ঢাকেশ্বরীকে ঘিরে নানা মিথ, ‘ঢাকা’ নামকরণেও ৮০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের ছায়া
ODD বাংলা ডেস্ক: ঢাকা শহরের নাম নিলেই অবধারিতভাবে যেসব চিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে; তার মধ্যে অন্যতম ঢাকেশ্বরী মন্দির। ঢাকা শহরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের যতগুলো মন্দির আছে, তার মধ্যে ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে মধ্যমণি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঢাকেশ্বরী মন্দির কয়েকশো বছর পুরোনো। যার কারণে ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহ্যের যোগসূত্র এই মন্দিরের মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত বেঁচে রয়েছে। ঢাকার ইতিহাস জানতে গেলে সবার আগে নাম উঠে আসে এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের। কারণ ঐতিহাসিকদের মতে, মন্দিরে দেবী দুর্গা ঢাকেশ্বরী রূপেই পূজিতা হতেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে নিয়ে ইতিহাসে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
ভিন্ন জনের ভিন্ন মত। বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং সনাতন ধর্মের সব থেকে বড় নিদর্শন এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে একাধিক মতপার্থক্য এখনও পর্যন্ত বিরাজ করে। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কিছু বিশ্বাস মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে। আগামীকাল থেকে ৮০০ বছরের প্রাচীন এই ঢাকেশ্বরী দুর্গা মন্দিরে শুরু হবে দুর্গাপূজা।
ঢাকার লালবাগ থানার পলাশী মোড় এলাকায় এই মন্দিরটি রয়েছে বছরের পর বছর ধরে । এটির আরও এক ঠিকানা হল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ের হলগুলির দক্ষিণ দিকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।
এই মন্দিরটির নামকরণ নিয়ে যেহেতু একেক জন ঐতিহাসিক ভিন্ন রকমের মত প্রকাশ করেন, তাই নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সেই কাহিনীগুলি নিজেদের মতো করেই বেশ আকর্ষণীয়। যেমন কথিত এই কাহিনী অনুযায়ী, রাজা আদিসুর তার রানিদের মধ্যে একজনকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি জঙ্গলে নির্বাসন দেন। সেখানেই রানি তার পুত্র প্রসব করেন। পরবর্তীতে জঙ্গলের মধ্যেই আদিসুরের পুত্র বল্লাল সেন বেড়ে উঠতে থাকে। এক সময় তিনি দেবীর একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। পরবর্তীতে সেই মূর্তি স্থাপন করেন এবং তৈরি করেন মন্দির। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী যেহেতু ওই মূর্তিটি ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন বল্লাল সেন তাই নামকরণ হয় ঢাকেশ্বরী।
আবার প্রচলিত আরও এক কাহিনী মতে, রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী লাঙলবন্দ থেকে ফিরে আসার পথে জন্ম দিয়েছিলেন বল্লাল সেন নামে এক পুত্রের। সেই বল্লাল সেন যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীতে জঙ্গলে গিয়ে ঢাকা অবস্থায় দেবীর মূর্তি উদ্ধার করেন এবং সেখানেই স্থাপন করেন মন্দির। সেই কারণে মন্দিরটির নাম ঢাকেশ্বরী। নামকরণের পেছনে ইতিহাস যা-ই থাকুক না কেন, মানুষের মনে ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে নিয়ে শ্রদ্ধার কোন খামতি নেই।
ইতিহাস পাতায় যা লেখা
ঐতিহাসিকরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সঠিক ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও পর্যন্ত। তবে বলা হয় সেই রহস্য নাকি উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন ১২ শতাব্দীতে এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেন। কাজেই মন্দিরটির বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি। এই মন্দিরটি তৈরি করা হয় চুন বালির মিশ্রণে। পরবর্তীতে যদিও কালের স্রোতে সংস্কার করা হয় মন্দিরটির এবং পরিবর্তন করা হয় কিছু কিছু নকশার।
এদিকে এক ইংরেজ লেখক তার ‘রোমান্স অফ অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ নামক গ্রন্থে এই ঢাকেশ্বরী মন্দির কে ২০০ বছরের পুরনো বলে দাবি করেন । একই সঙ্গে তিনি তার গ্রন্থে লিখেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্ট এই মন্দিরটির নির্মাণ করেছিলেন। জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হামলার ফলে ঢাকেশ্বরী মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ায় এই মন্দিরের মূল নকশা অনুযায়ী তা পুনরায় নির্মাণ করা হয়।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আকর্ষণীয় স্থাপত্যকলা
ইতিহাসের সাক্ষী এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব দিকের অংশটির নাম অন্তরবাটি এবং পশ্চিম দিকের অংশটি বহির্বাটি নামে পরিচিত। এছাড়াও এই মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলেই পেরোতে হয় এক বিশাল সিংহদ্বার । সেই সিংহদ্বারেরও একখানা বেশ ভারী নাম রয়েছে; তা হলো ‘নবহতখানা তোরণ’। ওই সিংহদ্বার ধরে নাক বরাবর হাঁটলেই মিলবে দেবী ঢাকেশ্বরীর দর্শন। এছাড়াও মন্দিরের শোভা বাড়ানোর জন্য রয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু স্থাপত্য। মন্দির, বাগান মেলাপ্রাঙ্গন সব মিলিয়ে দর্শনার্থীদের মনকে পুলকিত করতে সক্ষম এই মন্দির।
Post a Comment