আসছে হাইড্রোজেন মোটরবাইক; কাওয়াসাকি, সুজুকি, হোন্ডা, ইয়ামাহা একসঙ্গে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: হাইড্রোজেন-চালিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিন তৈরির যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে জাপানের মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক কাওয়াসাকি, সুজুকি, হোন্ডা এবং ইয়ামাহা। মোটরবাইক ছাড়াও হাইড্রোজেন-চালিত ছোট যান, ক্ষুদ্র নৌযান, নির্মাণ উপকরণ ও ড্রোনের ইঞ্জিন তৈরি করতে চাইছে তারা। খবর এশিয়া টাইমসের।


যৌথ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক কোম্পানি তাদের নিজস্ব চূড়ান্ত পণ্য (ইঞ্জিন) তৈরি করবে। তাদের বর্তমান প্রোডাক্ট লাইন ইঙ্গিত দেয়, উপরে আলোচিতগুলোর পাশাপাশি তারা হাইড্রোজেন চালিত মিনিকার, অফরোড যান, স্নোমোবিল, গলফ কার্ট, জেনারেটর, ঘাস ছাঁটাইয়ের মেশিনের ইঞ্জিনও উৎপাদন করবে।  


'হাইড্রোজেন স্মল মোবিলিটি অ্যান্ড ইঞ্জিন টেকনোলজি' শীর্ষক এ উদ্যোগে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প- বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পাওয়ার কথা চলতি সপ্তাহে জানিয়েছে কোম্পানি চারটি। সংক্ষেপে এই উদ্যোগকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে  (এইচওয়াইএসই)। এতে গবেষণা সহযোগী অংশীদার হিসেবে আরো থাকবে কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ এবং টয়োটা মোটরস।


ছোট হাইড্রোজেন ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য যন্ত্রাংশসহ – হাইড্রোজেন-চালিত ইঞ্জিন আর জ্বালানি ব্যবস্থার – বিভিন্ন কার্যকারিতা, পারদর্শীতা ও নির্ভরযোগ্যতার দিকে গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হবে।  


সবুজ জ্বালানি নিয়ে জাপানের পরিকল্পনা


জীবাশ্ম-জ্বালানি চালিত ইঞ্জিন থেকে সরে এসে, শূন্য কার্বন নিঃসরণকারী বাহন তৈরির জন্য জাপানের সরকার ও অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো 'মাল্টি-পাথওয়ে স্ট্র্যাটেজি' অবলম্বনের পক্ষে।  


ইতঃপূর্বে তারা ধীরে চলো নীতিই গ্রহণ করে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বা ইভি'র প্রচলনে। সে তুলনায়, হাইব্রিড বাহন উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দেয়। এজন্য তাদের কড়া সমালোচনা করেছে গ্রিনপিস-সহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন।


সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় টয়োটার প্রধান বিজ্ঞানী গিল প্র্যাট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনে 'বহুমুখী উপায়ই হলো মূল শক্তি'। কার্বন নিঃসরণ ও বায়ুমণ্ডল থেকে সম-পরিমাণ কার্বন শোষণের মধ্যে ভারসাম্য রাখা বোঝাতেই নিরপেক্ষতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।   


২০১৬ সাল থেকে টয়োটার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিআরআই- এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে রয়েছেন গিল প্র্যাট। ইতঃপূর্বে তিনি কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শীর্ষ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা– ডিফেন্ড অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডারপা)-য়। সেখানে তিনি, রোবোটিকস চ্যালেঞ্জ, রোবোটিক রিসার্চ এবং নিউরোমরফিক কম্পিউটিং রিসার্চ- কর্মসুচিগুলোর নেতৃত্ব দেন।   


তিনি বলেন, ব্যাটারি উৎপাদনে সর্বোচ্চ ছয় ধরনের ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজের দরকার হয়। ব্যাটারি উৎপাদনের কারখানা দুই থেকে তিন বছরে তৈরি করা গেলেও, খনিগুলোকে পুরোপুরি সচল করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। ফলে পৃথিবীতে ব্যাটারির খনিজের বিপুল মজুত থাকার পরও – আগামী ১০-২০ বছরে এসবের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেবে বলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)-সহ অনেক বিশেষজ্ঞ পূর্বাভাস দিয়েছেন।

 

এর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু কারণেও হাইড্রোজেন-চালিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিনসহ হাইব্রিড বিভিন্ন বিকল্পের জন্য সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হলে শুধু জল নিঃসৃত হয়। এক্ষেত্রে লিথিয়ামের ঘাটতি বা ব্যাটারি রিসাইকেল নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না।  


তারপরও এইচওয়াইএসই উদ্যোগের মাধ্যমে যেসব ছোট অন্তর্দাহ ইঞ্জিন তৈরি করা হবে – সেসব বাণিজ্যিকভাবে কতোটা সফল হবে সেই প্রশ্নই এরপর ওঠে।  

জাপানে হাইড্রোজেন জ্বালানির অবকাঠামো পর্যায়ক্রমে বিস্তার লাভ করছে। এপর্যন্ত ১৭০টি রিফুয়েলিং/সার্ভিস স্টেশন নির্মিত হয়েছে। জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প- বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০৩০ সাল নাগাদ ৯০০টি স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে হাইড্রোজেন-চালিত বাহনের চাহিদা প্রত্যাশিতভাবে দেখা দিলে আরো দ্রুত এসব স্টেশন নির্মিত হবে।   


বর্তমানে জাপানের সবচেয়ে বড় অটোমোবাইল জ্বালানি বিতরণকারী এএনওএস- দেশজুড়ে প্রায় ১৩ হাজার সড়কের পার্শ্ববর্তী সার্ভিস স্টেশন পরিচালনা করছে।     


সম্প্রতি দেশটির কোবে শহরে এমকে নামক একটি ট্যাক্সি কোম্পানি শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব যানবাহনের জন্য একটি হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন চালু করেছে। ওই স্টেশনে আগে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহৃত হতো। সেটিকে হাইড্রোজেন জ্বালানি উপযোগী করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি 'এয়ার লিকুইড', যা বিশ্বে এই প্রথম। এই সাফল্যের হাত ধরে আগামীদিনে জাপানের দূরপাল্লার ট্রাক, বাস ও অন্যান্য যানবাহনের জন্য আরো হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণ করবে ফরাসি কোম্পানিটি।


কামিংসের দৃষ্টান্ত


এইচওয়াইএসই'র ছোট যানবাহনের জন্য ইঞ্জিন তৈরির উদ্যোগ নতুন হলেও, মূল ধারণাটি বেশ পুরোনোই। ২০২১ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক কামিংস এক ঘোষণায় জানায়, তারা হাইড্রোজেন-চালিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। ভারি ট্রাক, এক্সকেভেটর, ড্রিলিং রিগ, হুইল লোডারসহ নির্মাণ ও শিল্প যন্ত্রের জন্য দূষণমুক্ত ইঞ্জিন নির্মাণের লক্ষ্যে তারা এ গবেষণা হাতে নেয়।


আর চলতি বছরের মার্চে 'কনেক্সপো' শিল্প প্রদর্শনীতে কামিংস তাদের নতুন ১৫ লিটার অন্তর্দাহ ইঞ্জিন প্রদর্শন করেছে, এটি হাইড্রোজেন জ্বালানি, গ্যাস বা ডিজেলে চলতে পারবে। কোম্পানিটির এরমধ্যেই ট্রাক শিল্পের থেকে এ ধরনের শত শট ইঞ্জিনের অর্ডার পেয়েছে বলে জানা গেছে।


কামিংসের বিবৃতি অনুসারে, 'হাইড্রোজেন-চালিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিত উচ্চ ওজন বহনকারী যান ও বহুল ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির জন্য একটি আদর্শ, তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল সমাধান'। কারণ, এসব চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ব্যাটারি-চালিত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য বেশ সীমিত, পাশাপাশি হাইড্রোজেন-ফুয়েল সেল এখনও অর্থনৈতিকভাবে সুলভ হয়নি।"   


তারা আরো জানায়, 'হাইড্রোজেন চালিত (অন্তর্দাহ) ইঞ্জিন বর্তমানে যে ধরনের ট্রাক রয়েছে, সহজেই সেগুলোয় স্থাপন করা যায়। বর্তমানে এই শিল্পের যে পরিষেবা নেটওয়ার্ক রয়েছে তার সাথেও এটি সহজে যুক্ত হতে পারে।


কামিংসের হাইড্রোজেন ইঞ্জিন শাখার মহাব্যবস্থাপক জিম নেবারগাল বলেন, 'এসব ইঞ্জিন দেখতে আর পাঁচটা সাধারণ ইঞ্জিনের মতোই, শব্দেও একইরকম। গাড়ির যে স্থানে সাধারণ ইঞ্জিন যেখানে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানেই এগুলো স্থাপন করা যায়'। শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনে ইচ্ছুক ট্রাকে মালামালবাহী কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি 'আদর্শ' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


হাইড্রোজেন ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে নিজস্ব ওয়েবসাইটে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে কামিংস।


কামিংস যেখানে বৃহৎ ইঞ্জিনের দিকে উদ্যোগ নিয়েছে, ঠিক তখনই ক্ষুদ্র ইঞ্জিনের ঝুঁকছে জাপানি কোম্পানিগুলো। ফলে জ্বালানি ও পরিবহন শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরই আভাস মিলছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.