ব্রিটিশপূর্ব ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর, নেপথ্যে বাঙালির অবদান
ODD বাংলা ডেস্ক: রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। ইতিহাসের নথিতে যে শহরের নাম লেখা রয়েছে ব্রিটিশপূর্ব ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর হিসেবে। এশিয়ার সাতটি সেরা পর্যটনকেন্দ্রের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত জয়পুর। সে শহরের যন্তর-মন্তর আর আদিভূমি আমের দুর্গ, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর তালিকাভুক্ত হয়েছে।
এখন কথা হল, সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত এই যে জয়পুর শহরের এত খ্যাতি, জানেন কী, তার নেপথ্যে এক কৃতী বাঙালির অবদান রয়েছে? ঠিকই পড়েছেন। বাঙালি। নৈহাটিতে জন্ম নেয়া এক বঙ্গসন্তান, যার নাম বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর জয়পুরের স্থপতি তিনিই। তবে বহু প্রজন্মের কাছেই তিনি এবং তার অবদান বিস্মৃত, উপেক্ষিত।
আসলে রাজা দ্বিতীয় জয় সিং নিজেও ছিলেন কৃতবিদ্য পুরুষ। শৈশবেই মোগল বাদশাহ ঔরংজেব তার বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে ‘সওয়াই’ উপাধি দেন। সওয়াই অর্থে চারগুণ। অর্থাৎ দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং যে তার পূর্বসূরি এবং সমসাময়িকদের চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে অনেক এগিয়ে ছিলেন, তা স্বীকার করেছিলেন খোদ মোগল বাদশা।
পরিণত বয়সে জয় সিং হয়ে ওঠেন একদিকে দক্ষ প্রশাসক, অন্যদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে, পূর্তবিদ্যায়, গণিতে পারদর্শী। অম্বরের সিংহাসনে তার রাজ্যপাট ভালোই চলছিল। কিন্তু একসময় রাজ্যের ওপর ঘনিয়ে এল কালো মেঘ। মুর্শিদকুলি খাঁনের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিন খাঁ সিংহাসনে বসলে মোগল সাম্রাজ্যবিস্তারের নিশানা হয়ে উঠতে লাগল করদ রাজপুত রাজাদের শহর, অম্বর।
মধ্যভারত থেকে মারাঠাদেরও নজর পড়তে শুরু করল অম্বরের ওপর। এদিকে অম্বরে তখন দুর্ভিক্ষ, জলের অভাব, অত্যধিক জনসংখ্যা। অতঃপর দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং এসব বিপদ থেকে মুক্তি পেতে স্থির করলেন অম্বর থেকে রাজ্যপাট তুলে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন। কোথায়? জায়গা পছন্দ হল আমের থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেই ধূ-ধূ প্রান্তরে রাজধানী গড়বে কে? রাজপুতদের মধ্যে অত দক্ষ স্থপতি কোথায়? রাজার মনে পড়ল বিদ্যাধরের কথা। তিনি থাকতে ভাবনা কী? বিদ্যাধরের উপরেই ভার পড়ল জয় সিংয়ের নয়া রাজধানী সাজাবার।
চরম উৎসাহে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য পড়াশুনো শুরু করে দিলেন। কখনো টলেমি, ইউক্লিডের জ্যামিতিক নকশার বই, কখনো প্রাচীন শিল্পশাস্ত্র, বাস্তু কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই। আলাপ আলোচনা চলতে লাগল রাজার সঙ্গে। অবাক হতে হয় ইতিহাস জানলে, রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং সেই সময় ইউক্লিডের জ্যামিতির অনুবাদ করিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষায়। যাইহোক, বিদ্যাধর ভট্টাচার্য ঠিক করলেন শিল্প, গণিত এবং বাস্তুশাস্ত্রের মূল সূত্রগুলি অনুসরণ করবেন নগরনির্মাণে। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হল মহাযজ্ঞষ যা শেষ করতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল বিদ্যাধরের। প্রথমে রাজার নামানুসারে নতুন রাজধানীর নামকরণ করা হয়েছিল সওয়াই জয়নগর।
পরে নামসংক্ষেপে তা হয়ে দাঁড়াল সওয়াই জয়পুর, আরো পরে শুধু জয়পুর। মোটামুটিভাবে ১৭৩১ সালের দিকে জয়পুরের নির্মাণকাজ শেষ হল। যে কৌশল, পরিকল্পনা আর নকশায় বিদ্যাধর ভট্টাচার্য জয়পুর শহর তৈরি করেছিলেন, তা এখনকার অত্যাধুনিক বাস্তুকারদের কাছে বিস্ময়! জায়গার নির্বাচনও অসাধারণ। অম্বরের দুর্গ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরিয়ে জয়পুরের সমতলে বানানো হল। যদিও দূরে আরাবল্লি পাহাড়ই শহরের নিরাপত্তা প্রাকার হিসেবে রইল।
সমতল বলে শহরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ছিল। পুরো শহরকে নয়টা আয়তক্ষেত্রে ভাগ করলেন বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, যা সৌরমণ্ডলের নয় অক্ষের প্রতীক হয়ে রইল। এরমধ্যে দুটি ক্ষেত্র রাখা হল রাজারাজড়াদের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে। বাকি সাতটি সাধারণ বাসিন্দাদের ব্যবহারের জন্য। বিভিন্ন পেশার জন্য আলাদা আলাদা এলাকা ভাগ করা হল। নিরাপত্তার জন্য পুরো শহর ঘিরে তৈরি হল কুড়ি ফুট উঁচু পাঁচিল। সাতটি বড় বড় প্রবেশপথ বানানো হল রাজপুত স্থাপত্যকীর্তির কারুকার্য অনুসরণে।
বিদ্যাধর ভট্টাচার্যেরই পরিকল্পনায় জয়পুরের অন্যতম স্থাপত্য চন্দ্রমহল নির্মিত হয়েছিল, যার মোগল মিনিয়েচার এবং রাজস্থানী পাথুরে শিল্পকর্মের মিশ্র স্থাপত্যশৈলী আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এখনও জয়পুরের রাজপরিবার এখানে বাস করেন। সাতমহলা প্রাসাদের প্রতিটি তলার আলাদা আলাদা নাম: পীতম নিবাস, সুখনিবাস, শোভানিবাস, ছবি নিবাস, রঙ্গমন্দির, মুকুটমহল এবং শ্রীনিবাস। সেই কবে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকলপনায় তৈরি হয়েছিল সাতমহলা চন্দ্রমহল!
আজও সেই চন্দ্রমহলের মাথা যেন ছুঁয়ে রয়েছে মেঘবাতাসের নরম শরীর। পেছনে আরাবল্লির পাথুরে পাঁচিল। মাঝখানে চন্দ্রমহলের মাথায় উড়ছে জয়পুরের রাজপতাকা। বড় পতাকাটির সঙ্গে এক চতুর্থাংশ সাইজের একটি ছোট পতাকা ওড়ে সওয়াই জয় সিংয়ের স্মৃতিতে। বলা চলে ওটা একরকম সওয়াইয়ের প্রতীক। জয়পুরবাসী মনে করেন রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং আজও রয়েছেন জয়পুরের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাই তার সম্মানে সেই আঠেরো শতক থেকে বড় পতাকার সঙ্গে ছোট পতাকাও আসীন চন্দ্রমহলের মুকুটে।
জয়পুরের নির্মাণশৈলী নিয়ে কথা বলতে গেলে যে কথার উল্লেখ না-করলেই নয়, তাহলো বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকল্পনাতেই জয়পুরের রাস্তাঘাট নির্মাণে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রের ‘গ্রিড মডেল’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত। এই মডেল অনুযায়ী, শহরের প্রতিটি রাস্তা একে অন্যের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি দূরত্ব বজায় রেখে একটা জালের মতো নকশা (গ্রিড প্যাটার্ন) তৈরি করে। প্রতিটি রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব–পশ্চিমে খোলা থাকে, যাতে সব রাস্তা দিয়েই যে কোনো দিকে যাওয়া যায়।
সিন্ধু সভ্যতার দুই বিখ্যাত নগরী হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োতেও এইভাবে গ্রিড মডেলে রাস্তা বানানোর চল ছিল। প্রাচীন রোমে এবং মিশরেও রাস্তা নির্মাণে এই ধারা প্রচলিত ছিল। জয়পুর শহরের ব্লু-প্রিন্টে প্রধান রাস্তাগুলি ষাট ফুট চওড়া রাখা হয়েছিল। আশপাশের ছোট রাস্তাগুলো প্রধান রাস্তার সঙ্গে মিলছে সমকোণে। এই ছোট রাস্তাগুলো আবার ত্রিশ ফুট লেন এবং পনেরো ফুটের বাইলেন দিয়ে যুক্ত ছিল। বড় গাছ সারি দিয়ে লাগানো ছিল রাস্তায় ছায়া করার জন্য। জলের নালা এবং কুয়ার সাহায্যে শহরের জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে বিদেশি পর্যটকরাও মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের রাজধানীর নগর পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, যার পুরো কৃতিত্বটাই পাওনা এক ও একমাত্র বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের।
বিদ্যাধরবাবুর নকশা অনুযায়ী শহরের বাজারহাট, দোকানপাট, বাড়িঘর সব বড় রাস্তার ধারে তৈরি করা হয়েছিল। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের দাপট থেকে বাঁচাতে সব দোকানের মাথায় থাকত দারুণ আচ্ছাদন। শহরের প্রধান রাস্তার মাঝখানে জমায়েতের জায়গা, যাকে বলা হতো চৌপর। সিঙ্গেল এবং মাল্টিকোর্ট সব হাভেলি শহরের শোভাবর্ধন করত। আসলে রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের ইচ্ছে আর বিদ্যাধরের নকশায় জয়পুর সামরিক শহরের খোলনলচে পাল্টে বাণিজ্যিক শহর হয়ে উঠল। কী করে অত অল্প সময়ে শহরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল, সে-ও কম বিস্ময়ের কথা নয়!
মোগল ও রাজস্থানী পাথুরে শিল্পকর্মের মিশ্র স্থাপত্যশৈলী আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
Post a Comment