কেমন ছিল দুই নোবেল বিজয়ীর ভাব বিনিময়

ODD বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই সাহিত্যসেবী। দুজনেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে এবং বার্নাড শ’ ১৯২৫-এ। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯১২ সালে লন্ডন গিয়েছিলেন, তখন সেইভাবে বার্নাড শ’-এর সঙ্গে কথালাপ হয়নি। রোটেনস্টাইন উদ্যোগ নিয়ে তাদের দুজনের দেখা করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বার্নাড শ’ স্ত্রীর অসুস্থতা এবং নিজের নাটকের মহড়ার কথা বলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন না। সে বছর একটি মধ্যাহ্নভোজের আসরে তাদের দেখা হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণ থেকে সেই প্রথম সাক্ষাতের গল্প জানা যায়।

রবীন্দ্রনাথের আসন নাকি পড়েছিল একেবারে বার্নাড শয়ের পাশে। অনেক সাহিত্যিক সমাগমে যেন চাঁদের হাট। আলোচনা, কথোপকথন চলছে। কথার গায়ে কথা লেগে যেন কথার ফুলঝুরিতে আসর সরগরম। সবাই কথা বলছেন। কিন্তু বার্নাড শয়ের মুখে কোনো কথা নেই। রবীন্দ্রনাথ আর বার্নাড শ’ যখন পরস্পরকে প্রথম দেখছেন, তখন রোটেনস্টাইন চলে গিয়েছেন। সভায় অনেকেই সেদিন লক্ষ করেছিলেন বার্নাড শ’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপাত উদাসীন ভাব দেখালেও আসলে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার চেষ্টা করছেন।

বার্নাড শ’ ছিলেন এক আইরিশ নাট্টকার, গল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক। জীবনের জটিলতাকেও প্রকাশ করতেন তিনি। বার্নাড শ’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মনের দ্বিধা ও সংশয়কে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ঋষিসুলভ চেহারা, পোশাক, কণ্ঠ — সবটাই প্রথমে বার্নাড শয়ের রসিকতার বিষয় ছিল।  তারপর ধীরে ধীরে অপ্রকাশিত আকর্ষণও প্রকাশ পেতে লাগল। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতের পর একটা আবেশ অবশ্যই তৈরি হয়েছিল বার্নাড শয়ের মনে। তার এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে ছিল রবীন্দ্রনাথের কথা— “He had madean extraordinary number of deeply interested friends during his visit, and I am one of them.” 

রবীন্দ্রনাথ সবার মন জয় করার মতো ব্যক্তিত্ব নিয়েই এসেছিলেন। বার্নাড শয়ের তাই আর উদাস থাকা হলো না। দুই দেশ, দুই ভিন্নরকম মানুষের মধ্যে তৈরি হলো নতুন এক সম্পর্কের সেতু। ভাষা সেখানে অন্তরায় হলো না।

রবীন্দ্রনাথের বিদায় সম্বর্ধনায় বার্নাড শ’ উপস্থিত থাকতে পারেননি। সেই আক্ষেপ চিঠির পাতায় ধরা রয়েছে। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ আবার লন্ডন গেলেন। এই সময় বেশ অনেকক্ষণ পরস্পর কথা বিনিময় করেন। এই দীর্ঘকথালাপ দুইজনকেই সমৃদ্ধ করেছিল নিশ্চয়ই। তারপর বার্নাড ১৯৩২ সালে পৃথিবী ভ্রমণ করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনে আসার নিমন্ত্রণ করেন। চারিদিকে রটনো হয় যে বার্নাড শ’ বিশ্বভারতী আসছেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। বয়স ও স্বাস্থ্যজনিত কারণে শান্তিনিকেতন এলেন না বার্নাড। তার পরিবর্তে একটি চিঠি পাঠালেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। 

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বার্নাড শ’ কঠিনে কোমলে মন্তব্য করেছিলেন বিভিন্ন সময়। সব ভাবনার মিলও ছিল না। কিন্তু দুজনেই সত্য ও সুন্দরকে খুঁজে গিয়েছেন নিজের মতো। চারিদিকের অন্ধকার, ক্লান্তি তাদের দিশেহারা করেনি। হয়তো তাই তাদের কলম আলোর দিশা দেখিয়েছে। বার্নাড শ’-এর ব্যঙ্গের কষাঘাত আর রবীন্দ্রনাথের রসবোধ বক্তব্যের একই লক্ষ্যে স্থির হয়েছে। তখন দেশ, কাল, সময়পর্বম্লান হয়ে সময় নির্দিষ্ট এক মহান কর্মযজ্ঞে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন দুই লেখক, যেন দুইটি দোসর। এ এক অমোঘ আত্মীয়তা। প্রাবন্ধিক গৌতম সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্রনাথ ও বার্নাড শ’ প্রবন্ধে বার্নাড শ’-এর লেখায় ভারতীয় ঈশ্বরচেতনার প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। 

তিনি লিখেছিলেন বার্নাড শ’-এর লেখা ‘Adventure of the Black Girl in search of her God’-এর প্রসঙ্গ। এই কাহিনিতে একটি কালো মেয়ে খুঁজে চলেছে তার ঈশ্বরকে। এক এক সময় সে বলে উঠছে, ‘আমি সুখ চাই না, আমি ঈশ্বরকে চাই।’ গৌতম সেনগুপ্ত এর পাশে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির উদ্ধৃতি — ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হত যে মিছে।’

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের খবর পৌঁছায় বার্নাড শয়ের কাছে। বার্নাড শর অনুরোধে ন্যাশনাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি রাখা হয়। পরে বার্নাড শর তিরো ধানের পর তার সংগৃহীত বই দিয়ে একটি মিউজিয়াম তৈরি হয়। সেখানে সবার প্রথম বই দুটি হলো — রবীন্দ্রনাথের লেখা গীতাঞ্জলির অনুবাদ এবং রবীন্দ্র অনুবাদে কবিরের ১০১টি দোঁহা। সময় মনে রেখেছে এই দুই মনীষীর সখ্য। কালের গর্ভেআজও যেন স্থির হয়ে আছে ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ও বার্নাড শয়ের সাক্ষাৎকার। রোটেনস্টাইনের কলমে ছবির মতোই চিত্রিত হয়ে আছে সেদিনের ছবি — ‘Nearly twenty years later, a reception given to Tagore by Evelyn Wrench and Yeats-Brown, the two met again, now white headed and white - bearded, and sat and talked together, two noble looking elders.’

এই দুই সাহিত্যিকের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের আলো যেন স্থির হয়ে আছে মহাকালের স্মৃতি ভাণ্ডারে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.