প্রাণীদের মতো মানুষের শরীর লোমশ নয় কেন!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: যদি কোনো ভিনগ্রহের এলিয়েন পৃথিবীতে এসে অন্যান্য প্রাইমেট বর্গের সাথে মানুষকে পাশাপাশি রেখে পর্যবেক্ষণ করে, তবে প্রথমেই যে জিনিসটি চোখে পড়বে তা হলো লোমবিহীন শরীর।


অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের দেহে লোম নেই বললেই চলে। নেকেড মোল র‍্যাট, গণ্ডার, তিমি কিংবা হাতির মতো সামান্য কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে আমরা এই লোমবিহীন অবস্থায় পৌঁছেছি? এর ফলে কি আমাদের কোনো উপকার হয়েছে? আর কেনই বা আমাদের শরীরের বেশ কিছু জায়গায় লোম ঘন হয়ে এখনো টিকে রয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসি'র এ লেখায়।


মানুষের লোমের সংখ্যা যে কম, তা নয়। আমাদের ত্বকের উপরিভাগে গড়ে পঞ্চাশ লক্ষ হেয়ার ফলিকল রয়েছে। কিন্তু মানবশরীরের বেশিরভাগ হেয়ার ফলিকলই ভেলাস হেয়ার উৎপাদন করে। এই ধরনের লোমগুলো ছোট আর মসৃণ হয়, যেগুলো গভীরে থাকা লোমের চেয়ে ভিন্ন। ঘন শক্ত লোম কেবল আমাদের মাথাতেই দেখা যায়, এবং বয়ঃসন্ধিকালের পর জঙ্ঘা, বগল এবং মুখের নিচে (ছেলেদের ক্ষেত্রে)।


ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার বায়োলজিকাল অ্যান্থ্রপোলজিস্ট টিনা লাসাসির মতে, "বাস্তবে আমাদের পুরো শরীরেই লোম আছে, কিন্তু সেগুলো খুবই ছোট আকারের। এগুলো এতই ছোট যে সেগুলো আর দেহের তাপ ধরে রাখার মতো কার্যকরী নয়।"


বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না ঘন শক্ত আর মোটা লোম কীভাবে সূক্ষ্ম পাতলা ছোট লোমে রূপান্তরিত হলো, এবং কবে এই রূপান্তর হয়েছে তাও তাদের জানা নেই। তবে আমাদের লোম কীভাবে পাতলা হয়ে এল তা নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব রয়েছে।


বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হলো তথাকথিত 'বডি-কুলিং' হাইপোথিসিস, যেটি 'সাভানা' হাইপোথিসিস নামেও পরিচিত। এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী, মানুষ তার শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে গিয়েই তাদের শরীর থেকে লোম ফেলে দেয়। প্লেস্টোসিন যুগে হোমো ইরেকটাস এবং পরবর্তীকালে হোমিনিনরা মুক্ত সাভানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাড়া করে তাদের শিকারকে ক্লান্ত করে ফেলত। ফসিল রেকর্ড থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, সে সময় মানুষের আদি প্রজাতির কাছে উন্নত অস্ত্র ছিল না। ক্রমাগত তাড়া করার ফলে তাদের শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। এ কারণে তাদের শরীরের লোম কমে যায় এবং ঘাম তৈরি হয়। ঘামের ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় আরও ভালোভাবে এবং কোনো ধরনের বিরতি ছাড়াই তারা একটানা দৌড়ে বেড়াতে পারত।


এই তত্ত্ব আবির্ভূত হওয়ার পেছনের কারণ জিনের মধ্যে থাকা বেশ কিছু সুইচ, যেগুলো নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট কিছু কোষ হেয়ার ফলিকলে রূপান্তরিত হবে নাকি ঘামের গ্রন্থিতে রূপান্তরিত হবে। লাসাসি বলেন, "তাই ধারণা করা যায়, এই সবকিছুর পেছনে একটি সম্পর্ক রয়েছে। যদি আমরা এই যোগসূত্র মেলাই এবং ত্বকের পিগমেন্টেশন বাড়ানোর জ্বিন সম্পর্কে অনুমান করি, তবে ধারণা করা যায় আনুমানিক দুই থেকে দেড় মিলিয়ন বছর আগে আমরা আমাদের শরীরের লোম হারিয়েছি।"


১৯৮০-এর দশকে আরও একটি তত্ত্ব হাজির করা হয়, যেখানে বলা হয় মানুষ যখন সোজা হয়ে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করে তখন শরীরের লোমের কার্যকারিতা কমে যায়, কারণ তখন সূর্যের আলো পুরো শরীরে না পড়ে কেবল মাথায় পড়া শুরু হয়। যেহেতু আমরা লোম ছাড়াই ভালোভাবে ঘামতে পারি, তাই লোম থাকার চেয়ে না থাকা আরও বেশি উপকারী হয়ে ওঠে।


রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্ক পাগালের মতে, এই তত্ত্বের তুলনায় বডি কুলিং হাইপোথিসিস আরও যৌক্তিক এবং এর পেছনে কিছু প্রমাণও রয়েছে।


"যখন আপনি আপনার শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করবেন, তখন দেখবেন আমরা রাতে আমাদের চাওয়ার চাইতেও বেশি তাপমাত্রা হারাই। অর্থাৎ, আমাদের লোম হারানোর ফলে আমরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তি হারাচ্ছি।" পাগাল জানান, পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শীতল অঞ্চলে থাকলেও তারা তাদের হারানো লোম ফিরে পায়নি।


অন্যদিকে, লাসাসি জানান হাইপোথার্মিয়ার তুলনায় মধ্য আফ্রিকায় হওয়া হাইপারথার্মিয়া (অস্বাভাবিক বেশি তাপমাত্রা) আরও বড় সমস্যা, যেখানে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে। তার মতে, "আমার মনে হয়, শরীর গরম রাখার চাইতে শরীর যাতে অতিরিক্ত গরম না হয়, সেই প্রবণতাই আরও বেশি ছিল।"


তার মতে, মানুষের অনেক জ্বিনগত বৈশিষ্ট্য ফিরে না আসার কারণে তার বিকল্প মানুষ ততদিনে খুঁজে বের করে ফেলেছে। যখন মানুষ শীতল অঞ্চলে পৌঁছায়, ততদিনে তারা আগুন আর কাপড়সহ নিজেদেরকে গরম রাখার অন্যান্য প্রযুক্তি বের করে ফেলেছে।


২০০৩ সালে পাগাল এবং তার সহযোগী ওয়াল্টার বডমার মানুষের বিবর্তনের সময় লোম হারানোর আরেকটি কারণ ব্যাখ্যা করেন, যেটির নাম তারা দেন 'এক্টোপ্যারাসাইট হাইপোথিসিস'। তাদের মতে, লোমবিহীন দেহ পরজীবীদের হাত থেকে আরও ভালোভাবে মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছে।


পাগাল বলেন, "যদি আপনি সারাবিশ্বের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন পরজীবীরা এখনো বেশ বড় একটি সমস্যা, এবং অনেক পরজীবীর কারণে বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। এছাড়াও বিভিন্ন পরজীবী লোমে বাসা বাঁধতে পারে। বিবর্তনীয় ইতিহাসে এই পরজীবীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।"


লাসাসি অবশ্য অন্যান্য কারণগুলোকেও একেবারে বাদ দেননি। তিনি প্রশ্ন করেন, "আপনার নিজেকেই প্রশ্ন করা উচিৎ, কেন এই লোম হারানো কেবল মানুষের মধ্যেই হলো? শিম্পাঞ্জি, বনোবো বা গরিলার মধ্যে কেন হয়নি? আমি বিশেষ আচরণ বা মাইগ্রেশনে নজর দিতে চাই, যে জিনিসটি মানুষকে অন্যান্য বানরপ্রজাতি থেকে তাদেরকে আলাদা করেছে এবং লোম হারানো প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।"


এর একটি কারণ হতে পারে অন্য প্রাণীর চামড়া থেকে কাপড় তৈরি করা যেটি খোলা যেত এবং পরিষ্কার করা যেত। তবে যদি মানবশরীরে বাসা বাঁধা পোকার আবির্ভাব হিসাব করা হয়, তবে এই লোম হারানোর বয়স বড়জোর এক থেকে দুই হাজার বছর হবে, যেটি বডি কুলিং হাইপোথিসিস অনুযায়ী হিসাবের অনেক পরে।


এদিকে চার্লস ডারউইন শরীরের লোম হারানোর কারণ হিসেবে প্রজননে সঙ্গীর বাছাইকরণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার মতে, প্রাচীনকালের মানুষেরা তাদের প্রজননসঙ্গী হিসেবে কম লোম থাকা সঙ্গীকেই পছন্দ করতেন, যে কারণে ধীরে ধীরে মানুষের শরীরে লোম কমে গিয়েছে। তবে বর্তমান গবেষকদের বেশিরভাগই এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন।


তবে যখন মানুষের লোমহীনতার প্রশ্ন চলেই আসে, তখন আরেকটি প্রশ্নের উদয় হয়, আমরা কেন এখনো মাথা, বগল এবং জঙ্ঘাদেশের চুল ধরে রেখেছি?


এই বিষয়টি নিয়েই পিএইচডি করা লাসাসি জানান, "মানুষের মাথায় কেন এখনো চুল রয়েছে, বিশেষ করে ঘন আঁকাবাঁকা চুল, তার সম্ভাব্য কারণ সূর্যের বিকিরণ থেকে মাথাকে রক্ষা করা। সূর্যের রশ্মি যেখানে পড়বে অর্থাৎ চুলের সবচেয়ে ওপরের অংশ, যত ওপরে থাকবে মাথার ত্বকের জন্য সেটি তত ভালো।"


বগল এবং জঙ্ঘাদেশের লোম অবশ্য কেন টিকে রয়েছে তা সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারেননি লাসাসি। তার মতে, প্রাইমেট পূর্বপুরুষেরা শরীর থেকে ফেরোমন নির্গত করে যোগাযোগ করার জন্য এই লোম ব্যবহার হতো। তবে মানুষ তাদের শরীর থেকে ফেরোমন নির্গত করে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না।


তবে মানুষের শরীরের লোম যে কারণেই পড়ে যাক না কেন, এর একটি ফলাফল প্রায় নিশ্চিত: আর তা হলো, মানুষের শরীরে পিগমেন্ট বেড়ে গিয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করা। রোদের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচার জন্য মানুষের শরীরে পিগমেন্ট বেড়ে যায়, যার ফলে শরীর কালো হতে শুরু করে। এর আগে শরীরের লোমের কারণে এটি হতো না।


লাসাসি জানান, "এখান থেকে এই যৌক্তিক অনুমানই আমরা করতে পারি। এটাও হতে পারে যে, কিছু কিছু মানুষ একেবারেই লোম ছাড়া জন্মিয়েছে, তারপর কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার এটাও হতে পারে যে, ধীরে ধীরে মানুষের শরীরে লোম কমেছে এবং শরীরও ধীরে ধীরে কৃষ্ণাঙ্গ হয়েছে।"


আমাদের শরীরের লোম কীভাবে হারিয়ে গিয়েছে সে সম্পর্কে জানা হয়তো অনেকের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। তবে টাক পড়ে যাওয়া, কেমোথেরাপিসহ অন্যান্য রোগের পেছনের কারণ জানতে হলে এটি জানা গুরুত্বপূর্ণ।


২০২৩ সালে উতাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট নাথান ক্লার্ক ও তার সহযোগীদ্বয় আমান্ডা কোয়ালজিক এবং মারিয়া চিকিনা মানুষসহ ৬২টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর লোমের জেনেটিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন। তারা মানুষের দেহের সবজায়গাতেই লোমের আস্তরণের প্রমাণ পেলেও দেখতে পান যে এগুলো প্রকট নয়। তারা এও দেখতে পান যে, যখন কোনো প্রজাতি তাদের লোম হারায়, তখন তারা কিছু নির্দিষ্ট জিনের পরিবর্তন বারবার ঘটাতে থাকে এবং নতুন ধরনের জিনের উৎপাদন হয়।


"নতুন জিনগুলোকে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা যায়নি, কারণ এর আগে লোমের পরিবর্তন, বা উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নিয়ে বেশি গবেষণা করা হয়নি। এগুলো মাস্টার কন্ট্রোলার হতে পারে, যেগুলোকে পরিবর্তন করে পরবর্তীসময়ে টাকমাথায় চুল ওঠানোর প্রযুক্তি বের করা যেতে পারে।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.