ভারতের ধনাঢ্য মশলা-রত্ন বণিকদের তৈরি ১৫,০০০ বিলাসবহুল অট্টালিকা যেভাবে পরিত্যক্ত ও ক্ষয়ের পথে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের শিভাগঙ্গা জেলার একটি অঞ্চল ছেত্তিনাদ। ৬০০ বর্গমাইলের এ অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ১৫,০০০ রাজকীয় অট্টালিকা, যেগুলোর বেশিরভাগই এখন ক্ষয় হওয়ার পথে।


প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিত্তশালী ব্যাংকার ও বণিকরা ছেত্তিনাদে এই প্রাসাদসম বাড়িগুলো বানানোর পেছনে অঢেল টাকা খরচ করেছেন। ভবনের বহির্সজ্জা ও অন্দরসজ্জা- সবকিছুতেই ছিল আভিজাত্য ও বিলাসিতার ছোঁয়া। বর্তমানের হিসেবে এসব চোখ ধাঁধানো-প্রাসাদসম বাড়ির নির্মাণ খরচ শত শত কোটি টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লোকজন স্থানান্তরিত হওয়ায় এবং সরকার নতুন নতুন আইনের আরোপের ফলে এ অঞ্চলের সম্পদের জৌলুস কমতে থাকে।


যদিও এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অট্টালিকাগুলো। এই সুরম্য অট্টালিকাগুলোর গড় বিস্তৃতি ৫০,০০০ বর্গফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং প্রায় ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। কোনো কোনো অট্টালিকায় রয়েছে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। অট্টালিকাগুলো এত বিশাল যে শেষ পর্যন্ত অনেক মালিকেরই এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য ছিল না।


চেন্নাই থেকে ২৫০ মাইল দক্ষিণে, তামিলনাড়ুর এক শুষ্ক অঞ্চল ছেত্তিনাদ। ছেত্তিনাদে যাওয়ার পথে সাধারণ ভারতীয় গ্রামের সকল বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়বে- ফসলের মাঠ, ছোট ছোট গ্রাম আর ছোট ছোট কংক্রিটের দালান।


কিন্তু ছেত্তিনাদে পৌঁছানোর পর অস্বাভাবিক কিছু জিনিসের দেখা মিলবে- এর ৭৩টি গ্রাম ও দুটি শহরের রাস্তার পাশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৫,০০০ রাজকীয় দালান; সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় রয়েছে। তবে অট্টালিকাগুলোর পূর্বের জৌলুসের সাথে পাল্লা দিয়ে নেই বিলাসিতা।


কিছু কিছু অট্টালিকায় এখনও এর বাসিন্দারা বসবাস করছেন, কিন্তু অনেকগুলো দালানই ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে।


ছেত্তিনাদের এই সুরম্য অট্টালিকাগুলো নির্মাণ করেছিল নাট্টুকোট্টাই ছেত্তিয়ার বংশ, যারা কয়েশো বছর আগে সুনামিতে বাস্তুহারা হয়ে তামিলনাড়ুর এ অঞ্চলে এসে বসতি গড়েছিল।


১৬০০ সালের দিকে তারা রত্নপাথর ও লবণের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু ছেত্তিয়ার পরিবার বিত্তশালী হয়ে ওঠে মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করার পর।


এ পরিবারের সদস্যরা শুরুতে ছিল ব্যাংকার- কেউ কেউ রাজাদের ও ব্রিটিশ রাজকে টাকা ধার দিত। এরপরে তারা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়; মালয়েশিয়া, বার্মা ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে মশলা, চাল, রত্নপাথরের ব্যবসা ছিল তাদের। 


ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল টাকা আয় করেছিল ছেত্তিয়ার পরিবার এবং সেই টাকা দিয়ে তারা রাজকীয় অট্টালিকা তৈরি করে। ১৮৫০ সালের দিকে তারা ভবনগুলো নির্মাণ করতে শুরু করে।


শুধু অট্টালিকা তৈরিতেই নয়, অন্দরসজ্জা ও ফিটিংস এর ক্ষেত্রেও কোনো কমতি রাখেননি তারা। বার্মা থেকে সেগুন কাঠ এবং বার্মিংহাম থেকে গ্লেজড সিরামিক টাইলস এনে ব্যবহার করেছিল তারা।


এছাড়াও, তারা সুইজারল্যান্ড থেকে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক (ঘড়ি), বেলজিয়াম থেকে মেহগনি কাঠের ফ্রেমের আয়না এবং ভেনিস থেকে সর্বোচ্চ ১০ ফুট প্রশস্ত ঝাড়বাতিও এনেছিল বাড়ির জন্য।


স্থপতি বার্নার্ড ড্রাগন, যিনি ছেত্তিনাদের কিছু অট্টালিকা পুনরুদ্ধার করেছেন, তিনি এএফপিকে জানান- "একসময় ছেত্তিয়ারদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা চলতো যে কে সবচেয়ে সুন্দর অট্টালিকা তৈরি করতে পারে- এক ভাই কিভাবে আরেক ভাইয়ের চেয়ে সুন্দর অট্টালিকা বানাবে সেই প্রতিযোগিতা চলতো।"


বাড়ির বাইরের দিকটা জমকালো হলেও, অন্দরের জন্য নিজস্ব ঐতিহ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাড়িগুলোতে। প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার পরেই অট্টালিকায় একটা আলাদা উচু প্ল্যাটফর্মের মতো জায়গা থাকত, যেখানে ব্যবসায়িক আলাপ-আলোচনা চলতো। এটি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য একটি আলাদা অংশ ছিল বাড়িতে। নারীরা প্রধান ফটকের কাছে আসতে পারতো না।


বাড়ির ভেতরের দিকের প্রাঙ্গণে পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ উদযাপন করতো। পশ্চিমা অট্টালিকাগুলোর বিপরীত স্টাইলে, সেখানে আরামের জন্য খুব কমই আসবাবপত্র রাখা হতো।


কিন্তু বাড়িতে এত এত কক্ষ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ছিল খুবই সামান্য। পরিবারের সদস্যরা রাতে বিছানা-বালিশ পেতে একসঙ্গে ঘুমাতো।


ছেত্তিয়ার পরিবারের টাইকুনরা কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করে এবং আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড সম্পর্কে ধারণা পায়। যেমন, ১৯৩০ সালের দিকে আর্ট ডেকো খুবই জনপ্রিয় ছিল; ফলে ছেত্তিয়াররা সেই স্টাইল অনুকরণ করে ছেত্তিনাদে।


কিন্তু তাদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তি টেকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সবকিছু বদলে যায়, এ অঞ্চল জাপানিদের দখলে চলে যায় এবং ছেত্তিয়ারদের অনেকেই তাদের প্রাসাদ ও ধনসম্পদ ছেড়ে এই অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।


যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। ভারতজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় এবং সরকার বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নানা নিয়মনীতি আরোপ করে তা সীমাবদ্ধ করে।


ফলে কিছুদিনের মধ্যেই প্রাসাদগুলো পরিত্যক্ত হয় এবং জরাজীর্ণ হয়ে ওঠে। কিছু কিছু অট্টালিকা দুষ্কৃতিকারীরা ভেঙে ফেলে এবং দামি দামি জিনিসপত্রগুলো হাতিয়ে নেয়। অন্যান্য প্রাসাদগুলো এখনো তাদের আসল মালিকের বংশধরদের হাতেই থেকে যায়।


কিন্তু দিন যত পেরোতে থাকে, মালিকেরা সুবিশাল বাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হিমশিম খায়, আর নাহয় বাড়িগুলোর পরিণতি কি হবে তা নিয়ে পারিবারিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।


এই মুহুর্তে ছেত্তিনাদের এই প্রাসাদগুলোকে ইংল্যান্ডের প্রাসাদগুলোর সমকক্ষ হিসেবে দেখা হচ্ছে: যা খুব বেশি উপযোগী নয়, কিন্তু অতীতের গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীক। নিউইয়র্ক টাইমস এই অট্টালিকাগুলোকে 'অসামান্য বিত্তের প্রতীক, চোখ কপালে তোলার মতো ব্যয় ও আবেগের সাথে যুক্ত' বলে অভিহিত করেছে।


বেশিরভাগ মালিকেরাই বাড়িগুলোতে সারাবছর থাকেন না। তারা চেন্নাইয়ে থাকেন এবং বিয়ে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো জমায়েতের সময়গুলোতে তারা এখানে আসেন।


আবার সবারই যে বাড়ি রেখে দেওয়ার যাওয়ার সামর্থ্য আছে তা নয়। একটি অট্টালিকার মালিক রামা কুমারাপ্পান তার স্ত্রী ও দুই সন্তান এবং এক আন্টিকে নিয়ে ৬৩ বেডরুমের বিশাল অট্টালিকায় থাকতেন- সেখানের দেয়ালে এখন কালো ছাতা পড়ে গেছে।


"যখন বাইরের কাউকে আপনি বলেন যে আপনি ছেত্তিয়ার, সবাই ভাবে এই লোক কতই না ধনী। বাড়িটা রাখতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম, কিন্তু এখন তা অসম্ভব", বলেন রামা কুমারাপ্পান।


ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে কেউ কেউ তাদের অট্টালিকাগুলো ফিল্ম স্টুডিওকে ভাড়া দিয়েছেন, যেখানে প্রায়ই বিয়ের আয়োজনের শ্যুটিং করা হয়।


আরও কিছু বাড়িকে বিলাসবহুল হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। 'বাংগালা' নামক এমনই একটি হোটেলের মালিক মীনাক্ষী মায়াপ্পান। ২০১৭ সালে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, তিনি সবসময়ই তার বাড়ির কি পরিণতি হবে সেটা ভাবতেন।


তাছাড়া, বাড়ির মালিকদের হাতেও খুব বেশি বিকল্প নেই। দূরবর্তী অঞ্চলে একটি পুরনো প্রাসাদ কেনার মতো চাহিদা কম, তার উপর আবার এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর খরচ। তাই বাড়িগুলো বিক্রিও করতে পারছেন না অনেকে।


আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, অনেক মালিকই বাড়িগুলো বিক্রিই করতে চান না। সারা ভারতজুড়ে ছেত্তিনাদের অট্টালিকাগুলো বিখ্যাত ও সুপরিচিত। এরকম একটি অট্টালিকা নিজের মালিকানায় রাখা সম্মান ও প্রাচুর্য্যের প্রতীক। কোনো কোনো মালিকের কাছে এটাই বাড়ির সবচেয়ে বড় মূল্য, যদিও পুরনো সেই গৌরব এখন ফিকে হয়ে এসেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.