দেবী চামুণ্ডা সম্পর্কে কি এই তথ্যগুলি জানতেন


ODD বাংলা ডেস্ক: কালিপুজোতে আমরা দেবীর নানা রূপের দর্শন পেয়ে থাকি। এমনকি, দেবীর প্রতিটি রূপের নামও ভিন্ন। তেমনই একটি নাম দেবী চামুণ্ডা। 

মার্কেণ্ডয় পুরাণ মতে, পরাক্রমশালী মহিষাসুর, স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ তাঁর অধীনে করে নেন। আতঙ্কিত দেবতারা সেইসময় ব্রহ্মার সাহায্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা সাহায্যের আশা নিয়ে হাজির হন স্বয়ং মহাদেব এবং শ্রীবিষ্ণুর কাছে। কিন্তু, মহিষাসুর বিশেষ আশীর্বাদবলে কোনও পুরুষের দ্বারা বধ্য ছিলেন না। তখন শ্রীবিষ্ণু পরামর্শ দেন যে, -প্রত্যেক দেবতা তাঁর নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে এক নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এই নারীমূর্তিই হলেন স্বয়ং দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গার অর্থ হল দুষ্প্রাপা, বা যাকে সহজে লাভ করা যায় না।তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের স্ত্রী।

অসুরদল দুর্গাকে আক্রমণ করলে, ইনি তা প্রতিহত করেন। মহিষাসুর নিজে মহিষের রূপ ধরে দেবীর সামনে এলেন। এরপর মহিষাসুর তার মহিষরূপ ত্যাগ করে, সিংহের রূপ ধারণ করলেন। এরপর অসুর হাতির রূপ ধরলেন। এবার অসুর পুনরায় মহিষের রূপ ধরে পুনরায় ত্রিলোক তছনছ করে বেড়াতে লাগলো। এই সময় দেবী অমৃত পান করে ক্রোধে হাসতে লাগলেন এবং মহাযুদ্ধের শেষে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করলেন। 

বলা হয় যে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার হত্যা করেন। প্রথমবার অষ্টাভূজা উগ্রচণ্ডা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভূজা দুর্গারূপে। তবে, যুদ্ধের এখানেই নয়। মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে- দেবতারা মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে এসে- দুর্গার আরাধনা করেন। অন্যদিকে, শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীকে ধরে আনার জন্য চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠান। দেবী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলে, তাঁর শরীর থেকে চণ্ডিকা শক্তি বের হতে থাকলো। হিমালয়ের শিখরে তাঁরা দেবীকে আক্রমণ করলে দেবীর কপাল থেকে অপর একটি ভয়ঙ্কর দেবীর সৃষ্টি হয়। এই দেবী কালী নামে পরিচিত। 

এই সময় ইনি কালীরূপ-সহ দশটি রূপ ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। এই নামগুলো হলো- দিগম্বরী, আকর্ণনয়না, পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহবা, মুণ্ডমালাবিভুষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যামবর্ণ এবং কালী। দেবী কালীর ছিল চারটি হাত। এর মধ্যে দুই ডান হাতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বাম দুই হাতে চর্ম ও পাশ, গলায় ছিলে নরমুণ্ডু এবং বসন হিসাবে ছিল বাঘের ছাল, রক্তচক্ষু, বীভৎস মুখ। যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভুতা হয়েই চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করলেন। কালী চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে দুর্গার কাছে গেলে, দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা নামে অভিহিত করেন।

এরপর রক্তবীজ নামক এক অসুর যুদ্ধে এলেন। এই অসুরের রক্ত মাটিতে পড়লে, তা থেকে অসংখ্য অসুর সৈন্য জন্মগ্রহণ করতে। তাই তাকে যুদ্ধে পরাজিত করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এইসময়, চণ্ডিকা রক্তবীজকে আঘাত করলে তাঁর রক্ত কালী পান করে ফেলেন। এইভাবে রক্তবীজেরও প্রাণহানি ঘটে। এরপর দেবীর নানা শক্তি একত্রিত হয়ে শুম্ভ এবং নিশুম্ভকে হত্যা করেন।

মূলত, দেবী পার্বতীর থেকে এই প্রতিটি নারিশক্তির সৃষ্টি হলেও, পার্বতী আমাদের কাছে দয়া, প্রেম এবং আশীর্বাদের প্রতীক। যদিও, তাঁর বেশ কিছু ভয়ঙ্কর মূর্তিও রয়েছে। যেমন- দুর্গা, কালী, তারা, চণ্ডী, দশমহাবিদ্যা ইত্যাদি। একইসঙ্গে তাঁর দয়াময়ী রূপগুলি যথাক্রমে কাত্যায়নী, মহাগৌরী, কমলাত্মিকা, ভুবনেশ্বরী ও ললিতা। অনেক ক্ষেত্রে পার্বতী, চণ্ডী বা দুর্গাকেও চামুণ্ডা বলা হয়।

চামুণ্ডা সপ্ত মাতৃকার অন্যতম। এঁরা হলেন: ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহী এবং চামুণ্ডা। চামুণ্ডাকে দেবী কালীর অপর রূপ মনে করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পশুবলি দিয়ে ও মদ নিবেদন করে এই দেবীর পূজা করা হয়। প্রাচীনকালে চামুণ্ডার পূজায় নরবলিও দেওয়া হত। জৈনধর্মেও চামুণ্ডার পূজা প্রচলিত আছে। কয়েকটি জৈন গ্রন্থে সন্ন্যাসী জিনদত্ত এবং জিনপ্রভসুরির হাতে চামুণ্ডার পরাজয়ের কাহিনি রয়েছে। তবে জৈনরা মদ ও মাংসের পরিবর্তে নিরামিষ নৈবেদ্য নিবেদন করে তাঁর পূজা করেন। জৈনরা তাঁর সম্মানে ওসিয়ানে সচিয়া মাতা মন্দির নির্মাণ করেন। 

ভারতীয় গবেষক, প্রাচ্যবিদ ও সমাজ সংস্কারক রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের মতে, চামুণ্ডা প্রকৃতপক্ষে মধ্যভারতের বিন্ধ্য অঞ্চলের উপজাতি সমাজের পূজিত দেবী। চামুণ্ডাকালী সাধকদের কাছে কালীর একটি রূপ। বহু শ্মশানে চামুণ্ডাকে পুজো করা হয়। তাঁর গায়ের রং নীল, পরিধানে বাঘছাল। দুর্গাপূজায় মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপূজার সময় দেবী চামুণ্ডার পূজা হয়। 

অগ্নিপুরাণ-এ আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। দেবী চামুণ্ডার বর্ণ হয় গাঢ় লাল অথবা কৃষ্ণকায়। গলায় মুণ্ডমালা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে চার, আট,দশ বা বারোটি হাতের অধিকারিণী। ডমরু, ত্রিশূল, খড়্গ, সর্প, খট্বাঙ্গ, বজ্র, ছিন্নমুণ্ড ও রক্তপূর্ণ পাত্র, শব অথবা প্রেতাসনে স্থিতা; ত্রিনয়না, ভয়াল মুখমণ্ডল। ভূত তাঁর সঙ্গী। বিভিন্ন বর্ণনায় নরকঙ্কাল ও শৃগালাদি পশুও তাঁকে বেষ্টন করে থাকে। ভারতের বহু জায়গায় চামুণ্ডার মন্দির রয়েছে। জায়গাগুলি হল, হিমাচল প্রদেশের কাংলা জেলার পালামপুর। চামুণ্ডা নন্দিকেশ্বর নামে অপর একটি মন্দির রয়েছে। গুজরাতে চোটিলা এবং পানেরাতে দুটি চামুণ্ডা মন্দির। মাইসোরের চামুণ্ডা পাহাড়ে চামুন্ডেশ্বরী মন্দির। যদিও, মূল বিগ্রহ মহিষাসুরমর্দিনীর। যোধপুরের মেহরানগড়।

তথ্যসূত্র: সনাতন ধর্মতত্ত্ব,উইকিপিডিয়া

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.