মহাকাশে জ্বালানি স্টেশন নির্মাণের জন্য ৩০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: পুরনো স্যাটেলাইটগুলো মরে না। তারা হারিয়ে যায় পরিবেশের সাথে। একে যদি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, তবে বলতে হয়, স্যাটেলাইটগুলোর সামান্য বাকি থাকা জ্বালানি দিয়ে একে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে আনা হয়, যার ফলে পড়ন্ত স্যাটেলাইটগুলো বায়ুমণ্ডলের সাথে প্রচণ্ড ঘর্ষণে পৃথিবীর মাটিতে পড়ার আগেই পুড়তে পুড়তে হারিয়ে যায়।


যা-ই হোক না কেন, কক্ষপথ জুড়ে হাজার হাজার স্যাটেলাইট রয়েছে, যেগুলো নষ্ট না হলেও কাজ করতে পারছে না কেবল জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই হাজির হয়েছে অরবিট ফ্যাব, যাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো অরবিটাল রিফুয়েলিং ডিপোর একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যেটি স্যাটেলাইটগুলোকে আরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে সাহায্য করবে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে এটি। এছাড়াও তাদের জ্বালানি সরবরাহের পোর্টগুলো ব্যাবহারের জন্য স্যাটেলাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কী কী করতে হবে তার একটি নীতিমালা তৈরি করেছে তারা। 


গত সোমবার কলোরাডো-ভিত্তিক কোম্পানিটি ঘোষণা করেছে যে, এটি তাদের প্রজেক্টের জন্য ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং পেয়েছে, যেটি ভেঞ্চার কোম্পানি যোগ হওয়ায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৬ মিলিয়ন ডলারে। তবে কোম্পানিটির আনুমানিক ভ্যালুয়েশন কত হতে পারে, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি তারা। 


অরবিট ফ্যাবের সিইও ড্যানিয়েল ফেবারের মতে, "স্পেসএক্স পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেট আবিষ্কারের পরপর এই আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করেই স্যাটেলাইটের আয়ু বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদি আপনি পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেট ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে আর টিকতে পারবেন না, কারণ আপনি আর খরচ কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। এবং একই কথা স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কয়েক বছরের মধ্যেই, স্যাটেলাইটে রিফুয়েলিং করে আপনাকে এর খরচ কমাতে হবে। আর তা যদি না করেন, একইভাবে এই খাতেও টেকা সম্ভব হবে না। বিনিয়োগকারীরা এটি বুঝতে পেরেই এতে বিনিয়োগ করছেন।" 


তবে স্যাটেলাইটগুলোকে রিফুয়েল করার জন্য মহাকাশে অবকাঠামো তৈরি করা মুখে বলা যতটা সহজ, করাটা ততটাই কঠিন। স্পেস ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক ক্রিস কুইল্টির মতে, "স্যাটেলাইট রিফুয়েলিং করার জন্য সেটি করতে সক্ষম এমন স্যাটেলাইট প্রয়োজন, কিন্তু সে ধরনের স্যাটেলাইটই এখনো তৈরি করা হয়নি। এটি অনেকটা 'মুরগি আগে নাকি ডিম আগে'-র মতো সমস্যা।"


একেকটি বিশালাকার জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য কয়েক মিলিয়ন, এমনকি বিলিয়ন ডলারও খরচ হতে পারে, এবং কেবল তাদের উৎক্ষেপণ করতেই কয়েক মিলিয়ন খরচ হতে পারে। এদিকে পৃথিবী, সূর্য এবং চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি স্যাটেলাইটগুলোকে তাদের কাঙ্খিত পথ থেকে কিছুটা সরিয়ে দিতে পারে, এজন্য সঠিক জায়গায় যাওয়ার জন্য স্যাটেলাইটগুলোতে জ্বালানির প্রয়োজন হয়। অরবিট ফ্যাব প্রতিটি স্যাটেলাইটে ১০০ কেজি হাইড্রাজিনের মূল্যমান নির্ধারণ করেছে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্যাটেলাইটগুলোকে আরও দীর্ঘ সময় কক্ষপথে থাকতে সাহায্য করবে। 


ফেবার জানান, "স্যাটেলাইট কক্ষপথের একটি সম্পদ, আর এটির সাথে সম্পদের মতোই আচরণ করা উচিত। মহাকাশে জ্বালানি নেওয়ার আরেকটি সুবিধা হলো এটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের খরচ কমিয়ে আনবে। কীভাবে? যদি এটি সম্ভব হয়, তাহলে সম্পূর্ণ জ্বালানি ভর্তি না করেই স্যাটেলাইটকে উৎক্ষেপণ করে যাবে। ওজন কমে যাওয়ায় একে উৎক্ষেপণ করতে শক্তি কম লাগবে, ফলে খরচও কমে যাবে।" এটি পুরো স্যাটেলাইট খাতকেই পরিবর্তন করে দেবে বলে মনে করেন ফেবার।   


ফোর্বসের থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকাভুক্ত জেরেমি শিয়েল এবং ফেবার একত্রে ২০১৮ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কক্ষপথে একটি রিফুয়েলিং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। ২০১৯ সালে প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে জল সরবরাহ করে কোম্পানিটি প্রমাণ করে যে তাদের রিফুয়েলিং হার্ডওয়্যারটি ভালোভাবেই কাজ করছে। এর প্রধান উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে রয়েছে 'র‍্যাপিডলি অ্যাটাচেবল ফুয়েল ট্রান্সফার ইন্টারফেস' বা র‍্যাফটি। একে তুলনা করা যায় অনেকটা ইউএসবি পোর্টের সাথে, সব কম্পিউটারের সাথে যেমন ইউএসবি পোর্ট থাকে, তেমনি ভবিষ্যতের সকল মহাকাশযানেও এই র‍্যাফটি যুক্ত থাকবে, যার সাহায্যে স্যাটেলাইটে জ্বালানি নেওয়া যাবে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি এবং ১০০টিরও বেশি বাণিজ্যিক সংস্থা এই চুক্তিতে সাড়া দিয়েছে।


প্রতিরক্ষা বিভাগসহ অন্যান্য মহাকাশযান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সাথেও একযোগে কাজ করছে অরবিট ফ্যাব, চেষ্টা করছে তাদের এই র‍্যাফটি একটি সর্বজনীন প্রযুক্তি হিসেবে নির্মাণ করতে। ক্রিস কুইল্টি একে একটি 'স্মার্ট ব্যবসায়িক মডেল' বলে উল্লেখ করেন। 


র‍্যাফটির পাশাপাশি মার্কিন ফেডারেল সরকার কোম্পানিটির সাথে আরও কিছু চুক্তি করেছে। মার্কিন সরকারের স্পেস ফোর্সের জন্য অরবিটাল ডকিং ডিপো তৈরি এবং সমস্ত স্যাটেলাইট রিফুয়েলিংয়ের জন্য ২১ মিলিয়ন ডলার নিয়েছে তারা। এই প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু হবে ২০২৪ সালে। 


কোম্পানিটি বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও চুক্তি করছে। এর মধ্যে রয়েছে টোকিও-ভিত্তিক অ্যাস্ট্রোস্কেলের সাথে একটি চুক্তি, যারা মহাকাশের আবর্জনা অপসারণের লক্ষ্যে স্যাটেলাইট তৈরি করছে। ফেবার জানান, রিফুয়েলিং প্রযুক্তির আরেকটি বড় সুবিধা হল এটি মহাকাশে কম স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ তৈরি করবে। এছাড়াও ফেজ ফোর, ডন অ্যারোস্পেস এবং নিউট্রন স্টার সিস্টেমের মতো স্পেস স্টার্টআপের সাথেও চুক্তি করেছে তারা।


ফেবার জানান, তার কোম্পানি নতুন এই বিনিয়োগ থেকে পাওয়া অর্থ কাজে লাগাবেন অবকাঠামো নিয়ে গবেষণা আরও দ্রুত করা এবং তার দলকে বড় করার জন্য আরও ২৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া। ইতিমধ্যেই কোম্পানিটিতে ৬০ জন কাজ করছেন। বড় দল এবং আরও মূলধন নিয়ে শুধুমাত্র নিজের কোম্পানিই নয়, বরং পুরো মহাকাশ ইন্ডাস্ট্রিতেই বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন ফেবার। 


"স্যাটেলাইটগুলিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তৈরি করার মতো আইডিয়া খুবই অসাধারণ। আর সত্যিই এই জিনিসটির কারণেই বিনিয়োগকারীরা এর পেছনে টাকা ঢালছেন।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.