যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই মরদেহ পরীক্ষায় মিলেছিল কলেরার জীবাণু! ভাবতে পারেন?

ODD বাংলা ডেস্ক: ‘রাতে মশা, দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি’ – এই প্রবাদের বাস্তবতা নিয়েই কলকাতাবাসীর দিন কেটেছে একসময়। এই মশা-মাছির সঙ্গেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল আর ছিল চিরসঙ্গী কলেরা নয় আন্ত্রিক কিংবা প্রতিকারহীন বসন্ত। 

কলেরার চিকিৎসা তো দূরস্থান, অণুবীক্ষণের সাহায্যে কলেরার জীবাণু চিহ্নিত করার কথাও তখন অকল্পনীয়। ফলে দিনে-রাতে কলকাতায় প্রচুর মানুষ মারা যেতেন কলেরায়। ঠিক এই সময় ‘ইন্ডিয়ান অ্যানালস’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় কলেরা ও আন্ত্রিক রোগের লক্ষণ, নির্ণয় এবং চিকিৎসার সম্ভাব্য পদ্ধতি বিষয়ে একটি সমৃদ্ধ গবেষণাপত্র। লেখক সেকালের কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তী। অণুবীক্ষণের মাধ্যমে জীবাণু পরীক্ষা ছাড়াই, গবেষণাগারে কলেরা ও আন্ত্রিকের কারণে মৃত মানুষের শরীর নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। লিখে ফেলেছিলেন এই গবেষণাপত্র।

সালটা ১৮৬৪। কলকাতায় দিনকে দিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছিল ম্যালেরিয়া। তখন সূর্যকুমার ছিলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেটিরিয়া মেডিকা পদের অধ্যাপক। বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি লক্ষ করছিলেন এক বিশেষ প্রকার জ্বরের কারণে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আর এই জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে উপসর্গগুলো একইরকম। মুখে, গলায় কিংবা হাতে লালচে ভাব, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা বা গা গোলানো ইত্যাদি ছিল সেই জ্বরের লক্ষণ। 

এই সময় মৃত ব্যক্তির দেহ পরীক্ষা করে এবং পোস্ট-মর্টেম প্রতিবেদনের সাহায্যে সূর্যকুমার টাইফাস রোগের লক্ষণ খুঁজে পান। কোনো রকম জীবাণু বিশ্লেষণী যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই তার এই আবিষ্কার সত্যই প্রশংসনীয় ছিল।

অণুজীববিদ্যার অধ্যয়নও তখন শুরু হয়নি। ফলে এক অসাধ্য সাধন করে ফেলেছিলেন সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কলকাতার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন সূর্যকুমার। ভারতে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে মধুসূদন গুপ্ত যে বিপ্লব ঘটান, তারপর থেকেই কলকাতা মেডিকেল কলেজে শুরু হয়েছিল পাশ্চাত্য ধারায় চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পাঠদান।

মেডিকেল কলেজের সুপারিনটেন্ডেন্ট তখন জোশেফ ব্রামলি। ১৮৪৫ সাল। সূর্যকুমার নির্বাচিত হলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে ডাক্তারি পড়ার জন্য। শুধু তিনি নয়, সেই বিলেত যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন দ্বারকানাথ বসু, ভোলানাথ বসু এবং গোপালচন্দ্র শীল। বার্ক বেন্টিঙ্ক জাহাজে চড়ে বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন তারা, তাদের সেই জাহাজে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি নিজে একজন ছাত্রের সমস্ত খরচের ভার বহন করতে সম্মত হয়েছিলেন। 

ডাক্তারি পড়তে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। লন্ডনে ‘রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেন্স’-এর সদস্য হয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে কলকাতা মেডিকেল কলেজে সহকারী চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে মেডিকেল কলেজের মেটিরিয়া মেডিকা ও ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। ১৮৭৩ সালে তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ‘সার্জেন মেজর অফ বেঙ্গল আর্মি’ পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

শুধুই চিকিৎসা নয়, চিকিৎসার পাশাপাশি কলকাতায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের পরিসংখ্যান নথিবদ্ধ করার কথাও চিন্তা করেছিলেন সূর্যকুমার। নিজের প্রচেষ্টায় এবং গবেষণার ফলে তিনি জানান, ১৮৫০ সালে মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে তার অধীনে মোট পাঁচ হাজার ৮৩৯ জন রোগী ছিলেন যার মধ্যে অধিকাংশ রোগীরই বয়স ছিল ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সেই সব রোগীদের মধ্যে চার হাজার ৮৩৫ জন পুরুষ এবং এক হাজার চারজন ছিলেন স্ত্রীলোক। রোগীদের রোগ নির্ণয় করে তাদের ১৬টি রোগের শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেন তিনি। ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক, সিফিলিস, রিউমেটিক হৃদ্‌রোগ, হেপাটাইটিস, জন্ডিস এবং সিরোসিস রোগের প্রকোপই বেশি দেখতে পান সূর্যকুমার এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। 

কলেরা ও বসন্ত রোগ যখন কলকাতায় মহামারীর আকার নেয়, সেই সময় সূর্যকুমার চক্রবর্তীই প্রথম এই ধরনের সংক্রামক রোগের জন্য পৃথক একটি হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তার উদ্যোগেই আজকের বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল নির্মিত হয়। তার আগে ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই সূর্যকুমার গড়ে তুলেছিলেন কলেরা ও বসন্ত বিভাগ।

রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি জন্ম-মৃত্যুর হার নথিভুক্ত করার কথাও প্রথম ভেবেছেন এবং সেইমতো হাসপাতালগুলোতে আজও এই নথি যত্নসহকারে সংগৃহীত হয়ে থাকে। 

ভারতে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল জানার জন্যেই তিনি মূলত জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনা নথিবদ্ধ করার কথা ভাবেন। এ ছাড়াও ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম সিঙ্কোনা ও ফেরাস কার্বনেট ব্যবহার করে সুফল পান। যে সময় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সুবিধেই ছিল না, তখন কলকাতায় বসে রোগীদের লক্ষণ পর্যালচনা করে ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক, কলেরা, জন্ডিস ইত্যাদি রোগের উপর বিস্তারিত গবেষণা করেছিলেন সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজে তিনিই ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তি। অথচ তার কথা আজ কারই বা মনে আছে?

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.