একজন সন্ন্যাসীর কি সত্যিই তাঁর মা-বাবার প্রতি কর্তব্য থাকে না, স্বামীজী কী বলেছিলেন


ODD বাংলা ডেস্ক: আমেরিকা থেকে স্বামী সারদানন্দকে ২০মে ১৮৯৪ তারিখে লেখা একখানি চিঠিতে স্বামীজী লিখেছেন, “তুমি কি বলিতে চাও আমি একজনের বন্ধনের সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন বিবাহ করে আমি তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখিব না। এ বিষয়ে আমি স্থির সংকল্প। এখন বিদায়।” (পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৩৫)

আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন পথের পথিক মনে হলেও স্বামীজী মহেন্দ্রানাথের জীবনপথের প্রতি স্নেহপূর্ণ এবং তীক্ষ্মদৃষ্টি রেখেছিলেন। লুসার্ন থেকে ২৩শে আগস্ট ১৮৯৬ তারিখে স্বামীজী একখানি চিঠিতে তাঁর বন্ধু মিঃ স্টাডিকে জানাচ্ছেন, “মহিম ও ফক্সের সঙ্গে এর পর যখন দেখা হবে, দয়া করে তাদের আমার ভালবাসা জানিও।” (পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ৪৮৩।)

৬৩ নং সেন্ট জর্জিয়া রোড, লন্ডন থেকে স্বামীজী বিদেশিনী শিষ্যা মিসেস বুলকে লেখা ৫ই জুন, ১৮৯৬ তারিখের চিঠিতে মহেন্দ্রানাথের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে স্বামীজী জানাচ্ছেন-“I do not like any one whom I love to become a lawyer, although my father was one. . . . What my nation wants is pluck and scientific genius, so I want Mohin to be an electrician. Even if he fails in life, still I will have the satisfaction that he strove to become great and really useful to his country. . . . . I want him to be daring, bold and struggle to cut a new path for himself and his nation. . .” (Complete Works of Swami Vivekananda Vol.6, Page 363, Second reprint of the subsidized Edition, March 1989, Advita Ashram.)

এই চিঠিতে আমরা জানতে পারি যে স্বামীজ চেয়েছিলেন, মহেন্দ্রনাথ ওকালতি না পড়ে একজন ইলেক্ট্রিসিয়ান হন। আরও জানতে পারি তিনি জানাচ্ছেন, “যাকে তিনি ভালবাসেন, তার উকীল হওয়া তিনি পছন্দ করেন না।”

পরর্বতী জীবনে যদিও মহেন্দ্রনাথ Electrician হননি, কিন্তু দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে অকুতোভয়ে ভ্রমন করেছেন,পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশ্ব-প্রকৃতি আর মানব সমাজকে। এই সম্বন্ধেও স্বামীজীর আর একখানি চিঠি পাই। প্যারিস থেকে ইংরাজী ১৪ই আগস্ট ১৯০০ সালে বিবেকানন্দ (SWAMI VIVEKANANDA) জন ফক্সকে ইংরাজীতে লেখা এক চিঠিতে জানাচ্ছেন-

“Kindly write Mohin that he has my blessings in whatever he does. And what he is doing now surely much better than lawyering, etc. . . Only as my health is failing and I do not expect to live long, Mohin must see his way to take care of mother and family. I may pass away any moment. I am quite proud of now.” (Complete Works of Swami Vivekananda Vol.8, Page 531-532, First reprint of the subsidized Edition, January 1989.)

দেহত্যাগের দুবছর আগে লেখা এই চিঠির আদেশ মহেন্দ্রনাথ পালন করেছিলেন গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটে ফিরে এসে রত্নগর্ভা মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর এবং স্বামীজীর আত্মীয়-স্বজনদের তত্ত্বাবধানের জন্য। অবশ্য মা এবং পরিবারের লোকেদের দেখাশুনা করা ছাড়াও মানব সমাজ, বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ের উপর জাতির নব পথপ্রর্দশনের চিন্তারাজি গ্রথিত করেছেন প্রায় একশখানি গ্রন্থে।


প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করলেও বিবেকানন্দ (SWAMI VIVEKANANDA) পারিবারিক দায়িত্ব অবহেলা করতে চাননি। পারিবারিক দুরবস্থা তাঁকে ব্যথিত করত। শ্রীপ্রমদাদাস মিত্র মহাশয়কে ৪ঠা জুলাই ১৮৮৯ তারিখে একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “আমার মাতা ও দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জেষ্ঠ, মধ্যমটি ফার্ষ্ট আর্টস পড়িতেছে আর একটি ছোট, ইহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল। কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্য্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমন কি কখনও কখনও উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল, হাইকোর্টে মোকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন- যে প্রকার মোকদ্দমার দস্তুর। কখন কখন কলিকাতার নিকট থাকিলে তাহাদের দুরবস্থা দেখিয়া রজোগুণের প্রাবল্যে অহংকারের বিকার স্বরূপ কার্য্যকারী বাসনার উদয় হয়। সেই সময় মনের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ বাধে, তাহাতেই লিখিয়াছিলাম , মনের অবস্থা বড়ই ভয়ঙ্কর। এবার তাহাদের মামলা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া তাহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্ব্বাদ করুন।”

পরমহংসদেবের ভাবশিষ্য হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দেশে দেশে ফিরে প্রায় বিশ বছর ধরে “ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে” কতই না ভ্রমণ করেছেন। নবজাগরণের কল্যাণপ্রদ মহাভব ও শুভধর্মের যুগান্তকারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে এসেও ভুলতে পারেননি- গর্ভধারিণী মাতৃদেবী ভুবনেশ্বরীকে, সহোদর ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথকে, আর নিজ পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের। সেই জন্যই বোধহয় ১৯০০ সালের ২৫শে আগস্ট তারিখে কন্যাসম শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতাকে লিখলেন, “আমি এইবার সম্পূর্ণ অবসর নিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি মায়ের ইচ্ছা আমি আমার আত্মীয়দের জন্য কিছু করি। ভাল, বিশ বছর আগে যাত্যাগ করেছিলুম, আনন্দের সঙ্গে তা ঘাড়ে নিলাম।”

উপরের ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে সংসারের প্রতি সমস্ত  আসক্তি তাঁর চলে গেলেও স্বামীজী নিজের পিতা-মাতাকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় ছিলেন। তাঁর দেহ ত্যাগের পর তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সে কারনে তিনি দাদা মহেন্দ্রনাথ দত্তকে সমস্ত কথা বলে দিয়ে গিয়েছিলেন। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.