দেবীর আসল রূপ কলসি ও ডাব, রহস্য আর ইতিহাসের গন্ধ মাখা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের চণ্ডীপুজো

ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, ODD বাংলা: কলকাতা শহরের ইতিহাসের সঙ্গে কলকাতার কিছু জমিদারবাড়ির গল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাঁদের মধ্যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যদুনাথ সরকার, রানি রাসমণি দাসী, রাধাকান্ত দেব এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের পা রাখার আগে কলকাতার একচ্ছত্র জমিদারি সামলেছেন যাঁরা রায়চৌধুরী পরিবার। পশ্চিমবঙ্গের হালিশহর, বড়িশা, উত্তরপাড়া, নিমতা-বিরাটি-সহ বাংলাদেশের কিছু অংশের জমিদারি ছিল যাঁর দখলে, তিনি হলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী।

এই রায়চৌধুরি পরিবারের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের আরও খানিকটা পিছয়ে যেতে হবে। অনেকেই হয়ত জানেন না রায়চৌধুরী পরিবারের পদবী কিন্তু আদতে রায়চৌধুরী নয়। তাঁদের গোত্র হল 'সাবর্ণ' এবং 'রায়' ও 'চৌধুরী' তাঁদের উপাধি, তাঁদের পদবি গঙ্গোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে তাঁদের বংশধররা 'রায়চৌধুরী'কেই পদবি হিসেবেই ব্যবহার করেন। পাঠান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে দক্ষতা ও বীরত্বের জন্য রায়চৌধুরি পরিবারের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়কে 'খান' উপাধি দেন মুঘলরা। তিনি বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যার নাম দেন 'হাভেলি শহর', যা পরবর্তীকালে হালিশহর নামে পরিচিতি পেয়েছ। দিল্লির মসনদে তখন বসে আছেন হুমায়ুন। পরবর্তীকালে ওই বংশেরই লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে রাজা মান সিংহের তরফে একটা বিরাট অংশ জায়গীর দেওয়া হয়। সেইসময়ে বড়িশা ছিল একটি উন্নত জনপদ। তাঁদের আটচালাতেই শুরু হয় বড়িশার প্রথম দুর্গাপুজো। বলা হয় এটিই পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপুজো।

দুর্গাপুজোর পাশাপাশি রায়চৌধুরী পরিবারের চণ্ডীপুজোও দু'শো বছরেরও বেশি পুরনো।জানা যায়, ১৭৯২ সালে জমিদার মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর আমলে এই পুজো প্রথম শুরু হয়। মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী ১৭৯২ সালে মা চণ্ডীর ঘট এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে রায়চৌধুরী পরিবারের ৩৬তম পুরুষ এই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। 

ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী একদিন পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তাঁর পায়ে কিছু একটা ঠেকে। তারপর পুকুরের ডুব দিয়ে তিনি উদ্ধার করেন অষ্টধাতুর একটি কলসি। কলসিটি তিনি যত্ন করে রেখে দেন। এর তিন দিন পর, তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাঁকে তাঁর পুজো করতে বলেন।পরপর তিনদিন এই একই স্বপ্নদেশ পেয়ে মহেশচন্দ্র যান ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের কাছে এবং জানতে চান এর নেপথ্যে কী রহস্য রয়েছে, কেন তিনি এমন স্বপ্ন দেখছেন। ভাটপাড়ার পণ্ডিতরাই তখন পুঁথি পড়ে বলেন ইনি 'মা চণ্ডী'। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় দেবীর মন্দির, যা বর্তমানে বড়িশা সখেরবাজারে অবস্থিত। সেই শুরু, তারপর থেকে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মায়ের রূপ দান করা হয় এবং এই পুজো উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয় বিশাল মেলার। তবে দেবীর চণ্ডীর রূপ এখানে রক্তবর্ণ, তিনি একদিকে যেমন শান্ত-স্নিগ্ধ, অন্যদিকে তেমনই তেজস্বী। 

আরও জানলে অবাক হবেন, রায়চৌধুরী পরিবারে চণ্ডীদেবীর কোনও মূর্তি কিন্তু নিত্যসেবা করা হয় না। মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অষ্টধাতুর কলসিটি প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন সেটিই তাঁদের কূলদেবী। বলা হয়, এই পঞ্চমী তিথিই হল মায়ের জন্মতিথি। প্রতি বছর পঞ্চমী তিথিতে বদলানো হয় ওই কলসির জল। দেবী চণ্ডীর পুজো হয় তন্ত্রমতে, রীতিমতো হোম-যজ্ঞ করে। কলসির ওপর রাখা ডাব হল মায়ের মুখমণ্ডল আর ডাবের শিষ হল মায়ের নথ। প্রতি বছর পঞ্চমীর দিন ওই ডাব এবং কলসীর জল নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপরে সারা বছর ধরে ওই কলসী ও তার ডাবটিকেই দেবী চণ্ডীরূপে পুজো করা হয়। আরও জানলে বিস্ময় জাগবে সারা বছরে ওই ডাবের শিষ এবং ঘটের জলের কিন্তু কোনওরকম বদল চোখে পড়ে না। 

এখানেই শেষ নয় মায়ের ভোগেও কিন্তু চমক কম নয়। অষ্টমীর দিন দেবীর ভোগে থাকে খিচুড়ি, অন্নভোগ সাদা ভাত, নানা রকম ভাজা, তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস, সন্দেশ। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদটি হল মাছ, মাছ ছাড়া মা চন্ডীর পুজো সম্পন্নই হয় না। আরও একটি অবাক করা বিষয় হল দুর্গাষষ্ঠী বা দুর্গাষ্টমীতে যেমন নিরামিষ খাওয়ার চল রয়েছে, রায়চৌধুরী পরিবারের নিয়ম অনুসারে কিন্তু এই অষ্টমীর দিন দেবীকে মাছ-ভোগ নিবেদন করা হয় এবং পরিবারের সকলে মাছ এবং অন্নই প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন।

নানা রহস্যে মোড়া এই রায়চৌধুরী পরিবারের চন্ডীপুজোর বর্ণনা যতই দেওয়া হোক ততই কম। মেলা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর তাবড় তাবড় শিল্পীরা মঞ্চ মাতাতে আসেন এখানে। নিমকি-গাঠিয়া-ভুজিয়া, অন্যদিকে মালপোয়া-জিভে গজার পাশাপাশি যতদূর চোখ যায় শুধু সারি সারি পসরা। কথায় বলে মেলা হল মেলবন্ধন, তবে যে মেলার সঙ্গে ইতিহাসের যোগ রয়েছে, সেই মেলা যেন পরিণত হয় এক তীর্থভূমিতে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.