অন্ধকার ইতিহাস! তাঁতিদের হাতের আঙুল কেটে বন্ধ করা হত মসলিন উৎপাদন!

ODD বাংলা ডেস্ক: সম্রাট আওরঙ্গজেবের মেজ মেয়ে জিনাত-উন-নিশা। সম্রাটের কাছে নাকি একদিন ভারি বকুনি শুনেছিলেন তার পোশাকের জন্য। অত হাল্কা পোশাক সম্রাটের পছন্দ হয়নি। মোঘল রাজপরিবারে অবশ্য এই পোশাকের বেশ ভালোই চাহিদা ছিল। আর শুধু মোঘল পরিবারই কেন! বাংলার মসলিনের খ্যাতি তো তখন সারা পৃথিবী জোড়া। বলছি, মসলিন কাপড়ের কথা।

মসলিন বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের অতি সূক্ষ্ম কাপড়। এটি ঢাকাই মসলিন নামেই পরিচিত। বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য এই কাপড়। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো প্রাচীন ঢাকায়। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তপ্রায় সেই শিল্পটি।

কতো না মিথ গড়ে উঠেছে এই কাপড়কে ঘিরে। একটা শাড়ি নাকি এঁটে যায় একটা দেশলাই বাক্সের মধ্যে। টলেমির ভূগোলে পর্যন্ত এই বস্ত্রের উল্লেখ আছে। অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর একটি শিল্প ঢাকাই মসলিন। ছোট একটি আংটির মধ্যে দিয়েই গলে যেতে পারে সম্পূর্ণ একটি শাড়ি। প্রায় ২০০ বছর আগে ঢাকাই মসলিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাপড়।

আসলে মসলিনের সুখ্যাতি তৈরি হয়েছিল হাজারো বছর ধরে। প্রাচীন গ্রিসে মনে করা হতো মসলিনই হচ্ছে দেবীদের মূর্তিকে পরানোর উপযুক্ত কাপড়। দূরদূরান্তের বহু রাজ্যের রাজারা পরতেন এই মসলিন। আর ভারতের মোগল রাজবংশে তো অনেক প্রজন্ম ধরে পরা হয়েছিল মসলিনের পোশাক। সে যুগেও মসলিন ছিল অনেক রকমের। তবে এর মধ্যেও সবচেয়ে সূক্ষ্ম আর দামি মসলিনের প্রশংসা করে নানা নাম দিতেন রাজকীয় কবিরা। একটি নাম ছিল ‘বাফৎ হাওয়া’ - অর্থাৎ ‘বাতাস দিয়ে বোনা কাপড়’। নামেই বোঝা যাচ্ছে, এসব উচ্চস্তরের মসলিন ছিল হাওয়ার মতোই হালকা আর নরম।

মসলিনের সুখ্যাতি ছিল বিশ্ব বাজারেও। আর তারপর এল ইংরেজ বণিকরা। বাংলার মসলিনের ইতিহাস শেষ হলো তখনই। শোনা যায়, নিজেদের মিলে তৈরি কাপড়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য ইংরেজরা নাকি এদেশের তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নিত তারা। ফলে মসলিনের সুতোও হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল এই কাপড় বোনার কৌশলও। শুধু বাঙালির স্মৃতিতে থেকে গেল এই কাপড়।

শেষ ১৮৫০ সালে ঢাকাই মসলিনের প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে। ভারতে এখনও এই কাপড় বোনার চল থাকলেও বাংলাদেশে আর কোনোদিন বোনা হয়নি এই শাড়ি। স্বাধীনতার পর এদেশের শিল্পীরা চেষ্টা করেছেন সেই হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে উদ্ধার করতে। যদিও ‘ফুটি’ নামের সেই বিশেষ তুলা আর পাওয়া যায়নি।

২০১৪ সালে শতাব্দী প্রাচীন এই ঐতিহ্যকেই ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই গঠিত হয় সাত সদস্যের একটি বিশেষ গবেষক দল। নেতৃত্বে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেন। এই শিল্পকে নতুন করে পুনর্জন্ম দেওয়ার জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জই ছিল খুঁজে বার করা উপযুক্ত কার্পাস প্রজাতিকে। কারণ, যে কোনো তুলা থেকে এই মিহি মসলিন তৈরি করা যায় না।

কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই মসলিনের সামান্যতম নমুনাও সংরক্ষিত নেই বাংলাদেশে। তা সবটাই সেসময় অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। কাজেই নমুনার সঙ্গে বাংলাদেশে উৎপাদিত তুলো প্রজাতিগুলোর ডিএনএ-সিক্যুয়েন্স মিলিয়ে দেখা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গবেষকদের কাছে। তথ্য বলতে শুধুমাত্র হাতে ছিল কয়েকটি বই। সেখানে উল্লেখিত ছিল ফুটি কার্পাসের একটি প্রজাতি থেকেই তৈরি হয় মসলিন।

নমুনা সংগ্রহ করতে ভারতে গিয়েও সেভাবে লাভ হয়নি গবেষকদের। কারণ ভারতে বর্তমানে যে মসলিন বোনা হয়, তা অনেকটাই রুক্ষ। তৈরি হয় দক্ষিণে উৎপাদিত অন্য একটই তুলোর প্রজাতি থেকে। শেষ পর্যন্ত গবেষকদের পাড়ি দিতে হয় ইংল্যান্ডেই। লন্ডন মিউজিয়ামে বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৩০০টি ঢাকাই মসলিন। সেখান থেকেই ৩০০ বছর আগের তৈরি একটি শাড়ির ডিএনএ সংগ্রহ করেন তারা। তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের ৩৮টি তুলোর প্রজাতির বিশ্লেষণ করে সাফল্য মেলে বিজ্ঞানীদের। খুঁজে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত তুলা প্রজাতিকে।

মসলিন বোনার সুতা যেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয়, সেই গাছ খুঁজে বের করা হয়েছে বিচিত্রসব পন্থা অবলম্বন করে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এই শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের হাতে কাটা ৫০০ কাউন্টের সুতাই ব্যবহার করতে হয়েছে। কাপড়ও বোনা হয়েছে হস্তচালিত তাঁতেই। তাদেরই ছয় বছরের চেষ্টা আর গবেষণা ফল দিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে মসলিনের ছয়টি শাড়ি। যার একটি গবেষকেরা প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

সে যাই হোক, এক সময় সবচাইতে দামি পোশাক ছিল মসলিন। ঐতিহ্যগতভাবে অত্যন্ত দামি এই কাপড়। যা দিয়ে তৈরি হতো শাড়ি আর পুরুষদের জামা। মসলিন ফিরে আসবে, আজও সেই স্বপ্ন দেখে বাঙালিরা। বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া মসলিন যেন আবার বাংলার দেখা পায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.