গাছের ভেতরেই মদের আসর!

ODD বাংলা ডেস্ক: আরবি শব্দ বু-হেবাব থেকে বাওবাব শব্দের জন্ম। আফ্রিকায় যাতায়াতকারী আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এই নামটির প্রসার ঘটে। তবে আরো ভিন্ন কিছু নাম আছে গাছটির। সুদানে গাছটি তাবালদি নামে পরিচিত। এর গুণকার্য বিচার করে ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘ট্রি অব লাইফ’। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম হল এডানসোনিয়া ডিজিটেটা।

প্রাগৈতিহাসিক এই বাওবাব গাছটি মূলত মাদাগাস্কার ও আফ্রিকার স্থানীয়। তবে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইয়েমেন, ওমান, মালয়েশিয়া, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও গাছটির দেখা মেলে। বাংলাদেশের বড় কিছু জঙ্গলেও এর কয়েকটি গাছ আছে। তবে সেগুলোর বয়স কম।

এডানসোনিয়ার মোট নয়টি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে ছয়টি মাদাগাস্কারের, দুটি আফ্রিকার ও একটি অস্ট্রেলিয়ার। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার গাছগুলোর প্রজাতি অনেকটা একই রকম। জিনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারাও এদের আলাদা করা যায়না। নয়টি প্রজাতির মধ্যে চারটির ফুল রঙিন ও পাঁচটির সাদা। গাছটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল গাছটির আকার। একাহারা গড়নের গাছটির কান্ড মাটি থেকে লম্বা হয়ে সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে। গাছের একেবারে মাথায় ছড়িয়ে রয়েছে ঝোপঝাড়ের মত কিছু ডালপালা। যা দেখতে অনেকটা ছাতার মত। উচ্চতায় গাছটি প্রায় ৭৫-৮০ ফুট লম্বা হয়। গাছটির কান্ডের ব্যাস সর্বোচ্চ ৪৫ ফুট। গাছের পাতাগুলো দেখতে অনেক ভিন্ন। দূর থেকে গাছটি দেখলে মনে হবে গাছটি উপড়ে নিয়ে এর মাথার দিকটি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। পাতাগুলোকে মনে হবে গাছের শেকড় যা উপরের দিকে ছড়িয়ে রয়েছে।

গাছটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল বছরের বারো মাসের মধ্যে নয় মাস এই গাছে কোনো পাতা থাকেনা। শীতকালে যখন এর পাতা ঝরে যায় তখন গাছটিকে মরা গাছের ন্যায় মনে হয়। গ্রীষ্মের শেষে গাছটিতে নতুন পাতা জন্মায়।

মরু অঞ্চলের গাছ হওয়ায় খুব কম পানিতেই এদের প্রয়োজন মিটে যায়। বর্ষাকালে এই গাছ তার দীর্ঘ কান্ডের মধ্যে পানি জমিয়ে রাখে। হাতিরা খুব বেশি তৃষ্ণার্ত হলে তাদের লম্বা দাঁতের মাধ্যমে গাছের বাকল খুলে ভেতরের স্পঞ্জি নরম ও রসালো ত্বক খায়। এরা ২০-৩০ হাজার লিটার পানি নিজেদের ত্বকে জমিয়ে রাখতে পারে।

প্রকৃতির বিভিন্ন বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়ে গাছটি বেঁচে থাকে অনেক বছর। খোলা জায়গায় বজ্রপাত সেখানকার উঁচু গাছে ঘটে। যার স্বীকার হয় বাওবাব গাছগুলো। তবে এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেঁচে থাকে। এদের বাকলে প্রচুর ট্যানিন থাকে ফলে আগুন নির্বাপিত হয়ে যায়।

বোতলের মত চিকন গলা ও ঝুঁটিতে কিছু ডালপালা দেখতে কিম্ভূতকিমাকার এই গাছের বয়স বেড়ে গেলে নিজ থেকেই এর গোড়ায় খোড়ল সৃষ্টি হয়। যথেষ্ট বিস্তৃত হওয়ার কারণে আফ্রিকায় এই খোড়লগুলো বাড়িঘর, পোস্ট অফিস, রেস্টুরেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একসময়ে ঘানায় এই গাছ ক্রীতদাসদের জেলখানা ও কবরস্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।

মরু অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকারে আসে এই গাছটি। আফ্রিকাবাসীদের জন্য খোড়লের সবচেয়ে বড় ব্যবহার ছিল দুর্দিনের জন্য জল সঞ্চয়। গাছের গায়ে খানিকটা উঁচুতে গর্ত করে ভেতরের খোড়লে জলাধার বানিয়েছে অনেকে। অনেক সময়ে লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রয়োজন মত কেটেকুটে স্টোরের আকার করে নিয়েছে অনেকে। বৃষ্টির পর সাময়িক জলাধার থেকে পানি বয়ে নিয়ে বাওয়াব স্টোরের ভেতরে রেখেছে তৃষ্ণার্ত দিনের সহায়ক হিসেবে। অনেক বেশি বয়স হয়ে গেলে খোড়লের ভিতের দিকে পচন ধরতে শুরু করে। এরপর গাছের মৃত্যু হয় ও গাছটি ভেঙে পড়ে।

গাছটির প্রতিটি অংশ সরাসরি মানুষের কাজে আসে। গাছের বাকল দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়। এছাড়া গাছটির আশ থেকে দড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়াও গাছের ছাল ঘর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তবে এতে গাছের কোনো ক্ষতি হয়না।

গাছটির ফল খাওয়া যায়। ফলগুলোতে রয়েছে প্রচুর ফাইবার, কমলার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে বেশি পটাশিয়াম ও ব্লুবেরির চেয়ে বেশি এন্টি অক্সিডেন্ট। ফল সংগ্রহের সুবিধার জন্য উঁচু এই গাছের গর্ত করা হয় বা খুটি পোঁতা হয়। যা ক্যানপিতে চড়ার সহায়ক। তবে অদ্ভুতভাবে গাছে চড়ে ফল সংগ্রহের এই কাজটি নির্বাচিত কিছু মানুষ করতে পারে।

বাওবাবের ফল সময়মত সংগ্রহ না করলে তা ৬ মাস পর্যন্ত গাছে ঝুলে থাকে। এই শুকনো ফলের পাউডার খাওয়া যায়, যা নষ্ট হয়না। বর্তমানে এই শুকনা পাউডারগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে। কোনো প্রকারের প্রিজারভেটিভ ছাড়াই এটি ৩ বছর ভালো থাকে। ইউরোপ সহ পশ্চিমা দেশগুলোতে দিন দিন এই পাউডারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে নতুন করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাওয়াব গাছ লাগানোর প্রয়োজন অনুভব করছে বিশেষজ্ঞরা।

বাওবাব গাছের পাতাও খাওয়া হয়। মালি'র আঞ্চলিক ভাষায় পাতাগুলো ‘লালো’ নামে বিক্রি করা হয়। এছাড়া এর পাতা থেকে তৈরি হয় চাটনি। এই গাছের পাতা দিয়ে বিভিন্ন ওষুধও তৈরি করা হয়।

গাছের গুড়ি এত বড় যে এর গর্তে মানুষ বাস করতে পারে। মরুর ঝড়ে সেখানকার মানুষ এই গাছের গুড়ির গর্তে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাওবাব গাছকে মালিকানাহীন অবস্থায় পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা এদের পরিচর্যা করা হয়। বাওবাব গাছের বয়স নির্ধারণ করতে কার্বন ডেটিংয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। যা সামান্য কয়েকটি গাছে করা হয়েছে। যে কয়েকটি বাওবাব গাছের বয়স নির্ধারণের জন্য গবেষণা করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল ‘সুনল্যান্ড বাওবাব’। আফ্রিকার লিম্পোপো প্রদেশে গাছটি অবস্থিত। এই গাছটির বয়স ৬,০০০ বছর।

সুনল্যান্ড বাওবাব গাছটির ভেতরে রয়েছে একটি বার। গাছের গুড়ির গর্তে তৈরি করা এই বারটি ‘ভ্যান হার্ডিন’ নামক এক পরিবারের মালিকাধীন। ১৯৯৩ সাল থেকে এই বারটি একই জায়গায় আছে। গাছটির ভেতরে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি প্রবেশ পথ আছে যা ১৩ ফুট উঁচু ও এর ব্যস ৩৫ ফুট। একসঙ্গে ১৫ জন লোক এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। গাছটি এখন আর তার আগের অবস্থানে নেই। তবে পৃথিবীর জনপ্রিয় স্থানগুলোর তালিকায় রয়েছে এই স্থানের নাম।

তবে ইদানিং মাদাগাস্কারে কৃষিক্ষেত্র তৈরির কারণে গাছের আশেপাশে জলাজমির সৃষ্টি হয়েছে যা বাওবাবের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। বাওবাব নিয়ে সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা এখন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় লিপ্ত। পৃথিবীর বহু জায়গায় বিশেষত আফ্রিকায় এদের প্রচুর ফলন সম্ভব যা আমাদের দিতে পারে অতিরিক্ত স্বাদ ও পুষ্টি। এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে প্রচুর কর্মসংস্থান, যা কিছু অবহেলিত দরিদ্র জাতিকে আর্থিকভাবে ওপরে টেনে তুলতে পারে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটি হিসেবে বলা হয়েছে পৃথিবীব্যাপী বাওবাবের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকায় যে ফসল তৈরি হতে পারে তার বাৎসরিক মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ফরাসি উদ্ভিদবিদ এডান্সন বলেন, তিনি জীবনে যত গাছ নিয়ে গবেষণা করেছেন তার মধ্যে বাওবাব সবচেয়ে উপকারী গাছ। সুস্থ শরীর বজায় রাখার জন্য তিনি নিজেও দিনে দু’বার এর ফল খেতেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.