ভারতবর্ষের প্রথম বিলেতি শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের একজনের ১৮৭৮ সালে প্যারিস ভ্রমণের স্মৃতি

 


ODD বাংলা ডেস্ক: স্ক্রল ডটইন-এ প্রকাশিত দোসেবাই কাউসজি জেসাবালা'র দ্য স্টোরি অভ মাই লাইফ গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকের জন্য সংক্ষেপে ও পরিমার্জিতভাবে অনুবাদ করা হলো।


আমি বেলুনে চড়ব শুনে হোটেলের বন্ধুরা যারপরনাই অবাক। তারা তো জিজ্ঞেসই করে বসলেন, সব পারসিক নারীরাই আমার মতো দুঃসাহসিক কি না। তাদের ভুল ভাঙিয়ে বললাম, বছর কয়েক আগেও পারসিক নারীরা সাদা চামড়াদের দেখলে ভয় পেয়ে দূরে সরে যেত।


ইউরোপীয়দের সঙ্গে আগে থেকে মেলামেশার সুযোগে তাদের কিছু রুচি আর সাহস বোধহয় আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। এসব কথায় আমার মার্কিনী বন্ধুটিও প্রীত হলেন। বারবার করে বললেন, আমেরিকায় গেলে যেন কোনো হোটেল বা বোর্ডিং হাউজে না উঠে সোজা গিয়ে তার গৃহে হাজির হই।


গরম জামাকাপড় পরে বের হলাম। হাতব্যাগে কিছু নোট পেপার, ওয়াইন, বিস্কিট আর একটা লোহার টুকরা। এটা কাজে লাগবে যদি আমি বেলুন থেকে নিচের মানুষদের উদ্দেশে কিছু লিখে ফেলতে চাই।


এক্সিবিশনে পৌঁছে ১০ রুপিতে টিকিট কিনে ব্যোমযানে চেপে বসলাম। আশেপাশে ভিড় করা মানুষেরা আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। বেলুনটা মাটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। মোট ১৫ জন যাত্রী, তার মধ্যে নারী তিনজন।


ছেলেকে সঙ্গে করে আনিনি যদি কোনো বিপদ হয় এ আশঙ্কায়। সন্ধ্যা পাঁচটায় বেলুন আমাদের নিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করলে। দেখলাম নিচের পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।


মানুষগুলোকে এত ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে এক ঝাঁক মৌমাছি। পারি শহরের যাবতীয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, ঘরবাড়ি এ শূন্য থেকে কেমন অপার্থিব ঠেকাল।


বেলুন যত ওপরে উঠতে লাগল, শীতটা আরও জেঁকে বসল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কয়েক চুমুক ওয়াইন খেলাম। একটু পর বেলুন দড়ির সর্বোচ্চ উচ্চতায়, প্রায় ৭০০ মিটার উচ্চতায় উঠে এল। আকাশের এত ওপরে পাখির মতো উড়তে পারার আনন্দটুকু সারা মনে খেলে যাচ্ছিল আমার। এরপর আমরা আবার অবতরণ শুরু করলাম। মোটামুটি ৪৫ মিনিট পরে আবার পারির ভূমিতে নেমে এলাম।


এ উড্ডয়নের স্মারক হিসেবে প্রতিটা যাত্রীকে একটা করে মেডেল দেওয়া হলো। আকাশ থেকে তুলেরিসের বাগান দেখে বেশ আগ্রহ হয়েছিল, নামার পর সেখানে গেলাম। বিশাল জায়গা জুড়ে ফুল, প্রাঙ্গণ, এভিনিউ, গাছপালা, ভাস্কর্য ও ঝরনার মিলনে অদ্ভুত এক পুরোনো দিনের আভাস জড়িয়ে আছে এ জায়গাটাতে।


আগস্টের ১৬ তারিখ বোম্বে, লন্ডন ও জার্মানিতে কিছু চিঠি পাঠিয়ে আবার এক্সিবিশনে গেলাম। সেদিন সারাদিন ওখানে ছবির সংগ্রহ দেখে কাটালাম। কিন্তু এত এত ছবি, সব ভালোমতোন দেখতে হলে পাক্কা এক মাস লাগবে। ১৭ তারিখ একটা গহনার দোকানে গিয়ে কিছু গহনার বায়না করে এলাম। ওরাই সময়মতো ভারতে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।


১৮ আগস্ট সকালের জলখাবার সেরে ভার্সাইর উদ্দেশ্যে ট্রেনে রওয়ানা দিই, পৌঁছাতে লেগেছিল আধাঘণ্টার মতো। ওই দিনটা একটা ছুটির দিন ছিল। ভার্সাই প্রাসাদে প্রবেশের সময় সৌভাগ্যক্রমে মি. কুটবার্ট নামক একজন ইংরেজ ভদ্রলোককে গাইড হিসেবে পেয়ে গেলাম।


প্রাসাদটাতে অনেকগুলো স্যুট। প্রতিটাতে একজন করে কর্মকর্তা আছেন। তারাই দর্শনার্থীদের প্রাসাদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছিলেন। আমার গাইড কুটবার্ট সাহেব আমাকে সব ফরাসি থেকে অনুবাদ করে ইংরেজিতে বুুঝিয়ে দিলেন।


প্রাসাদের সাবেক আমলের ফার্নিচারগুলোও এত চকচক করছিল যে, মনে হচ্ছিল বুঝি সদ্য কেনা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষেই পুরোনোদিনের রাজ্যের ছবি। বড় বড় ট্যাপেস্ট্রিতে বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্র আঁকা হয়েছে। এত এত আশ্চর্যকর সংগ্রহ, দেখতে দেখতেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম।


বিশাল বাগানের মধ্যে সমান চমৎকারিত্বে ভরপুর আরও চারখানা প্রাসাদ। বাগানের বিশালতা এ তথ্য থেকে হয়তো আঁচ করা যাবে, কিন্তু এ বাগানের সৌন্দর্য অনুভব করতে এখানে উপস্থিত থাকার বিকল্প নেই। প্রকৃতি আর শিল্প মিলে এখানে এক মহাশিল্পকর্ম গড়ে তুলেছে।


এখানে আরও দেখা গেল চতুর্দশ লুই ও নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি। দামি ধাতু দিয়ে বাঁধানো শকটগুলোর গায়ে পাখির ছবি আঁকা, আসনগুলো ভেলভেট দিয়ে মোড়ানো। প্রত্যেকটা রথের দাম এক লাখ ফ্রাঁ। আরেকটু এগোতেই মি. কুটবার্ট বলে উঠলেন, 'এখানটাতেই যত আকর্ষণ!'


আমাদের সামনে একটা বিশাল জলাশয়, তার মধ্যে শয়ে শয়ে ঝরনা খেলে বেড়াচ্ছে। কিছু ঝরনা দেখতে গাছের মতো — এরকম আরও নানা বস্তুর প্রতিকৃতি। সবচেয়ে বড় ঝরনাটা বছরে কেবল আজকের দিনটাতেই খেলে। ওটা নেপচুন তথা জলের দেবতার প্রতিনিধি। এ ঝরনার মধ্যে নিদেনপক্ষে হাজারটা জলের ধারার উপস্থিত আছে। ঝরনার চারপাশের বাতাস দেখে বর্ষাকালের জলীয় বাষ্পের মতো মনে হচ্ছে। জলাশয়ের পাশে একটা বসার থিয়েটার, সেখানে দর্শকেরা বসে এ জলকেলি উপভোগ করতে পারেন। মি. কুটবার্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে হোটেলে ফিরে এলাম।


২২ আগস্ট আমার জন্মদিন। ভোর ভোর উঠে ঈশ্বরের কাছে খানিক প্রার্থনা করে নিলাম। তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম আমাকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ভ্রমণে সুযোগে এনে দেওয়ার জন্য।


জলখাবার শেষে আমি মি. ও মিসেস কার্বি ও তাদের কন্যার সঙ্গে পারির অন্যতম ফ্যাশনেবল দোকান বন মার্শ-এ যাই। দোকানে এত এত সুন্দর জিনিসপত্র, কোনটা রেখে কোনটা বাছাই করব, তা নিয়েই ধন্দে পড়ে গেলাম। তাও কিছু রেশম, পাখা, রুমাল ও একটি উলের জামা নিলাম। দোকানের একজন কর্মচারী দয়াপরবশত আমাকে পুরো দোকানটা ঘুরিয়ে দেখালেন। তিনি আমাকেও এও জানালেন, তাদের দোকানে এর আগে কখনো আমার জাত ও পোশাকের কারও পদধূলি পড়েনি। এ কারণেই বোধহয় দোকানের সবাই খানিকটা সময় কাজ থামিয়ে আমাকে দেখছিলেন। ২৩ ও ২৪ আগস্টও দোকানে গিয়ে আরও কিছু জিনিস কিনলাম।


দুই দিন গেল সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া ও ফেরার আয়োজন করতে করতে। ২৮ তারিখ ছেলে ও আমার জন্য কুকের টিকিট কিনলাম। শেষবারের মতো এক্সিবিশন থেকে আরেকবার ঘুরে এলাম। সেখান থেকে বিদায় নেওয়া সময় দারুণ মন খারাপ হলো।


হোটেলে শেষ সন্ধ্যাটুকু বন্ধুদের সঙ্গে কাটল। পরিচিত অনেকই হোটেলে এলেন আমাকে দেখার জন্য। এদিকে আবার খবর এল, বোম্বেতে আমার স্বামী অর্থসংক্রান্ত কিছু জটিলতায় পড়েছেন। কী আর করা যাবে! ভ্রমণের যাত্রাপথ কিছুটা কমিয়ে কেবল জার্মানি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ডে সীমাবদ্ধ করতে হলো। লন্ডনে ফিরে যাওয়া আর স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ আর হলো না।


২৯ আগস্ট সারাদিন গেল বাক্সপ্যাটরা বাঁধাছাঁদা করতে। গহনার দোকান আর হোটেলের পাওনা পরিশোধ করলাম। হোটেল কর্মীদের কাছ থেকেও বিদায় নিলাম। হোটেলের মহাব্যবস্থাপক সাহেব আমার একখানা ছবি চাইলেন, সানন্দে দিলাম। বিদায়বেলা সবসময়ই বেদনার। স্বামীর কষ্টের কথাও মনে পড়ছিল। আমার এ ইউরোপ ভ্রমণে তার সমর্থন ছিল অপরিসীম। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, কোনো একদিন আমরা দুজনে একত্রে এ স্থানে আবার ভ্রমণে আসতে পারব।


তবে সে আশা কখনোই পূরণ হয়নি।


হোটেল থেকে বেরিয়ে আমার গেয়া দ্যু নর্দ স্টেশনে গিয়ে কোলনের উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরলাম।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.