নিরালা গ্রিন, তিব্বত গ্লিসারিন, মিল্লাত বাম: আশির দশকের বিজ্ঞাপনচিত্র ও তার নেপথ্য কারিগর

 


ODD বাংলা ডেস্ক: পুনে থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্বপন দেশে ফেরেন উনআশি সালে। ভারতের বিখ্যাত পুনে ফিল্ম ও টিভি ইনস্টিটিউটে প্রথম দু'বছর অভিনয়, পরিচালনা, শব্দ প্রকৌশল, চিত্রগ্রহণ ইত্যাদি সব বিষয়েই বুনিয়াদি বা বেসিক ধারণা দেওয়া হয়। পরের দুই বছরে বিষয় নির্দিষ্ট করে নিতে বলা হয় শিক্ষার্থীকে। স্বপন চিত্রগ্রহণকে প্রধান বিষয় করেছিলেন। দেশে ফিরলেন তাই পুরোদস্তুর ক্যামেরাম্যান হয়ে।  স্কুলবেলা থেকেই ছবি তোলার আগ্রহ তার। একাত্তরে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের ছবিও তুলেছেন।


সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পুনেতে তার সিনিয়র ছিলেন। দেশে ফিরে এসে 'ঘুড্ডি' ছবি বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন। স্বপনকে তিনি চিত্রগ্রাহক হিসাবে নির্বাচন করলেন। কিন্তু তখনো স্বপনের পাঠ শেষ হয়নি। তিনি এক মাসের ছুটি নিয়ে ১৯৭৮ সালে এসে ঘুড্ডির চিত্রগ্রহণ শুরু করেছিলেন। শেষ হয় ১৯৭৯ সালে।পরের বছরই মানে ১৯৮০ সালে ঘুড্ডির চিত্রগ্রাহক হিসাবে স্বপন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পুরো নামও তখন জানলো সকলে, শফিকুল ইসলাম স্বপন।


তারপর মূলধারার 'নালিশ' ছবিতেও চিত্রগ্রাহক হিসাবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলেন আশি সালের জুন মাসে।  বিয়ের ছয়দিন পর বিটিভিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে যোগ দেন। বেতন ছিল এক হাজার বায়ান্ন টাকা । সে সময়ের জন্য এটা ভালোই টাকা আর ফার্স্ট ক্লাস অফিসারের মর্যাদাও পেয়েছিলেন। তবে চাকরিতে মাত্রই দেড় বছর ছিলেন।


রঙিন বিটিভি


বিটিভিতে রঙিন ব্রডকাস্টিং শুরু হয় আশি সালের ডিসেম্বর মাসে। তার আগপর্যন্ত বিটিভি ছিল সাদা কালো আর শুটিং হতো প্রায় সবই স্টুডিওতে মানে নিয়ন্ত্রিত আলো ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে। স্বপন যোগ দেওয়ার পরে চারটি গানের অনুষ্ঠান আউটডোরে শ্যুট করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। রঙিন ছবি ধারণ করার জন্য বিটিভি কয়েকটি ইউম্যাটিক ক্যামেরা (ভিডিও ক্যাসেটে চিত্রধারণ উপযোগী প্রথম ক্যামেরা) ক্রয় করেছিলেন। ক্যামেরাগুলো নিয়ে আউটডোরে গেলেন স্বপনসহ বিটিভির অন্য ক্যামেরাম্যানেরা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রুনা লায়লা ছাড়া স্বপন একাই তিনজন শিল্পীর (ফিরোজা বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন এবং শাহনাজ বেগম) গান ধারণ করেছিলেন। যেহেতু প্রথমদিকের আউটডোর শুটিং আর নতুন এ ক্যামেরায় তখনো সবার অভিজ্ঞতা পূর্ণ হয়নি তাই ছবি তোলা গেলেও লালের আধিক্য তৈরি হলো ফ্রেমজুড়ে। স্বপন এ পরীক্ষায় সহজেই উতরে গেলেন যেহেতু তিনি ক্যামেরায় পড়াশোনা করেছেন আর ছবি তোলা ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।


চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আগেই ঘটল ঘটনাটা। ফিলিপস কোম্পানীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সমাজসেবী জনাব মাহবুব জামিল এলেন বিটিভিতে এক সাক্ষাৎকার দিতে। সেখানে তিনি স্বপনের কাছে জানতে চাইলেন, 'কেমন চলছে? নিজের মতো কিছু করতে চাও?'


স্বপন বললেন, 'হ্যাঁ নিজের মতো স্বাধীনভাবে কিছু করতে চাই যাতে সৃজনশীলতাও প্রকাশ পাবে আর অর্থের সমাগমও বাড়বে।'


আলাস্কা মিল্ক দিয়ে শুরু


মাহবুব জামিল তখন নিজের একটি ভিজিটিং কার্ড স্বপনকে দিয়ে বললেন, 'আগামীকালই এনায়েত করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করো, তিনি ইন্টারস্পিড নামের বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার।'


'আমি গেলে পরে আলোচনা করলাম। তিনি আলাস্কা মিল্কের বিজ্ঞাপনচিত্র বানানোর কাজ দিলেন।  সাদাকালোয় ১৬ মিমি ক্যামেরায়  ছবিটি বানানো হবে।  বিটিভির একজন ক্যামেরাম্যান মাজহারুল ইসলামকে চিত্রগ্রাহক হিসাবে নিলাম কারণ তিনি স্পেশাল এফেক্ট (যেমন একই ফ্রেমে ৪টি ছবি) তৈরিতে দক্ষ। আমি রইলাম মেকার হিসাবে। কাজটি ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিল। তবে তখন বিটিভিতে একটি সেন্সর বোর্ড ছিল। তাদের কাছে বিজ্ঞাপনচিত্র জমা দিলে তারা এর মধ্যে দেশের জন্য ক্ষতিকর বা ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করে অথবা দেয়া তথ্যগুলো ঐতিহাসিকভাবে সত্যি কি-না ইত্যাদি নানা বিষয় খতিয়ে দেখতেন। তাই খুব হুঁশিয়ার থাকতে হয়েছিল, আলাস্কা মিল্কের বিজ্ঞাপনচিত্রটি ভালো হওয়ায় এনায়েত করিম সাহেব আমাকে পিসিআই চায়না সিরামিকের কাজ দিলেন। তখনকার জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী রিটা আব্দুল্লাহকে (অভিনেতা আল মনসুরের স্ত্রী) মডেল হিসাবে নিলাম। ডাইনিং প্লেট, চায়ের কাপ, রাইস বোল, কেটলি ইত্যাদি তৈরি করত পিপলস কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বা পিসিআই। প্রথমে সাদা কাপড়ের ওপর আঁকা ফ্লাইং ডাক সম্বলিত পিসিআইয়ের লোগো শুট করলাম। তারপর কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর জুম করে একটি বর্ণিল প্লেট দেখালাম, সেটা ওপর দিয়ে ফ্রেম আউট হলে ইন করল একটি রাইস বোল আর অল্পক্ষণের মধ্যেই তা বাঁ দিক দিয়ে ফ্রেম আউট হলো। এভাবে আরো দুয়েকটি তৈজসপত্র দেখিয়ে বলা হলো উন্নত তৈজসপত্রের প্রতীক পিসিআই। তারপর রিটার হাত দেখা গেল, তিনি কেটলি থেকে কাপে চা ঢালছেন ( এখন পিসিআই পণ্য পাওয়া যাচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক ইউরোপের বাজারে- এ কথাটি শোনা যাচ্ছিল এ সময়), তারপর রিটার হাসিমুখ দেখা যায়, একপর্যায়ে রিটা একটি ফ্লাওয়ার ভাস ঘুরিয়েও দেখান যখন তাকে ঘিরে ক্যামেরা তৈরি করেছিল হাফ সার্কেল। ফ্লাইং ডাকের লোগো দিয়েই শেষ হয় বিজ্ঞাপনচিত্রটি,' বলছিলেন স্বপন।


১ মিনিট ৬০০০ টাকা


স্ক্রিপ্টিং, কাস্টিং, শুটিং, এডিটিং শেষে ভিডিও এবং অডিও ট্র্যাক মিক্সিং ইত্যাদি ছিল বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের ধাপ। তখন ইন্টারস্পিড ছাড়াও ইস্ট এশিয়াটিক, বিটপি, ম্যাডোনা অ্যাডভার্টাইজিং, পপুলার ইত্যাদি অ্যাড এজেন্সি ছিল। গীতি আরা সাফিয়া ততদিনে নিজের প্রতিষ্ঠান অ্যাডকমও পরিচালনা করছেন। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মধ্যে অ্যাড বেস্ট নামে একটি এজেন্সি তৈরি করেছিলেন। রিগাল সিগারেটের বিজ্ঞাপন করেছিলাম অ্যাড বেস্টের তরফে। অ্যাড এজেন্সিগুলোতে সেসময়ে ডিজাইনার পোস্ট ছিল। তারা লোগো বা ব্যাকড্রপ বা পত্রিকা বিজ্ঞাপনের নকশা করতেন।বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি হতো ৩৫ মিমি নয়তো ১৬ মিমি ক্যামেরায়।



টেলপ বলে একটা প্রযুক্তি তখন ছিল বিটিভিতে (অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না)। এই প্রযুক্তি কাজ করত স্লাইড প্রজেক্টরের মতো ম্যানুয়ালি। ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনে ৪টি এবং ১ মিনিটের বিজ্ঞাপনে ৮টি স্থিরচিত্র টেলপের মাধ্যমে পর্দায় প্রক্ষিপ্ত হতো, সঙ্গে থাকত কথা বা সংগীত। আর অ্যাডফিল্মগুলো টেলিসিনে মেশিন দিয়ে ট্রান্সফার (ফিল্ম থেকে ভিডিও) করে টিভিতে দেখানো হতো। ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের জন্য বিটিভির রেট (মূল্য হার) ছিল ৩৭০০ টাকা এবং ১ মিনিটের জন্য ৬০০০ টাকা। ১৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের বিজ্ঞাপনও ছিল, তার রেট ২০০০ টাকা। টেলপে বিজ্ঞাপন করার সুবিধা ছিল খরচ কম তবে এটা ছিল সাদাকালো প্রযুক্তি। তাই নির্মাতারা কখনো কখনো ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী স্থির চিত্রগুলোকেই ৩৫ মিলিমিটারে শুট করতেন। তখন রঙিন দেখানোর সুযোগ মিলে যেত। উল্লেখ্য, ৩৫ মিমিতে অ্যাডফিল্ম বানানোর একটা বড় কারণ ছিল সিনেমা হলে প্রদর্শনের সুবিধা। সিনেমা শুরুর আগে, বিরতিতে সে আমলে বিজ্ঞাপন দেখানো হতো।


ভালো জিঙ্গেল করতেন বাবু


স্বপন বলছিলেন, 'অ্যাড টাইমস নামে আরেকটা অ্যাড এজেন্সি ছিল। মূলত নিউজপেপার বিজ্ঞাপন করত তারা। ম্যাডোনা বা অ্যাড বেস্টে আমি মাঝেমধ্যেই একটা লোককে চুপচাপ বসে থাকতে দেখতাম। শুনেছিলাম তিনি অ্যাড টাইমসের মালিক। একটা গাড়ির গ্যারেজে তার অফিস। একদিন আমাকে বললেন, আপনার সাহায্য পেলে আমার প্রতিষ্ঠানটি বড় করতে পারি। আরো জানলাম, তিনি কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানীর (তিব্বত যাদের নামী ব্র্যান্ড)  ১০ বা ১২টি অ্যাডফিল্মের কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন। আমি যদি বানিয়ে দিই তাহলে তার প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু বেশি খরচ করার সামর্থ্য তার নেই। অথচ ততদিনে আমি একটি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণের পুরো প্যাকেজ বাবদ লাখ টাকাও নিয়ে থাকি। আমার সুবিধা ছিল স্ক্রিপ্ট তৈরি করা, ক্যামেরা চালানো, সম্পাদনা এবং শব্দ সংযোজনার কাজও আমি জানতাম। আমার টিমে প্রোডাকশন বয়, অ্যাসিস্ট্যান্টসহ বড়জোর ৫ জন কাজ করত। জিঙ্গেল করানোর দরকার হলে ফুয়াদ নাসের বাবুর শরণাপন্ন হতাম। তিনি ভালো জিঙ্গেল তৈরি করতেন। ৫০০০ টাকা ছিল রেট। আর মডেলদের দেয়া হতো ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা।


অ্যাড টাইমসের লোকটি আমাকে বিজ্ঞাপন প্রতি সাত হাজার টাকা দিতে পারবেন বলে জানালেন। ১০টা বিজ্ঞাপন একসঙ্গে করলে অবশ্য খরচ অনেকটাই কমে আসে। তবু এটা অনেকই কম। মানুষটির প্রতি আমার মায়া তৈরি হয়েছিল, তাই কাজ করেও দিয়েছিলাম।'


লেখক: স্ক্রিপ্ট আপনি নিজেই করতেন?


স্বপন: পপুলার এজেন্সির মাধ্যমে বসুন্ধরার কাজ পেয়েছিলাম। 'চল না বসুন্ধরা যাই' এর গল্পটি শুনুন এবার। তখন শাহ আলম (বসুন্ধরার মালিক আহমেদ আকবর সোবহান) সাহেবের অফিস ছিল এলিফ্যান্ট রোডে। নাম ছিল ইস্ট ওয়েস্ট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী। আমাকে বললেন, রামপুরা, বাড্ডা পার হয়ে আমার হাউজিং প্রজেক্ট। আমি ভাবলাম, একবার দেখে আসা দরকার। তখন জায়গাটা মাত্রই ভরে উঠছে। ট্রাক দিয়ে, বিরাট বিরাট নৌকা দিয়ে মাটি আনা হচ্ছে। ততদিনে কিন্তু বারিধারাও একটা অভিজাত জায়গা হয়ে উঠেছে। আমি ভাবলাম রামপুরা-বাড্ডা নয় বিজ্ঞাপনে বলা হবে, বারিধারার কাছেই আপনার স্বপ্নের ঠিকানা গড়ুন আর শেষে সুর করে বলা হবে, চল না বসুন্ধরা যাই। বিজ্ঞাপনটি দারুণ হিট করেছিল।


এরপর শাহ আলম সাহেব আরেকবার আমাকে ডাকলেন। বললেন, দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ বসুন্ধরায় একটি প্লটের বুকিং দিয়েছেন। এটাকে বিষয় করে একটা বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করুন। শাহ আলম সাহেবের অফিসেই বয়স্ক একজন কম চুলের লোক দেখেছি।  মুহূর্তেই আইডিয়া এসে গেল, বললাম, আমার স্ক্রিপ্ট করা হয়ে গেছে, আপনার ওই লোকটাকে এই বিজ্ঞাপনচিত্রে লাগবে। স্ক্রিপ্টটা এমন ছিল, নিয়াজ মোরশেদ আর লোকটা দাবা খেলছেন আর ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যাচ্ছে, দাবার চালে ভুল করেন না নিয়াজ মোরশেদ, ভুল করেননি স্বপ্নের ঠিকানা বেছে নিতেও, আপনিও আসুন, বেছে নিন নিজের ঠিকানা। এভাবে হঠাৎ হঠাৎই অনেক ভাবনা চলে আসত। মোটমাট ১৫০টি অ্যাড ফিল্ম আমি বানিয়েছি।


লেখক: আপনার করা মিল্লাত স্কিন কেয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনে যিনি মডেল হয়েছেন তিনি কি তখনকার বিখ্যাত কেউ?


স্বপন: হ্যা বিখ্যাত অভিনেত্রী জিনাত। মিল্লাত কোম্পানীর চাহিদামতো তাকে কাস্ট করা হয়েছিল। প্রোডাক্ট ভ্যালু ডেভেলপ করতে কোম্পানী তাকে উপযুক্ত মডেল ভেবে থাকবে। শুটিং করতে গিয়ে তাকে রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয় তবু তার ত্বক থাকে মোলায়েম ও সতেজ আর তা হয় মিল্লাত ক্রিমের কারণেই। বিজ্ঞাপনচিত্রে এটিই দেখানো হয়েছে।


লেখক: তখন মডেল কারা ছিলেন?


স্বপন: চিত্রনায়িকা দিতি, ক্যামেলিয়া মুস্তাফা, তারানা হালিম, চিত্রনায়িকা অঞ্জনা, রিটা আব্দুল্লাহ, নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ প্রমুখ। ফুটবলার কায়সার হামিদকে একবার পেয়েছিলাম নাবিস্কো ব্রেডের মডেল হিসাবে। পুরুষদের মধ্যে অভিনেতা উৎপল অনেক বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হয়েছিল। তখনকার ফিল্মে আমরা মুভমেন্ট কম রাখতাম, আর লোকেশন ভ্যারিয়েশনও বেশি থাকত না, মডেল থাকত ১-২ জন। কারণ প্রযুক্তি তখনো বেশিদূর অগ্রসর হয়নি আর বরাদ্দও বেশি থাকত না। কেউ কেউ ভারতের মুম্বাই বা অন্য কোথাও থেকে ফিল্ম প্রসেস করিয়ে আনত এমনকি গোটা ছবিটাই বানিয়ে আনত, আমি কাজের সব কিছুই দেশে করেছি। আমার স্ত্রী রাফেজা ইসলাম দীপু এবং আমার মেয়ে বৃষ্টি আমার বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল। নতুন মুখ তখন পেতামই না। খেয়াল করেছেন মনে হয়, পেপারে 'নতুন মুখের সন্ধানে' বলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার একটা চল ছিল। আমার বাসাকেও কয়েকবার লোকেশন করতে হয়েছে যেমন নাবিস্কো বিস্কুটের ক্যাম্পফায়ারের দৃশ্যটা আমার বাসার লনেই করা হয়েছে। আবার ওভোস্ট্যাট জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির বিজ্ঞাপনের শয্যাদৃশ্যও ছিল আমার বাসায়। ক্যামেলিয়া মুস্তাফা ছিলেন এর মডেল। শেষ দৃশ্যে তাকে আবেদনময়ী হয়ে উঠতে হয়েছিল আর এতে বিটিভির সেন্সর বোর্ড আপত্তিও জানিয়েছিল কিন্তু পরে বুঝিয়ে পার পেয়েছিলাম। শিল্পী সয়াবিন তেলের বিজ্ঞাপনচিত্রের কথা নিয়ে একবার বোর্ড আপত্তি জানাল। কথাটি ছিল, হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং বর্তমানে বাংলাদেশেও সয়াবিন একটি পুষ্টিকর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বোর্ড বলল, হাজার হাজার বছর কথাটি ভুল। আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে এসে বোর্ড সদস্যদের দেখালাম, তারপরে ছাড়া পেয়েছিলাম।



আশির দশকের বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছিলেন দিতি

লেখক: ছবি ধারণের জন্য কোন কোম্পানীর ফিল্ম ব্যবহার করতেন?


স্বপন: আমাদের এখানে ফুজি আর আগফা ফিল্ম ব্যবহৃত হতো বেশি। তবে আমার পছন্দ ছিল কোডাক। দাম কিছুটা বেশি হলেও গুণগত মানে ছিল ভালো। কিন্তু আমাদের এখানে কম পাওয়া যেত। তখন ইফতেখারুল আলম ফিল্ম আমদানি করতেন। তাকে বললাম কোডাক এনে দিতে। তিনি বললেন, একসঙ্গে যদি ১০-১২টি ক্যান অর্ডার করো তবেই খরচ পোষাবে। আমার অবশ্য একটি অ্যাডফিল্ম তুলতে ১টি ক্যানের বেশি লাগত না। একটি দৃশ্য তুলে ফেলতে পারতাম দুই টেকেই।  তাই এক মিনিটের একটি ফিল্মের জন্য ২৫০ ফুট হলেই চলে যেত (একটি ক্যানে থাকত ৪০০ ফুট যার পর্দা দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ মিনিট)। তবু আমি ভালো ছবি পাওয়ার আশায় একসঙ্গে ১০-১২টি ক্যানেই রাজি হয়ে গেলাম এবং অর্ডার দিলাম।


লেখক: তখনকার থিমগুলো (বিজ্ঞাপনচিত্রের বিষয়) কেমন হতো?


স্বপন: নিরালা গ্রিন সাবানের বিজ্ঞাপনটার কথা ধরুন- এতে মডেলের পোশাক পরিচ্ছন্ন ও চকচকে দেখানোটা জরুরী ছিল এবং পোশাক ধোয়ার কারণে যে মডেলের হাতের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না তা জানানোও দরকার পড়েছিল। আবার কায়সার হামিদকে নাবিস্কো ব্রেডের মডেল করার উদ্দেশ্য এটাই যে, শক্তিশালী এই ফুটবলারের সকাল শুরু হয় নাবিস্কো ব্রেড দিয়ে। তাই দেশের মানুষ শক্তি ও স্বাস্থ্যের জন্য নাবিস্কো ব্রেডের ওপর ভরসা রাখতে পারেন। এরপর মিলনার্স জলের পাম্পের বিজ্ঞাপনে আমরা প্রথম দেখালাম শক্ত মাটির জমিকে কৃষক-কিষানী কলসিতে করে জল এনে নরম করতে চাইছে, এতে মাটি তো নরম হচ্ছেই না উল্টো কিষানীর কষ্ট হচ্ছে বেশি। হঠাৎই কিষানী যখন আরেক জমিতে মিলনার্স পাম্পে করে অঢেল জল ঢালতে দেখে তখন তার মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। শেষে নিজেরাও ওই পাম্প ব্যবহার করতে থাকে। আবার তিব্বত গ্লিসারিন সোপে আমরা মডেলকে বরাবর মিড শটেই (কাঁধের ওপর থেকে পুরো মুখ) রেখেছিলাম। একটি গোলাপ ফুল তিনি চিবুক থেকে নাকে-মুখে বুলিয়ে খুব সতেজতা অনুভব করছিলেন, একটু পরে গ্লিসারিন সাবানেও সেই সতেজতা অনুভব করলেন।


লেখক: আর কিসের কিসের বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেছেন?


স্বপন: মিল্লাত বাম, নাবিস্কো চকলেট, এলিট পেইন্ট, শিল্পী সয়াবিন তেল, ওয়াজেদ শার্টিং স্যুটিং, প্রজাপতি ম্যাচ, ঈগল মার্কা ঢেউটিন, কিউট, আজাদ প্রোডাক্টস, টপসি ফ্রুট জুস, গ্র্যান্ড সুইটস, আজমীর আগরবাতি, মেলা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ইত্যাদি।


লেখক: তখন মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ার স্টাইলিস্ট ছিল? কস্টিউমের কাজ কিভাবে হতো?


স্বপন: আমার স্ত্রী দীপুই ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেকআপ আর্টিস্ট বা হেয়ার স্টাইলিস্ট। পোশাক ও গয়নাগাটি প্রায় সবই আর্টিস্টরা নিয়ে আসতেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হয়তো এজেন্সি সাপ্লাই করত বা কোম্পানী। তবে আমি অনেক কাজই পেয়েছি ডিরেক্ট মানে এজেন্সি মারফত নয়।


লেখক: আপনি ক্যামেরাম্যান হিসাবে আফজাল হোসেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। কেমন অভিজ্ঞতা?


স্বপন: আমি বলব, আফজাল হলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান অ্যাডফিল্ম মেকার। ১২-১৪টি অ্যাডফিল্মে তার সঙ্গে কাজ করেছি, যেমন ভাবনায় তেমনি উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। দারুণ স্মার্ট সব বিজ্ঞাপনচিত্র তিনি বানিয়েছেন। তার এজেন্সির নাম মাত্রা। আরেকটি এজেন্সির কথা বলি, নাম মনে নেই। তবে তিন নারী এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  চান্দা মাহজাবিন এবং কংকার নাম মনে আছেন, আরেকজন সম্ভবত মৃদুলা। নাবিস্কো বিস্কুট, ঈগল ঢেউটিনের কাজ তাদের মারফতই পেয়েছিলাম। তারা দারুণ সফল হয়েছিলেন।


এখন স্বপন


শেষ বিজ্ঞাপনচিত্র করেছেন ১৯৯৪ সালে। সেটি ছিল নাবিস্কো মিল্ক ক্রিম বিস্কুটের। তারপর বৈশাখী টেলিভিশনের চীফ ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কিছুকাল। একটা বর্ণাঢ্য জীবন পার করেছেন স্বপন। যুদ্ধ করেছেন,  জিঙ্গেলের সুর করেছেন, জুডো করতেন, ইয়োগা করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত স্বপন নিয়মিত লিখেছেন। প্রকাশ হয়েছে তার তোলা ছবিও। ইবনে মিজানের 'চন্দন দ্বীপের রাজকন্যার'ও তিনি ক্যামেরাম্যান। 'উসিলা'র মতো ব্লকবাস্টার ছবিও গড়ে দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমী পদক পেয়েছেন। এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি। ৫০ হাজার ফটো ডিজিটাল করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ঘরে বসেই।  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.