৎ, 'অনিষ্টকারী' রেড ক্যাপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে 'মহান' ও 'পবিত্র' খ্রিস্টধর্মের শরণাপন্ন হতে হবে– এই ধারণাটি কার্যত খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকেই পরোক্ষভাবে প্রচার করছে। কিন্তু রাউলিং এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
রাউলিংয়ের সৃষ্ট হ্যারি পটার ইউনিভার্সে রেড ক্যাপদের মোকাবেলা করার জন্য খ্রিস্টধর্মের প্রতীক ক্রুশ বা খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এই জগতে রেড ক্যাপদের মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন হয় জাদুমন্ত্রের। এখানে উল্লেখ্য, খ্রিস্টধর্ম বরাবরই জাদুচর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে, এবং মধ্যযুগে প্রকৃত ও সন্দেহভাজন জাদুবিদ্যা চর্চাকারীদের ওপর খ্রিস্টধর্মীয় নেতারা চরম নির্যাতন চালিয়েছেন। অথচ হ্যারি পটার ইউনিভার্সে রেড ক্যাপদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মীয় প্রতীকগুলোকে বর্জন করে এর পরিবর্তে খ্রিস্টধর্মের নিষ্পেষণের শিকার জাদুবিদ্যাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। কার্যত এর মধ্য দিয়ে রাউলিং খ্রিস্টীয় চার্চের প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, এবং তাদের নৈতিক আধিপত্যেকে আংশিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
রেড ক্যাপের উপকথাটি ছিল ব্রিটিশ সীমান্ত রূপকথার একটি অংশবিশেষ, যেটির মধ্য দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারিত হতো। রাউলিং এই উপকথাটিকে আংশিক পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করে নিজস্ব 'হ্যারি পটার' কল্পজগতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন, এবং প্রচ্ছন্নভাবে খ্রিস্টধর্মে নিষিদ্ধ জাদুবিদ্যাকেই আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ভাগ্যের পরিহাসে, মূল রেড ক্যাপ উপকথাটি যতটা পরিচিতি লাভ করেছিল, সেই তুলনায় হ্যারি পটার সিরিজ ও সিরিজ–সংশ্লিষ্ট রেড ক্যাপ উপকথাটির পরিবর্তিত রূপ বহুগুণ বেশি পরিচিতি অর্জন করেছে।
মানুষের কল্পনা যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, রেড ক্যাপ উপকথাটির এই বিবর্তন তার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
Post a Comment