হার্মাদ : কেমন ছিল তাদের দস্যিপনা?

ODD বাংলা ডেস্ক: সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বকালে বাংলার পূর্ব আর দক্ষিণ সীমান্তে এসে হাজির হয়েছিল পর্তুগিজ আর্মাডা। গোটা মুঘল আমল জুড়ে এমনকি ব্রিটিশ রাজত্বের শুরুতেও তারা সমুদ্র উপকূলের পাশাপাশি বাংলার স্থলভূমিতেও যখন তখন হানা দিয়ে লুঠপাত চালাতেন। নারী-পুরুষ অপহরণ করে তারা বিক্রি করে দিতেন দাক্ষিণাত্যের নানা বন্দরে।
উপকূল অঞ্চলে মানুষের বসবাস প্রায় কঠিন হয়ে উঠেছিল এদের ভয়ে। স্থানীয় লোকজন এদের বলতেন ‘হার্মাদ’। ‘আর্মাডা’ থেকে এই ‘হার্মাদ’ শব্দটা এসেছে। বাংলার লোকসাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্রের জেলেরা বুড়ো সর্দারের দেওয়া পরামর্শে হঠাৎ পেছন থেকে হার্মাদদের চোখে মুঠো মুঠো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে পালাতেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ১৬ শতকে লিখেছিলেন, শ্রীমন্ত সওদাগরের নাবিকেরা ‘রাত্রিদিন বহি যায় হার্মাদের ডরে’। তখনকার সাহিত্য থেকে বোঝা যায়, হার্মাদ মানেই সেই যুগে ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা।

গোয়া আর বোম্বে ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি। বোম্বে থেকে আসত বলে তাদের ‘বোম্বেটে’ নামেও ডাকা হতো। আর বাণিজ্যের প্রয়োজনে বাংলায় এরা ডেরা বেঁধেছিল চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম আর হুগলিতে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই ছিলেন এদের লুঠপাটের শিকার। একটা সময়ে পর্তুগিজদের সঙ্গে আরাকানের মগরা যুদ্ধ করলেও, পরে মগ আর পর্তুগিজরা একসঙ্গে মিলে দস্যুবৃত্তি চালাত। আরাকানের মগ রাজাদের সেনাবাহিনীতে বহু পর্তুগিজ কাজ করতেন। মুঘল প্রশাসন বহুদিন এদের দাপিয়ে বেড়ানোকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সারা বাংলায় চলছিল এক ধরনের অরাজকতা। এমন পরিস্থিতি গোটা বাংলাকেই করে তুলেছিল ‘মগের মুলুক’, অর্থাৎ যেখানে মগেরা ইচ্ছে মতো চলেফিরে বেড়ায়।

হিন্দু সমাজে মগেরা ছিল অস্পৃশ্য। মগেরা কোনো মানুষকে স্পর্শ করলে সমাজে তাকে একঘরে করে দেওয়া হতো।

তবে মগেদের সঙ্গে পর্তুগিজদের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হয়নি। পর্তুগিজদের দখল করা সন্দীপ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছিল। সিবাশ্চিয়ান গঞ্জালিস নামে এক পর্তুগিজ সেনাপতি চেষ্টা করেছিলেন আরাকানের একটা অংশ দখল করে নিতে। আরাকানের মগদের সঙ্গে তার যুদ্ধ বাঁধে। ১৬১৮ সালে ওলন্দাজদের সাহায্যে সন্দ্বীপ দখল করে নেন আরাকানের রাজা।

মুঘল সুবাহদার শায়েস্তা খান নিজের কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে মগ আর পর্তুগিজদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে পেরেছিলেন। পর্তুগিজদের সাহায্যেই তিনি ১৬৬৩ সালে আরাকান থেকে মগ রাজাকে উৎখাত করে জায়গাটা মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। ১৬৬৬ সালে তার সেনাপতিরা দখন করে নেন চট্টগ্রাম আর সন্দ্বীপ। বাংলা থেকে পর্তুগিজ আর মগ দস্যুরা জমি হারাতে শুরু করেছিল শায়েস্তা খানের পরাক্রমে।

তবে ইংরেজ আমলেও মগ আর পর্তুগিজ আক্রমণের ভয় সম্পূর্ণ যায়নি। ১৭৯০ সালে ইংরেজ সরকার তখনকার হাওড়ায় শিবপুরে গঙ্গায় বাঁধ তৈরি করে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের আসার পথ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। এত কিছুর পরেও ১৮২৪ সালেও কলকাতাতে এই দস্যুরা হানা দিয়েছিল বলে জানা যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.