যুক্তরাজ্যের স্কুলে কেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়ানো হয় না?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তান- এই তিন দেশের গত তিনশো বছরের ইতিহাস মানেই ব্রিটিশ উপনিবেশের ইতিহাস। প্রায় দুশো বছর ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করেছে ব্রিটিশরা। এই তিন ভূমির ইতিহাস পড়তে গেলে লর্ড ক্যানিং থেকে মাউন্টব্যাটেনের সময়ের কথা আসবেই। তাইতো তিন দেশের পাঠ্যবইয়েও স্থান পেয়েছে তাদের শাসন।


যুক্তরাজ্যের পাঠ্যক্রমে দেশভাগ এবং সাম্রাজ্যটির ইতিহাস অন্তর্ভুক্তকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে পার্টিশন এডুকেশন গ্রুপ, যেখানে কাজ করে যাচ্ছেন একদল গবেষক, শিক্ষক এবং উপদেষ্টা।


এই দলের একজন সদস্য পেপে হার্ট বলেন, 'যুক্তরাজ্যের জাতীয় পাঠ্যক্রমে একটি বড় ফাঁক রয়েছে। এ ইতিহাস নিয়ে জানা কেবল দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের নয়, সাধারণ ইতিহাস হিসেবে নির্বিশেষে সকল ব্রিটিশ শিশুদেরও জানা জরুরি। তার পাশাপাশি বর্ণবৈষম্যকে মোকাবিলা করতেও এই ইতিহাস নিয়ে জানা থাকা প্রয়োজন।'


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলোর পাঠ্যবইয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'প্রায় অনুপস্থিতি' বেশ আলোচিত হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুল-এর ইন্ডিয়ান অ্যান্ড কলোনিয়াল হিস্ট্রি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডেনা হিথ জানান, 'ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমে শিক্ষিত প্রায় সব শিক্ষার্থীর দেশটির এককালীন সাম্রাজ্য সম্পর্কে প্রায় কোনো জ্ঞান নেই।'


তিনি বলেন, 'তারা হয়তো জানেন যে একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল এবং এতে দাসত্ব ছিল। হয়তো উপনিবেশ হিসেবে দুই একটা দেশের নামও বলতে পারবেন, কিন্তু এর চেয়ে তারা বেশি কিছু জানেন না।'


উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইংল্যান্ডের পাঠ্যক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা বলা আছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের পড়াশোনার ধরনটা এমন যে, কোন কোন বিষয় পড়ানো হবে তা স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের ওপরও অনেকটা নির্ভর করে।


শেখানোর বিষয় নির্বাচনে শিক্ষকদের অধিকার খর্ব করার অভিযোগ থেকে বাঁচতে এমন নিয়ম চালু আছে বলে উল্লেখ করেন জনপ্রিয় ওয়েবসাইট দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার-এর লেখক স্টিফেন লাস্কম্বে। তিনি বলেন, "এটি একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা সরকার এবং স্কুল - উভয় পক্ষকে কিছুটা কর্তৃত্ব অনুভব করতে দেয়। তাই নিয়মানুসারে, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বিষয়গুলি 'পড়ানো যেতে পারে' এবং শিক্ষক বা স্কুলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এড়ানোও যেতে পারে।"


এক্ষেত্রে ৫৪ বছর বয়সী সাবেক স্কুল শিক্ষক পেপে হার্ট বলেন, 'ব্রিটিশ শিক্ষকদের যেহেতু এ বিষয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কিংবা আগ্রহ কম, তাই ইতিহাসের এ অংশটুকু উপেক্ষিত রয়ে যায়।'


প্রোপাগান্ডা


সময়টা উনিশ শতক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন স্বর্ণযুগে প্রবেশের পথে। সরকারি কিংবা বেসরকারি স্কুল হোক, তখন ব্রিটেনে কেবল অভিজাত পরিবারের শিশুরাই স্কুলে পড়ত। সেসময়কার পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রীক এবং রোমান সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে পড়ানো হতো। এই দুটো সাম্রাজ্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হতো ব্রিটেনের তৎকালীন রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের গল্প। ব্রিটিশ উপনিবেশকে দেখা হতো সাম্রাজ্য বিস্তারের ধ্রুপদী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারি হিসেবে। এছাড়াও তাদের শেখানো হতো অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আরও প্রসারিত করা যাবে এবং গ্রীক ও রোমানদের চেয়ে কীভাবে আরও বেশি সফল হওয়া যাবে।


ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দেশটির রাজতন্ত্র এবং দেশবাসীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ায়, উনিশ শতকের শেষার্ধ্বে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে স্কুলগুলোতে আগের চেয়ে আরও বিস্তারিত পড়ানো হতে থাকে। তবে ইতিহাসের চেয়ে ভূগোল, ইংরেজি এবং ধর্মশিক্ষা পাঠ্যপুস্তকেই বেশি স্থান দেওয়া হয় এই আলোচনাকে।


ব্রিটিশ বণিকদের 'চমৎকার সমুদ্রযাত্রার গল্প', 'নতুন নতুন স্থান গমন' এবং 'সামরিক বিজয়ের' গল্প ভূগোল, ইতিহাস এবং ইংরেজির মতো বিষয়ের অংশ হিসেবে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে শেখানো হতো। আর ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের বিস্তার এবং 'মিশনারি কার্যকলাপের সাফল্য' পড়ানো হতো ধর্মশিক্ষায়।


১৮৯০-এর দশক থেকে রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটি বলে পরিচিত রয়্যাল কলোনিয়াল ইন্সটিটিউট (আরসিআই) স্কুল সাম্রাজ্য বিষয়ক শিক্ষাদানে মনোযোগ দিতে থাকে।


১৯৮৪ সালে প্রকাশিত প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড এম্পায়ার বইয়ে ইতিহাসবিদ জন এম. ম্যাকেনজি লেখেন, ১৮৮৩ সালে সাম্রাজ্য বিস্তারের ওপর রচনা লেখা প্রতিযোগিতায় স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পুরস্কার হিসেবে অর্থ প্রদানের আয়োজন করে আরসিআই। কিন্তু সমালোচনার মুখে ১৮৮৫ সালে এ ব্যবস্থা বন্ধ করা হয় এবং ১৯১৩ সালে পুনরায় চালু করা হয়।


পাঠ্যক্রমে সাম্রাজ্যবাদ শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য স্কুলগুলোর ওপরও চাপ প্রয়োগ করতে থাকে আরসিআই। এর অংশ হিসেবে ১৮৮০ এবং ৯০-এর দশকে পাঠ্যক্রমে উপনিবেশের ইতিহাস এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রধান শিক্ষকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে শিক্ষকরা এই পরামর্শ গ্রহণ না করলেও উনিশ শতকের শেষের দিকে এসে মোড় ঘুরতে থাকে।


ম্যাকেনজি লেখেন, "১৮৯৬ সালে মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে 'সাম্রাজ্য ভূগোলবিদ্যা' শিক্ষাদানের পরামর্শ দেয় দ্য জিওগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। ১৯০৪ সালে গ্রন্থাকার সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাসে ঔপনিবেশিক সাহিত্য অন্তর্ভুক্ত করে দ্য লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন।"


অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ের ধরনেও প্রভাব ফেলতে থাকে আরসিআই। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত পাঠ্যবইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ম্যাকেনজির বর্ণনানুসারে, এই পাঠ্যবইগুলোতে ঔপনিবেশিক ঘটনাসমূহকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং দ্বন্দ্বের কারণ চাপানো হয় প্রতিপক্ষের ওপর।


উদাহরণস্বরূপ, ১৮৭০ সালে প্রকাশিত দ্য ফোর্থ বুক অব লেসনস ফর দ্য ইউজ অব স্কুলস নামক বইয়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি সুনিপুণভাবেই উপেক্ষা করা হয়। একইভাবে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট হোম বইয়ে আফিম যুদ্ধের জন্য ভারতকে দোষারোপ করা হয়।


পাঠদানের ক্ষেত্রে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কেবল মহিমান্বিত করা নয়, নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতেও শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হতো। যেমন, তাদের কাছে তুলে ধরা হতো, উপনিবেশের শিশুদের স্বার্থ কীভাবে সাম্রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীদের কাছে এমন দৃশ্য উপস্থাপন করা হতো যেখানে সাম্রাজ্যের অধীন দেশের শিশুদের খাদ্য, বস্ত্রসহ মৌলিক চাহিদা তথা দৈনন্দিন জীবন ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল।


ভূগোল পাঠ্যবইগুলোতে থাকত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্র এবং প্রত্যেকটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্বের ব্যাখ্যা।


যুদ্ধপরবর্তী সময় এবং নতুন ইতিহাস


১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে স্কুল শিক্ষার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়লেও সাম্রাজ্য-সম্পর্কিত প্রোপাগান্ডা স্তিমিত হতে শুরু করে। সে বছর দ্য ফিশার অ্যাক্ট নামক আইনের মাধ্যমে স্কুলে অধ্যয়নকাল ১২'র বদলে ১৪ বছর করা হয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।


ব্রিটিশ শিশুদেরকে জার্মান শিশুদের মতো প্রশিক্ষিত করলে যুদ্ধের সময়ে তারা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে - এমন চিন্তাভাবনা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার।


কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও থেকে যায় যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি যা ব্রিটেনের প্রায় সকল নাগরিকের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। সেসময় আবির্ভাব ঘটে শিক্ষকদের একটি নতুন প্রজন্মের, যারা 'অচিন্তন দেশপ্রেম' গ্রহণ করতে অপারগ ছিলেন। তারা ব্রিটেনের জাতীয় ইতিহাস বর্ণনায় আরও সমালোচনামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করতে বদ্ধপরিকর হন।


যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্থানও ইতিহাস শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছিল। স্টিফেন লেখেন, 'সমাজতন্ত্রবাদী ও কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত, রাজা ও সামরিক জেনারেলদের ভূমিকা নয় বরং শ্রমিকশ্রেণী ও নিপীড়িতদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ঠিক এ কারণেই ১৯৩১ সালে পূর্ব লন্ডনে মহাত্মা গান্ধীকে বীর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।


ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তির উৎস এবং গর্বের হেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর মতো জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোতেও এমন মতবাদ প্রচার করা হতো। ফলে যুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা যখন একে একে অধীন দেশগুলো হারাতে থাকল তখন এতদিন ধরে পড়ানো সাম্রাজ্যটির সাফল্য কিংবা গৌরবের ইতিহাসের ওপর একতরফা মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিল।


একে তো সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ, অন্যদিকে যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উত্থান হতে লাগল। তাই দ্বিতীয় যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ইতিহাস শিক্ষাদানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে 'দোদুল্যমান' অবস্থা বজায় থাকে।


ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এই নতুন মোড় অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯৩ সালের এক অনুচ্ছেদে ইতিহাসবিদ ফিলিপ এ. বাকনার লেখেন, '৬০-এর দশক নাগাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বিদেশি প্রজাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করার সমাপ্তি ঘটে। শিক্ষাদানে নতুন ধাঁচের ওপর গুরুত্বারোপ ছিল ব্রিটিশ নীতিনির্ধারণকে আরও সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্মূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা।'


এসময় সাম্রাজ্যের ইতিহাস মনোযোগ হারায় এবং একে 'বিব্রতকর' বলেও গণ্য করা হতে থাকে। এর পরিবর্তে প্রাধান্য পেতে থাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস শিক্ষা।


স্টিফেন জানান, শ্রেণিকক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বর্ণনার এই নতুনত্বে কেবল দাসত্বের ইতিহাস স্থান পেল। অন্যদিকে, বাদ পড়ে গেল বাকি সব বিষয়।


উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ঠিক এসময়েই ব্রিটেনে সাবেক উপনিবেশ থেকে অভিবাসীদের ঢল আসতে থাকল। ব্রিটেন হতে থাকল একটি বহু সংস্কৃতির দেশ। স্টিফেন এই ব্যাপারটিকে বেশ 'আইরনিক' মনে করেন। তিনি লেখেন, 'শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যপুস্তক থেকে সাবেক উপনিবেশের সন্তানরা বাদ পড়ে গেলেন, আর ব্রিটেনে এসে তারাই সেই একই পাঠ্যক্রমে পড়াশোনা শুরু করলেন'।


এভাবেই পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়ে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।


"৮০-র দশক নাগাদ, স্রেফ 'সাম্রাজ্য' শব্দটিই নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়," যোগ করেন স্টিফেন।


'জাতীয় পাঠ্যক্রম' তৈরি


প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সময়ে ইংল্যান্ডে জাতীয় পাঠ্যক্রমের সূচনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, শ্রেণিকক্ষে পঠিত সব বিষয়ের নির্দিষ্ট মানকরণ করা। এক্ষেত্রে ইতিহাসকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। থ্যাচার তার আত্মজীবনীতে লেখেন, 'পাঠ্যক্রমে সংগতি থাকা জরুরি ছিল, অন্তত মূল বিষয়গুলিতে... শিশুরা যা শিখেছে - তা রাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারেনি: আর যা-ই হোক, তারাই ভবিষ্যৎ নাগরিক এবং তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য ছিল।'


থ্যাচারের এই উদ্যোগ ব্যাখ্যা করে স্টিফেন বলেন, "১৯৬০ এবং ৭০ দশকের সরকারগুলো তুলনামূলকভাবে বামপন্থী ছিল। আর তাই ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস অনেকটা জৌলুস হারায়। মার্গারেট থ্যাচার একজন ঐতিহ্যবাদী ছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন 'ব্রিটিশ গর্বের' ধারণা ফিরিয়ে আনতে।


থ্যাচারের এই পরিকল্পনায় ইতিহাসের শিক্ষকরা কিছুটা সতর্কতার সাথে প্রতিক্রিয়া দেখান। পরে সরকার ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়; একটি 'অর্পিত সিলেবাস' অনুসরণ করবেন না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন শিক্ষকরা। এর পাশাপাশি, শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন সে সম্পর্কে শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার দাবি করেন তারা।


ইতিহাস বিষয়ের পাঠ্যক্রম নিয়ে থ্যাচার যে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন, সেটিই ছিল তার জন্য কঠিনতম লড়াই - এমনটাই তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন এই লৌহমানবী।


একসময় দুই পক্ষের আপসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে শিক্ষকরা জাতীয় পাঠ্যক্রম মেনে নেন, তবে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তারা শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন সে ব্যাপারে স্বাধীনতার প্রতি জোর দেন।


ফলস্বরূপ, পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হিসেবে একটা দীর্ঘ তালিকা প্রদান করা হয়, যেগুলো থেকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় শিক্ষকরা তাদের ইচ্ছামতো বাছাই করতে পারতেন। এই কাঠামোতে দাসত্বের ইতিহাস ব্যতীত আবারও অর্থপূর্ণভাবেই উপেক্ষিত রয়ে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।


বর্তমানে প্রথম থেকে তৃতীয় (পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সী) শ্রেণিতে ২০১৩ সালের সংশোধিত জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসারে পড়ানো হয়। তৃতীয় এবং এ-লেভেলের পাঠ্যবিষয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অন্তর্ভুক্ত, যেখানে 'ব্রিটেন, ১৭৪৫-১৯০১'-এর অংশ হিসেবে পড়ানো হয় সাম্রাজ্যের নীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা, শিল্প এবং সাম্রাজ্য। বিষয়গুলো ঐচ্ছিক হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা এসব বিষয় এড়িয়ে যেতে পারেন এবং যানও বটে।


আরেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সে ইতিহাস শিক্ষাব্যবস্থা ভিন্ন ধাঁচের। সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, কোন কোন বিষয়ের ওপর পাঠদান চলবে। এতে ব্রিটিশদের পাশাপাশি ডাচ, পর্তুগিজ এবং বেলজিয়ান সাম্রাজ্য নিয়েও পড়ানো হয়।


যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ওপর গুরুত্বারোপ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে লেবার পার্টি ও কনজার্ভেটিভ পার্টি - উভয়ই এই বিষয়ে বেশ সতর্ক।


যেমন, ২০১৮ সালে লেবার পার্টির নেতা জেমস করবিন স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, উপনিবেশবাদ ও দাসত্বের ইতিহাসের পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস আরও বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন।


তবে এ ব্যাপারে হিথ বলেন, 'এমন কোনো ব্রিটিশ সরকার আসেনি যারা ইতিহাস শিক্ষায় কোনো অর্থবহ ও সমালোচনামূলক পদ্ধতিতে সাম্রাজ্যের পাঠদানের ব্যবস্থার কথা বলেছে।'


পেপে হার্ট বিশ্বাস করেন, ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার দরুন সাম্রাজ্যবাদী অতীতের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পাঠ্যপুস্তকের সংস্কারের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা অপরিহার্য।


এই কাজটিই করছে পার্টিশন এডুকেশন গ্রুপ। হার্ট জানান, 'আমরা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসের প্রধান প্রধান ব্যক্তিত্ব ও ঘটনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, যেমন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং ভারত কীভাবে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ইত্যাদি।'


তবে হার্ট মনে করেন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে শিক্ষাদানের ব্যাপারে শিক্ষকদের চেয়ে পাঠ্যক্রম নীতির উপদেষ্টারাই বেশি উদাসীন।


তিনি বলেন, 'বর্তমানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইতিহাস পাঠ্যক্রমের একটি লুকানো অংশ হয়ে রয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয়দের তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানার অধিকার আছে এবং ইতিহাসের সমান অংশীদার হিসেবে যুক্তরাজ্যের শিশুদের জন্যেও তা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উচিত ইতিহাস শিক্ষায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পাঠ বাধ্যতামূলক করা।'

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.