মুঘলরা নয়, ভারতীয়দের যৌনতা নিয়ে রক্ষণশীল করে তুলেছিল ব্রিটিশরাই

ODD বাংলা ডেস্ক: অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশটা ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করতেই বদলে গেল কামসূত্রের পরিস্থিতি। প্রোটেস্ট্যান্টদের বা ভিক্টোরীয় প্রোটেস্ট্যান্টদের ভাবাদর্শ মেনে ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দু জীবনযাপপনের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে জড়িয়ে থাকা যৌনতাকে নিকৃষ্ট ধর্মাচরণের স্বীকৃতি দিয়ে তা বন্ধ করতে উদ্যত হলো। এর সঙ্গে তাঁরা হিন্দু ধর্মের আরও বেশ কয়েকটি আচরণেরও বিরোধিতা করল - যেমন বাল্যবিবাহ প্রথা ও সতীদাহ প্রথা।
ব্রিটিশরা কিন্তু মূর্তি পুজো ও ভাগবদ্গীতা-সহ সনাতন হিন্দু ধর্মকে বেশ শ্রদ্ধা করত। সেই যুগে প্রাচ্যবাদের ধারায় অশালীন ভিক্টোরিয় সাহিত্য বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং স্যার রিচার্ড বার্টন নামের এক ইংরেজ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কামসূত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তবে সেই সময় ইউরোপীয়রা কামসূত্রকে কেচ্ছাকাহিনী হিসেবেই গণ্য করতেন।

সেন্সর আইনকে ফাঁকি দিতে বার্টন একটি অলীক প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন, সংস্থাটির নাম ছিল কামশাস্ত্র সোসাইটি অফ লন্ডন অ্যান্ড বেনারস। এই প্রতিষ্ঠানটির ছাপাখানা খুব সম্ভবত বারাণসী কিংবা কসমোপলিতে ছিল। ১৮৯৭ সালে রিচার্ড সিমিদ কামসূত্রের জার্মান অনুবাদ করেন। এই অনুবাদে লেখকের যে অংশ কেচ্ছা বলে মনে হয়েছে তা লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এরপর অবশ্য কামসূত্রের আরও একটি জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটির বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে জার্মানির আদালতে মামলা করা হয়েছিল।

ব্রিটিশ আমলে যে সমস্ত ইংরেজি-জানা হিন্দুরা ব্রিটিশদের সঙ্গে বা ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করতেন তাঁরা কিন্তু একটু অন্যরকম ভাবে হিন্দু ধর্ম পালন করতেন। তাঁরা আদতে হিন্দুধর্ম নিয়ে ব্রিটিশদের মূল্যায়ন মেনে নিয়েছিলেন। এই ধরণের হিন্দুরা হিন্দু ধর্মের একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন যে ধারাকে সংস্কার-কৃত হিন্দুধর্ম বলা যেতে পারে, যার থেকেই হিন্দু নবজাগরণ বা বাংলার নবজাগরণের সূত্রপাত। এই নবজাগরণ হিন্দু ধর্মের দর্শনকে শ্রদ্ধা করলেও হিন্দু ধর্মে উল্লেখিত কামশাস্ত্রকে বাতিল করেছিল। তাঁরা সনাতন হিন্দু ধর্মের মোড়কে হিন্দু ধর্মের প্রচার করেছিলেন। এই নবজাগরণের বেশ কয়েকটি চরিত্র (যাঁদের বেশির ভাগই কলকাতায় থাকতেন) ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা প্রেমগীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন, আদিরসের ছোঁয়া রয়েছে এমন ভাস্কর্য ভেঙ্গে দিয়েছিলেন এবং মন্দিরের দেবদাসীদের মন্দির থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

এই সনাতন হিন্দু প্রথা কিন্তু হিন্দুধর্ম পালনের এক মাত্র প্রথা ছিল না। এই প্রথা তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। এই মধ্যবিত্ত সমাজ আসলে ভিক্টোরীয় সমাজকে অনুসরণ করে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে চাইতেন। এই প্রথা অনেকটা চিরাচরিত ভাবে চলে আসা ব্রাহ্মণ্য প্রথাকে অনুকরণ করেই করা, সমাজবিজ্ঞানী এম এন শ্রীনিবাস যাকে সংস্কৃতকরণ (সানস্ক্রিটাইজেশন) বলে উল্লেখ করতেন। হিন্দুরা নিজেদের মতো করে প্রথা তৈরি করে নিয়ে নিজেদের মতো করে রীতি অনুসরণ করেন নিজেদের পছন্দের দেবদেবীর পুজো করতেন। কিন্তু মধ্যবিত্তরা এক নতুন ধরণের ধর্মের সূচনা করে ফেলছিলেন।

বিশ শতকে কামশাস্ত্র আরও বড় ধরণের ধাক্কা খেল। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ল ১৯৪৭ সালে, কিন্তু যাওয়ার আগেও তারা ভারতীয়দের ভাবপ্রকাশের অধিকার খর্ব করে দিয়ে গেল সিনেমার সেন্সর বোর্ড গঠন করে (যাকে যুক্তরাষ্ট্রের হেস অফিসের খুড়তুতো ভাই বলা যেতে পারে)। ১৯৫০-এর শুরু থেকে এই সেন্সর বোর্ড কাজ শুরু করলেও এর বীজ কিন্তু ব্রিটিশ আমলেই পোঁতা হয়েছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য সিনেমায় যৌনতার থেকে দেশদ্রোহীতাকে বেশি ভয় পেতেন। এখনও ভারতীয় শিল্পকলা, সাহিত্য ও সিনেমা কিন্তু এই সেন্সর বোর্ডের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

ঊনবিংশ শতকের সংস্কারকৃত হিন্দুধর্ম কামসূত্রকে বাতিল করে দিলেও তাঁরাই কিন্তু এযুগে মহিলাদের উপর অত্যাচারে সিদ্ধহস্ত। বেঙ্গালুরু, মুম্বাই দিল্লি থেকে শুরু করেই দেশের অন্যান্য শহরেও রামসেনার সদস্যরা কিন্তু রুটিনমাফিক যুগলদের জনসমক্ষে, পানশালায় বা ভ্যালেন্টাইন্স ডের কার্ডের দোকানে নিগ্রহ করে থাকেন।

দেশের বুদ্ধিজীবীরা এই পরিস্থিতির জন্য ব্রিটিশ ও মুসলমানদের দায়ী করে থাকেন। ব্রিটিশদরা দায়ী হলেও এই পরিস্থিতির জন্য মুসলমানরা দায়ী নয়। ষোড়শ শতকের লোদি শাসনকালে সংকৃত ভাষায় অনঙ্গরঙ্গ নিয়ে সবচেয়ে বড় কাজটি হয়েছিল। এর পর মুঘল আমলে কামসূত্র নিয়ে বেশ কিছু ভালো ভালো সচিত্র বই প্রকাশিত হয়েছিল।

ভিএস নয়পল তাঁর বই হাফ এ লাই -তে কামসূত্র নিয়ে মুসলিম বিরোধিতার যে অভিযোগ করেছেন, তা আদতে তাঁর নিজস্ব মতামত।

"আমাদের সমাজে শৃঙ্গার নেই"

আমাদের সমাজে বিবাহ দেখাশোনা করে ঠিক হয়। বিবাহ পাকা করার সঙ্গে যৌন মিলনের কোনও সম্পর্ক নেই। অনেক ছেলেই হয়ত কামসূত্র নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। কিন্তু তাঁরা সেই আলোচনা বাড়িতে করেন না। কামসূত্র আদতে উচ্চবিত্তদের জন্য। কিন্তু আমার গরিব বাবা ব্রাহ্মণ হলেও কোনোদিনও কামসূত্র বইটি দেখেছেন বলে আমার মনে হয় না। এই ধরণের দার্শনিক যৌন আলোচনার প্রচলন আমাদের সমাজে ছিল যা মুসলমানরা ধ্বংস করে দিয়েছে।" তাই অনেক হিন্দুই মনে করেন যে মুসলমান শাসন ও আমদানি করা ব্রিটিশ ভিক্টোরীয় রীতি যৌনতা সম্পর্কে আমাদের রক্ষণশীল করে তুলেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.