ডাকু সুলতানা: যার সখ্য ছিল ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে, যাকে পছন্দ করতেন শিকারি জিম করবেটও

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৯২৩ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা ফ্রেডেরিক 'ফ্রেডি' ইয়াং ডাকু সুলতানাকে আটক করেন। তার আগের কয়েক মাস ভারতবর্ষের স্পেশাল ড্যাকয়েট পুলিশ ফোর্স-এর ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াং তার বাহিনী নিয়ে 'কুখ্যাত' এ ডাকাতকে ধরার জন্য অনেকগুলো ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।


উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলের জঙ্গলে আস্তানা ছিল সুলতানার। তার ভয়ে থরহরি কাঁপত ব্রিটিশ ভারতের বুন্দেলখণ্ডের (বর্তমানে উত্তর প্রদেশ) বান্ডা থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিমের পাঞ্জাব পর্যন্ত।


১৯২৩ সালের ২১ নভেম্বর নিজের বড়কর্তাদের কাছে লেখা এক রিপোর্টে ইয়াং জানিয়েছেন, সুলতানার দল ২০০-এর অধিক ডাকাতি, খুন ও লুটতরাজের জন্য দায়ী ছিল।


ডাকু সুলতানাকে ধরতে সদলবলে জঙ্গলে জঙ্গলে চষে বেড়িয়েছিলেন ইয়াং। বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটও ডাকু সুলতানার বিরুদ্ধে পুলিশের একাধিক অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন।


তবে সুলতানার সঙ্গে ইয়াংয়ের এক পর্যায়ে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। করবেটও সুলতানাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, সুলতানা কখনো গরীবদের ওপর অত্যাচার চালাননি — এমনটাই লিখেছেন নিজের বইয়ে।


স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফ্রেডেরিক ইয়াংয়ের। ইন্ডিয়ান পুলিশ এক্সামিনেশন পাস করে ১৯০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতবর্ষে পা রাখেন এ স্কটিশ তরুণ।


১৯১৩ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত গোরক্ষপুর এবং নেপালের আশেপাশের এলাকায় ঠগীদের দমন করে পুলিশ বিভাগে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। ১৯২৩ সালের মধ্যে তার পদোন্নতি ঘটে।


ইয়াং যে সময়টাতে কুমায়ুনে সুলতানাকে ধরার চেষ্টা করছিলেন, তখন সেখানে জিম করবেটও শিকারের উদ্দেশ্যে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। করবেট তার মাই ইন্ডিয়া গ্রন্থে ইয়াংয়ের সঙ্গে মোলাকাত ও তার সুলতানাকে ধরার চেষ্টা সম্পর্কে লিখেছেন।


ভারতের ভান্টু আদিবাসী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুলতানা। ব্রিটিশরা ১৯১১ সালের কুখ্যাত ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট থ্রি-এর মাধ্যমে ভান্টুদের অপরাধী গোষ্ঠী হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল।


এ আইনের কারণে কেউ ভান্টু গোত্রে জন্ম নিলেই তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হতেন ব্রিটিশদের চোখে। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মনে করতেন, ভান্টুদের অপরাধমুখিতা তাদের বংশগতির মধ্যেই যুক্ত ছিল। এ জাতিটির 'অপরাধমূলক' কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন।


ভান্টুদের একটা দল ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে। তাদেরকে ব্রিটিশ সরকার উত্তরপ্রদেশের নাজিবাবাদের পাথরগড়ে অবস্থিত রোহিলা দুর্গে নজরবন্দি করে রাখে। এ ধরনের অনেক সীমাবদ্ধ এলাকায় ভান্টুদের আটকে রেখে তাদের প্রথাগত জীবন থেকে ফিরিয়ে আনাতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। রোহিলা দুর্গের ওই দলে সুলতানাও ছিলেন।


কিন্তু সুলতানা দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। শিবালিক ও তরাইয়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেন তিনি। ওসব জঙ্গলে শিকার করতেন জিম করবেটও।


তরাইয়ের জলা-জঙ্গল এলাকা সুলতানার উপযুক্ত আস্তানা হয়ে ওঠে। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তাকে ধরার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ পুলিশ। নিজের ডাকাতদল গড়ে তোলেন তিনি, অনেকগুলো ডাকাতিও সংঘটন করেন।


সুলতানাকে ভারতবর্ষের রবিন হুড খেতাব দিয়েছিলেন জিম করবেট। তার খপ্পরে সচরাচর পড়তেন বিত্তশালীরা। জিম করবেটও লিখেছিলেন: সুলতানা কখনোই কোনো গরীব থেকে এক পয়সাও কেড়ে নেননি, কেউ সাহায্য চাইলে কখনো ফিরিয়ে দেননি, এবং ছোট ছোট দোকানিদের কাছ থেকে দ্বিগুণ পয়সা দিয়ে জিনিস কিনতেন।


১৯২৩ সালের দিকে ব্রিটিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, এ রাহাজানি এবার বন্ধ করতেই হবে। এ লক্ষ্যে ৩০০ সদস্যের স্পেশাল ড্যাকয়েট পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়। এ দলের অংশ ছিলেন ইয়াং, কুমায়ুনের কমিশনার পার্সি উইন্ডহ্যাম এবং করবেট সাহেবও।


এ ফোর্সকে জঙ্গলে চলাচল, গোপনে ও অন্ধকারে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কুমায়ুন অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে: সূরজ সরকারি, দেওতা উজল্লি; অর্থাৎ সরকার দিনে শাসন করে, কিন্তু রাত কেবলই দেবতাদের।


কিন্তু সুলতানাকে দিনের বেলা ধরাও অসম্ভব ছিল। ব্রিটিশ আমলা স্যার পার্সিভেল গ্রিফিথ তার টু গার্ড মাই পিপল: দ্য হিস্টোরি অভ দ্য ইন্ডিয়ান পুলিশ গ্রন্থে লিখেছেন, সুলতানা তার দলের মধ্যে গোয়েন্দা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তাই ইয়াংয়ের পুলিশবাহিনীর পক্ষে তার আস্তানায় আচমকা হানা দেওয়ার কোনো অবকাশ ছিল না।


রামনগরে একবার সুলতানাকে ধরার জন্য ইয়াংয়ের দল কৌশলী এক ফাঁদ পেতেছিল। কিন্তু সেবারও সুলতানার স্পাইদের কল্যাণে ব্রিটিশদের ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়।


রামনগরের ঘটনার কিছুদিন পর ১৯২৩ সালের মার্চে আরেক অভিযানে ফ্রেডেরিক ইয়াং নাজিবাবাদের গহীন জঙ্গলের ভেতর সুলতানার আস্তানার অবস্থান খুঁজে পান। রাতের অন্ধকারে তিনি, তার বাহিনীর ৫০ সশস্ত্র সদস্য এবং জিম করবেটসহ ডাকু সুলতানাকে ধরার জন্য রওনা দিলেন।


এক মানুষ সমান উঁচু ঘাসের বন আর জলা পেরিয়ে দলটি এগোতে লাগল সুলতানার আস্তানার দিকে। কিন্তু হুট করে পুলিশের এক সদস্য ভুলে তার মাস্কেট চালিয়ে বসলেন। সব পণ্ড হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। তবে এক ডাকাত পুলিশের গুলিতে মারা গেল আর বাকিরা চম্পট দিলো।


পরের মাসগুলোতে ডাকাতদলের সদস্যরা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। তাদের সংখ্যাও কমে ৪০-এ নেমে এল। ইয়াং বুঝলেন, সুলতানাকে আত্মসমর্পণে রাজি করানোর এটাই উপযুক্ত সময়। এক খোলা মাঠে তিনি সুলতানার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের আয়োজন করলেন।


মিটিংয়ে ইয়াং একা এলেন, বসলেন সুলতানার বিপরীতে। সুলতানা তাকে তরমুজ খেতে সাধলেন। সুলতানা জানালেন, নাজিবাবাদে ইয়াংয়ের রেইডের সময় সুলতানা ও তার দল জঙ্গলের মধ্যে বটগাছের ওপরে বসে ছিলেন। চাইলেই তারা পুলিশের ওপর গুলি চালাতে পারতেন। কিন্তু শ্রদ্ধা ও সমীহবোধ থেকে গুলি চালাননি সুলতানা।


তবে ইয়াংয়ের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দাবি উপেক্ষা করলেন ডাকু সুলতানা। সেদিনের মিটিংয়ে কোনো সুরাহা হলো না।


বর্ষা গেল, শীত এল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় এক ইনফর্মার ইয়াংকে খবর দিলেন, গঙ্গার ধারে এক জায়গায় সুলতানার অবস্থানের কথা জানা গেছে। পরের দিন পুলিশের বিশেষ বাহিনীর ২৫ সদস্য নিয়ে রওনা দিলেন ইয়াং — সঙ্গে ছিলেন উইন্ডহ্যাম, করবেট, এবং ইয়াংয়ের কাজিন জেএস বিংলি।


সুলতানাকে জীবিত ধরা তাদের উদ্দেশ্য, তাই বন্দুকের বদলে বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যের হাতে ব্যাটন। নদী পেরিয়ে, জঙ্গল ভেঙে এগোতে লাগল দলটি। কিন্তু জায়গামতো গিয়ে হতাশ হতে হলো। সুলতানার কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। এরপর ১২ নভেম্বর ইয়াংয়ের ইনফর্মার জানালেন, সুলতানা ডাকু তার আগের আস্তানা থেকে আরও এক মাইল সামনে — গাইন্ডি খাট্টা নামক এক গ্রামে।


ইয়াংয়ের দল আবারও অনুসন্ধান শুরু করল। অভীষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর তারা খবর পেল, সুলতানা অন্য জায়গায় ডাকাতি করতে গিয়েছেন। সেদিন রাতে ডাকাতদের আস্তানার উদ্দেশ্যে অভিযান চালিয়েও কাউকে ধরা গেল না।


কয়েক মাসব্যাপী ইঁদুর-বেড়াল খেলার এ সমাপ্তি ঘটল হুট করেই। ইয়াংয়ের দল সুলতানাকে ধরলেন বেশ অনায়াসেই — ডাকাতদলের কয়েকজন বিশ্রাম নেওয়ার সময় পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলল।


১৯২৩ সালের ১৪ নভেম্বর সুলতানা ও তার দলের তিন সদস্যকে আটক করে ব্রিটিশ পুলিশ। তাদেরকে হালদোয়ানি জেলে রাখা হয়। তাদের বিরুদ্ধে খুনের অপরাধের প্রমাণ পায় ব্রিটিশ প্রশাসন এবং ১৯২৪ সালের ৭ জুলাই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।


সুলতানার গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেছিলেন শিকারি জিম করবেট। তিনি লেখেন, আমি আশা করেছিলাম বিচারের কারণে সুলতানাকে হাতকড়ি ও পায়ে কড়া না পরানো হতো। তার লেখা থেকে জানা যায়, যারা সুলতানাকে এক সময় ভয় পেত, তারাও সুলতানার ওই পরিণতিতে হাসাহাসি করেছিল।


সুলতানার স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইয়াংয়ের ওপর। তার বীরত্বের জন্য তাকে কম্প্যানিয়ন অভ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার-এ ভূষিত করা হয়। ১৯৪৪ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি, তার চার বছর পরে ভূপালে মৃত্যু হয়।


সুলতানার জীবনী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় একাধিক বই লেখা ও সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতেও ১৯৬৭ সালে দ্য লং ডুয়েল নামক একটি সিনেমা মুক্তি পায়। ভারতের স্থানীয় সংস্কৃতিতেও সুলতানার গল্পের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। এসব গল্পে সুলতানাকে কলোনিয়াল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।


সুলতানা ও ইয়াংয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমীহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। ইয়াং সুলতানার ক্ষমার জন্য একটি আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু তার সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে প্রশাসন। ভারতে অনেকেই বিশ্বাস করেন, সুলতানার কুকুর রায় বাহাদুরকেও পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ইয়াং।


সুলতানার লেগেসি ও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে লিখেছিলেন জিম করবেট। তিনি লেখেন, সুলতানা কখনো গরীবদের ওপর নিপীড়ন চালাননি। বটগাছের ওপরে সুযোগ পেয়েও সুলতানা ইংরেজ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালাননি। ফ্রেডি ইয়াংয়ের সঙ্গে মিটিংয়ে সুলতানা কোনো অস্ত্র নিয়ে আসেননি, এসেছিলেন একটি তরমুজ হাতে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.