যেভাবে পাওয়া গিয়েছিল শেষ মোগল সম্রাটের সমাধি

 


ODD বাংলা ডেস্ক: এক শতাব্দী চলে গেছে। মানুষ ভুলতে বসেছিল শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের কথা। কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করে তার কবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর তাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে আগ্রহ মাথা চাড়া দেয়। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর নিজে একজন সুফি সাধক ছিলেন এবং ছিলেন ঊর্দু ভাষার প্রথিতযশা একজন কবি।

১৮৬২ সালে তদানীন্তন রেঙ্গুনে একটা জরাজীর্ণ কাঠের বাড়িতে তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তার পাশে ছিলেন পরিবারের অল্প কয়েকজন সদস্য। যে ব্রিটিশদের হাতে তিনি বন্দী ছিলেন, তার মৃত্যুর দিনই তারা বিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডার কাছে এক চত্বরে অজ্ঞাত এক কবরে তাকে দাফন করে।


পরাজিত, অপমানিত ও হতোদ্যম দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের জন্য সেটা ছিল তিনশো বছরের গৌরবোজ্জ্বল মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবহীন পতনের এক অধ্যায়। তার মোগল পূর্বপুরুষরা তিনশো বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে- যার মধ্যে ছিল বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বাংলাদেশ।


তার পূর্বপুরুষদের তালিকায় রয়েছে সম্রাট আকবর বা ঔরঙ্গজেবের নাম ও তাদের বর্ণময় শাসনকালের ইতিহাস। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের শাসনকাল হয়ত তেমন গৌরবোজ্জ্বল ছিল না কিন্তু তার ক্ষমতাকাল জড়িয়ে গিয়েছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহের’সঙ্গে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীতে বিশাল অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।


ঐ অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার পর সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার দায়ে মামলা করা হয়, তাকে বন্দী করা হয় ও ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানের মিয়ানমারে তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়।

বন্দী অবস্থায় ১৮৬২ সালের ৭ই নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার কবিতাগুলো মরেনি। তিনি লিখতেন ‘জাফর’ছদ্মনামে। জাফরের অর্থ বিজয়। ১৭০০র শেষ নাগাদ বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসে। সেই সময় এলাকায় মোগলদের প্রতিপত্তিও কমতে থাকে। ১৮৩৭ সালে জাফর যখন সিংহাসনে বসেন তার রাজ্য ছিল শুধু দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকা জুড়ে। কিন্তু তার প্রজাদের কাছে তিনি সবসময়ই ছিলেন বাদশাহ্।


অন্যান্য মোগল সম্রাটদের মত তিনিও মঙ্গোলীয় শাসক চেঙ্গিস খান এবং তৈমুর লংএর প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন। তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি শাসকগোষ্ঠীর শাসনকালের অবসান ঘটেছিল। সমর্থকদের তার কাছ থেকে দূরে রাখতে ব্রিটিশরা তার কবর নাম-পরিচয়হীন রেখে দেয়। তার মুত্যুর খবর ভারতে পৌঁছায় দুই সপ্তাহ পরে এবং সে খবর প্রায় লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়।


১৯৯১ সাল আকস্মিকভাবে তার কবর উদ্ধার হবার পর অবিভক্ত ভারতের কিংবদন্তী শেষ মোগল সম্রাট আবার ফিরে আসেন মানুষের স্মৃতিপটে। ১৯৮০র দশকে ভারতের একটি টেলিভিশনে ধারাবাহিক তৈরি হয় তার জীবন ও কর্ম নিয়ে। দিল্লি এবং করাচিতে তার নামে রাস্তা আছে, ঢাকায় একটি পার্কের নামকরণ হয় তার নামে। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল, যিনি ‘লাস্ট মুঘল’ বইটির লেখক, তিনি বিবিসিকে বলেছেন ‘জাফর একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন।ইসলামী শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি, এবং সুফি পীর জাফর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে গভীর গুরুত্ব দিতেন। জাফর কখনো নিজেকে বীর বা বিপ্লবী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, তার ব্যক্তিত্বও সে ধরনের ছিল না, কিন্তু তার পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবরের মত তিনিও ইসলামী সভ্যতার একজন আদর্শ প্রতীক ছিলেন, যে সময় ইসলামী সভ্যতা তার উৎকর্ষে পৌঁছেছিল এবং সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।’


জাফরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পেছনে অনেক ঐতিহাসিক বলেন বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তার মিশ্র ধর্মের পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। তার বাবা ছিলেন দ্বিতীয় আকবর শাহ্ আর মা ছিলেন হিন্দু রাজপুত রাজকুমারী লাল বাঈ।


১৮৫৭য় অবিভক্ত ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। ১০ মে উত্তর ভারতের মেরাট শহরে ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি, আগ্রা, লক্ষ্মৌ ও কানপুরে। নতুন সংস্কার, আইন, পশ্চিমা মূল্যবোধ এবং খ্রিস্টান ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদে ছিল এই বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম সৈন্য, যারা তদানীন্তন মোগল সম্রাট, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্‌ জাফরকে তাদের নেতা মেনে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ জেনারেলরা তাদের বিদ্রোহ দমনে মোতায়েন করেছিলেন পাঞ্জাব থেকে শিখ সৈন্য এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পাঠান সৈন্যদের। দিল্লির নিয়ন্ত্রণ তারা আবার নেন সেপ্টেম্বরে।

দুই পক্ষ থেকেই নির্বিচার হত্যার অভিযোগ ছিল। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছিল। ব্রিটিশদের হাতে নিহত হয়েছিল হাজার হাজার বিদ্রোহী ও তাদের সমর্থকরা। ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে এই বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। একই বছরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বিলুপ্ত করে দেয়া হয় এবং ভারত ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনের আওতায় আসে।


ইয়াঙ্গুনের নিরিবিলি এক রাস্তায় রয়েছে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের দরগা। ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে আবেগময় একটা সময়ের নীরব সাক্ষ্য বহন করছে বাহাদুর শাহ্ জাফরের এই সমাধিসৌধ। স্থানীয় মানুষ যদিও জানতেন স্থানীয় সেনা ক্যান্টনমেন্ট চত্বরের ভেতর কোথাও কবর দেওয়া হয়েছিল ভারতের শেষ মোগল সম্রাটকে, কিন্তু ১৯৯১ সালের আগে কেউ জানতে পারেনি কোনটি ছিল তার কবর। সেখানে তার পরিবারের সদস্যদেরও কবর দেয়া হয়েছিল।


যেভাবে পাওয়া গেল সমাধি: সেখানে একটি ড্রেন পাইপের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় কিছু শ্রমিক একটি ইটের স্থাপনা দেখতে পায়, যেটি সাবেক সম্রাটের কবরের অংশ বলে জানা যায়। এরপর জনসাধারণের দানের অর্থ দিয়ে তা সংস্কার করা হয়। ভারতে জাফরের পূর্বপুরুষদের যেসব জমকালো সমাধি রয়েছে তার তুলনায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্‌ জাফরের এই সমাধিটি খুবই সাদামাটা। লোহার ফটকের গ্রিলে তার নাম ও পরিচয় রয়েছে। একতলায় রয়েছে তার একজন স্ত্রী জিনাত মহল এবং তার নাতনি রৌনক জামানির কবর। সমাধিগৃহে এর নিচে রয়েছে জাফরের কবর- তার ওপর ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এসে ছড়িয়ে দেন গোলাপ ও অন্য ফুলের পাপড়ি।


সম্রাট হিসাবে বাহাদুর শাহ্‌ জাফর কোন সেনাদলের নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যরা তাকে নেতা মেনে ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করেছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে দুই ধর্মের হাজার হাজার মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর হয়ত তার রাজ্য, ক্ষমতা ও উপাধি হারিয়েছিলেন, কিন্তু একজন সুফি-সাধক, কবি ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে তিনি সফল হয়েছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.