তারুণ্য দিয়ে কি বয়সকে ঠেকিয়ে রাখা যায়!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কোন বয়সকে আপনি মধ্যবয়সী হিসেবে বিবেচনা করেন? চল্লিশ থেকে ষাট? নাকি পঞ্চাশ থেকে সত্তর? আসলে এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তার তখনকার বয়সের উপর। বিবিসি ফিউচার অবলম্বনে নিজের তারুণ্য ও বার্ধক্য নিয়ে ভাবনা কীভাবে নিজের উপকারে আসে তা দেখে নেওয়া যাক।


২০১৮ সালে বিশ ও ত্রিশের কোঠায় থাকা পাঁচ লাখ মানুষের উপর একটি অনলাইন প্রশ্নাবলী জরিপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, গড়পড়তা তারা ৪০ বছর বয়সকে মধ্যবয়স এবং ৬২ বছর থেকে বার্ধক্যের শুরু বলে মনে করছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে- যাদের বয়স ৬৫'র উপরে, তারা জানিয়েছিলেন, ৭১ বছর বয়স থেকে বার্ধক্যের শুরু।    


এখান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে আমরা কেউই নিজেকে বুড়িয়ে যাচ্ছি ভাবতে পছন্দ করি না। চল্লিশ বছর বয়সী আপনাকে কেউ যদি কোনো প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে বলে, চল্লিশ মানেই এখন ত্রিশ এর মতো যুবক, তাহলে আপনি খুশিই হবেন বৈকি! আবার সত্তরের কোঠায় থাকা মানুষেরা বিভিন্ন ডায়েট ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নিজেদেরকে মধ্যবয়সের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবেন।   


যখন দেখি বৃদ্ধদের নিষ্ক্রিয়, অসুস্থ ও সমাজের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখন আমরা যতটা সম্ভব বার্ধক্যকে এড়িয়ে যেতে চাই। কেউ 'বুড়িয়ে যাচ্ছো' বললে, সেই ব্যক্তির সামনে যেতেও বিতৃষ্ণা লাগে কারো কারো!  


অবশ্যই বৃদ্ধদের যথার্থ সম্মানের সাথে দেখাশোনা করা উচিত। কিন্তু জীবনে বার্ধক্য অনিবার্য এবং একটি চরম সত্য। একে অস্বীকার করার উপায় নেই এবং এ থেকে কেউ রেহাইও পাবে না। তাহলে কি মানুষ বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে এক রকম বিভ্রম সৃষ্টি করছে? না, বরং এটি মানুষের নিজস্ব একটি কৌশল যা তাকে সত্যিকার অর্থেই তারুণ্য ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর রাখতে পারে! 


২০০৩ সালে গবেষক হানাহ কুপার এবং স্যার মাইকেল ম্যারমট বড় পরিসরে একটি গবেষণা কার্যক্রম চালান, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বার্ধক্য কখন শুরু হয়? অবশ্যই একেকজন একেক রকম উত্তর দিয়েছেন, কিন্তু যারা অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই বার্ধক্যের সূত্রপাত বলে জানিয়েছিলেন, ৬-৯ বছর পর খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন বা হৃদরোগে ভুগছেন।


এ গবেষণার আওতায় 'হোয়াইটহল টু স্টাডি'তে অংশ নেন লন্ডনের ১০,০০০ সরকারি চাকরিজীবি এবং তাদেরকে হাজারটা প্রশ্ন করা হয়েছিল। এদেরকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে কুপার ও ম্যারমট একটি ফ্যাক্ট প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, শারীরিক অবস্থার উপর চাকরি বা এ ধরনের বিষয়গুলোর কোনো হাত নেই। 


তাহলে বার্ধক্যের সূত্রপাত সম্পর্কে আপনার দেওয়া মতামত কিভাবে আপনারই উপকারে আসতে পারে?    


এখানে বলে রাখা ভালো, যখন কাউকে প্রশ্নটি করা হয়- 'বার্ধক্যের শুরু কখন?', সাথেসাথেই ওই মানুষটি নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তার নিজের স্বাস্থ্য, লাইফস্টাইল, শরীরে কোনো জটিল সমস্যা আছে কিনা, কখনো কখনো খুব অসুস্থ বোধ হয় কিনা… এসব ভেবে তারপরেই উত্তর দেয়।  


যারা বার্ধক্য শুরুর সময়টাকে এগিয়ে রাখে, তারা অসুস্থ হলেও সহজে ডাক্তার দেখাতে চায় না। কারণ তারা ভাবে, বার্ধক্য যেহেতু অনিবার্য, তাহলে ডাক্তার দেখিয়ে কী লাভ! এর ফলে তারা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছা করেই ধীরে হাঁটাচলা করে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার অভাবে তারা আরও দ্রুত বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যায়।


শুধু তাই নয়, 'আমিতো বুড়ো হয়ে গেছি'- এ ধরনের মনোভাব থেকে তারা অনেককিছু ভুলে যেতে থাকে এবং নিজের স্মৃতিশক্তি আগলে রাখার চেষ্টাও করেনা। বার্ধক্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পুষে রাখার ফলে দুশ্চিন্তায় তাদের নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তাই একথা স্পষ্ট যে, নিজেকে বুড়ো মনে করলে মন ও শরীর, দুই দিক থেকেই ভয় আমাদের উপর চেপে বসে।      


অন্যদিকে, যারা ভাবেন বার্ধক্য দেরিতে আসে, তারা অনেক বেশি স্বাস্থ্য ও ফিটনেস সচেতন হন। মনের দিক থেকে তারা নিজেদের তরুণ ভাবেন এবং বাইরেও তেমনই আচরণ করেন। সব মিলিয়ে তাদের জীবনে উৎফুল্লতার মাত্রাটা যেন একটু বেশিই! 


তবে কুপার-ম্যারমটের একটি গবেষণা থেকেই যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নয়। ইতিবাচক চিন্তার কারণে দেরিতে বৃদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর বেকা লেভি। 'ওহাইও লঙ্গিচিউডিনাল ডেটা অব এজিং অ্যান্ড রিটায়ারমেন্ট'- থেকে ডেটা নিয়ে চমৎকার কিছু জিনিস আবিষ্কার করেছেন তিনি। ৫০ বছর বয়সী এক হাজার ব্যক্তির উপর গবেষণা চালিয়েছিলেন তিনি। 


লেভির গবেষণার ফলাফল বলে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারাই নিজের বয়সের ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন (যেমন- তারা বিশ্বাস করেন না যে বয়স বাড়তে থাকলেই মানুষ নির্জীব হয়ে পড়ে), তারা এই গবেষণার পর গড়ে ২২.৬ বছর জীবিত ছিলেন। অন্যদিকে, যারা মনে করতেন পঞ্চাশের পরে সত্যিই বুড়িয়ে যেতে শুরু করবেন, তারা গবেষণা-পরবর্তীকালে মাত্র ১৫ বছর জীবিত ছিলেন।     

 

এছাড়াও, নর্দার্ন জার্মানির গ্রাইফসওয়াইলড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুজানা উর্ম এর করা গবেষণাটি 'বার্ধক্য' বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের আরো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়। বার্ধক্যের সূত্রপাত নিয়ে যারা নেতিবাচক চিন্তা করেন, তাদের জন্য সুখবর আছে এই গবেষণায়। কারণ এখানে বলা হয়েছে- গড়পড়তা অন্যদের চেয়ে তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেসব ব্যক্তির। কিন্তু এখানেও দেখা গেছে বার্ধক্যকে যারা ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন, যাদের কাছে বার্ধক্য মানে নতুন-মজার কিছু জানার, নতুন নতুন পরিকল্পনা করার সময়। এবং তারা অন্য সবার চেয়ে গড়ে বেশিদিন জীবিত ছিলেন। 


বার্ধক্যজনিত শারীরিক জটিলতা এ গবেষণায় গুরুত্ব পায়নি। বরং একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে বার্ধক্যকে কিভাবে গ্রহণ করছেন, তার এখনো মানসিক বিকাশ ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ আছে বলে মনে করেন কিনা, সেটিই ছিল বিবেচ্য বিষয়।  


তবে এ সমস্ত গবেষণার কোনোটির অর্থই এই না যে, আমরা জাদুকরী উপায়ে বার্ধক্যকে থামিয়ে দিতে পারবো বা নিজেকে তারুণ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। বার্ধক্যের সাথে সাথে একজন মানুষের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, পেশী ভর, হাড়ের শক্তি, নিরাময় প্রক্রিয়া- সবকিছুই হ্রাস পেতে থাকে। আর বয়স্কদের শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি যে বেশি, একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।       


এসব বড় বড় গবেষণা গড় হিসাবের উপর ভিত্তি করেই করা হয়, তাই মধ্যবয়সী নন- একথা মুখে বললেই প্রতিটি মানুষ চিরতরুণ থাকবেন না। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক সাংবাদিক ডেভিড রবসন তার 'দ্য এক্সপেকটেশন ইফেক্ট' বইয়ে কিছু টিপস দিয়েছেন। তার পরামর্শ মতে, যৌবন হারিয়ে ফেলায় হা-হুতাশ করার পরিবর্তে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা যেসব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করি, সেগুলোর উপর নজর দেওয়া উচিত। লক্ষ্য করা উচিত যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা কতটা দক্ষভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি।    


বয়স্ক ব্যক্তিরা অসুস্থ হলেই ধরে নেওয়া উচিত না যে এটি শুধুমাত্র তাদের বার্ধক্যের কারণে হচ্ছে। সর্বোপরি, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং কখনোই হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত না। নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে যে এখনো আমাদের অনেককিছু করা বাকি, অনেকদূর যাওয়া বাকি! আর আমরা যদি এই মনোভাব অবলম্বন করে এগিয়ে যাই, তাহলে দীর্ঘজীবি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে এবং জীবনকে উপভোগও করা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.