জানেন সত্যজিত রায়ের সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক
ODD বাংলা ডেস্ক: বাংলার শেষ নবাবের কাহিনী কারোরই অজানা নয়। পলাশীর প্রান্তরে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন অবসান হয় তার। সেইসঙ্গে বাংলা পুরোপুরি চলে যায় ব্রিটিশদের দখলে। বাংলার নবাবি আমলের ইতিহাসের বেশ খানিকটা অংশ জুড়েই রয়েছে ভালোবাসা, লোভ-লালসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর যুদ্ধের ঝনঝনানি। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে অজস্র প্রাচীন কাহিনী। সেখানে ইতিহাসকে বারবার উজ্জ্বল করেছে ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমা। অন্যদিকে কলঙ্কিত আর রঞ্জিত করেছে বিশ্বাসঘাতকতা।
তবে নবাবদের জীবন নিয়ে কতোটুকু জানেন আপনি? সিরাজউদ্দৌলার ছিল অবৈধ এক পুত্র সন্তান। তবে কেবল নবাবের কন্যা উম্মে জোহরার কথাই সবাই জানে। এই সন্তান ছিল সিরাজউদ্দৌলার দ্বিতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগমের। তিনি ছিলেন সিরাজের মা আমিনা বেগমের একজন হিন্দু পরিচারিকা। তাঁকে রাজকুনোয়ার বলে ডাকা হতো। পরে সিরাজ তাকে বিয়ে করেন এবং নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা বেগম। তবে সিরাজের অবৈধ সেই পুত্র সন্তানের কথা অজানা কারণে চাপা পড়ে গেছে। চলুন আজ সেই সন্তানের মা কে? কীভাবেই বা তার আগমন আর এখনই বা তিনি কোথায়? সবই জানাবো আপনাদের।
১৮ বছর বয়সে সিরাজ বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি নবাব হওয়ার পর যেই দুইজন মানুষকে সবচেয়ে কাছের ভেবেছেন তাদের মধ্যে একজন মোহনলাল। আসল নাম মোহনলাল রায়। কলকাতার হিন্দু কায়স্ত ছিলেন তিনি। খুব অল্প দিনেই নবাবের আস্থাভাজন হয়ে যান তিনি। কাশ্মীর থেকে আগত মোহনলাল ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একজন পেশকার। তবে প্রভাবের দিক দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমান দায়িত্ব পালন করতেন। মোহনলালের কন্যার বিয়ে হয়েছিল নবাবের এক সেনাপতির সঙ্গে। এদিকে মোহনলালের এক বোন ছিল। তার নাম ছিল মাধবী। আদর করে তাকে ডাকা হত হীরা। মূলত তিনি ছিলেন অসম্ভব রূপবতী । এই রূপের কারণেই তাকে সবাই হীরা বলে ডাকত।
কাশ্মীর থেকে আগতা হীরার রূপে মুগ্ধ হলেন সিরাজউদ্দৌলা। মোহনলালের বোন হীরার সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার অন্তরঙ্গতা হলো। ক্রমেই বাড়তে লাগল তাদের ঘনিষ্ঠতা।সময়ে অসময়ে সিরাজউদ্দৌলা ছুটে যেতেন হীরার কাছে। হীরা কিন্তু নবাবের গুপ্তচরও ছিল। ধারণা করা হয়, হীরাই ছিলেন বাংলার প্রথম নারী গুপ্তচর। নিজের জীবন বাজি রেখে নবাবের জীবন রক্ষা করেছেন বহুবার।
ঘনিষ্ঠতার ফলস্বরূপ হীরার গর্ভে সিরাজের এক অবৈধ পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। যথারীতি হীরার কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন সিরাজউদ্দৌলা। তিনি জানতেন বৃদ্ধ আলিবর্দি খাঁ এই সংবাদ পেলে ভীষণ ক্রদ্ধ হবেন। সিরাজউদ্দৌলা হীরাকে সন্তানের কথা গোপন রাখতে বললেন, কোনোভাবেই যেন এই কথা আলিবর্দি খাঁর কানে গিয়ে না পৌঁছায়। সিরাজের গোপন হেফাজতে বেড়ে উঠতে লাগল সেই সন্তান।
কিন্তু সিরাজ জানতেন পুত্র বড় হচ্ছে, খবর বেশিদিন গোপন রাখা যাবে না। আলিবর্দি খাঁ যে কোনদিন জেনে যাবেন। একদিন সকালবেলা সিরাজউদ্দৌলা হীরার কাছে এসে বললেন, পিতা পুত্র ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসি! খুশি হয়ে হীরা পুত্রকে নতুন জামা পরিয়ে সাজিয়ে তুলে দিলেন সিরাজউদ্দৌলার হাতে। সিরাজ পুত্রকে নিয়ে গেলেন ফাঁকা মাঠের ভেতর, তাকে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে বেঁধে দিলেন। তারপর ঘোড়ার শরীরে তীর ছুঁড়ে মারলেন। তীরবিদ্ধ ঘোড়া পিঠের উপর সিরাজউদ্দৌলার পুত্রকে নিয়ে তীব্রবেগে ছুটে চলল!
খবর পেয়ে ছুটে এলেন হীরা, কিভাবে তিনি সন্তানকে বাঁচাবেন? হীরা ছুটে গেলেন ভাই মোহনলালের কাছে। মোহনলাল নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন সিরাজউদ্দৌলার ঘোড়া যেদিকে গেছে সেইদিকে। তীরবিদ্ধ আহত ঘোড়ার নাগাল পেয়ে তিনি ঘোড়া থামালেন। হীরার কোলে ফিরিয়ে দিলেন তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে। এই ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন মোহনলাল, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাবেন। এই খবর গেল আলীবর্দী খাঁর কানে। বহুদর্শী আলিবর্দি খান বুঝতে পারলেন এই সাহসী, সৎ এবং বিশ্বস্ত লোককে পরিত্যাগ করলে বিপদটা সিরাজেরই।
জেনে গেলেন সিরাজ আর হীরার কথা। বাদ রইল না অবৈধ পুত্রের কথাও। তাই ইমামের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসার একটি সূত্র বের করেন। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো আলিয়া। তারপরে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সিরাজের সঙ্গে আলিয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আলিবর্দীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরাজের পুত্রের দায়িত্ব মোহনলালকেই গ্রহণ করতে হয়। হীরাঝিল এই সিরাজপত্নীর নামেই, এখানে সিরাজ ও হীরার বিয়ে হয়েছিল বলে জানা যায়।
পলাশীতে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের সেনাবাহিনী যখন বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত। তখন মোহনলাল বুঝতে পারলেন ইংরেজ সৈন্যরা এবার নবাব পরিবারের সবাইকে আটক করবে। তারা সিরাজউদ্দৌলা আর তার বংশধরদের হত্যা করবে।মোহনলার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে এলেন। চারদিকে তখন হৈ হুল্লোড়। আর্তের বাঁচার আকুতি, হত্যা, চিৎকার! মোহনলাল ইংরেজ গুপ্তচরদের বিভ্রান্ত করতে রটিয়ে দিলেন তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছেন। মোহনলালের যুদ্ধে জখম হওয়ার খবর দাবানলের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
মোহনলাল ছুটে গেলেন সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদে। তিনি সিরাজের শিশুপুত্রকে নিয়ে পালালেন। তার সঙ্গে রইল আর দুইজন বিশ্বস্ত সাথী বাসুদেব আর হরানন্দ। তারা পালাতে পালাতে আশ্রয় নিলেন ময়মনসিংহের বোকাইনগর দূর্গে। সাথী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায়ের কাছে শিশুটিকে রেখে তার নিরাপত্তা বিধান করলেন মোহনলাল। মোহনলাল সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বড় ছেলে কৃষ্ণকিশোর চৌধুরীর কাছে গেলেন। তাকে ছয় বছরের শিশু সন্তানকে দত্তক নেওয়ার কথা বললেন। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দুই ছেলে, কৃষ্ণকিশোর আর কৃষ্ণগোপাল। ছোট ছেলে কৃষ্ণগোপাল দুইবার বিয়ে করলেও তার কোনো সন্তান হয়নি। কৃষ্ণগোপাল সন্তান দত্তক নিতে রাজি হলেন।
কৃষ্ণগোপাল জানতে চান এটি কার সন্তান? মোহনলাল শিশুর সত্যিকারের পরিচয় গোপন করে বললেন, বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় সন্তান। কৃষ্ণকিশোর কিংবা কৃষ্ণগোপাল কেউ জানতে পারলেন না তারা সিরাজউদ্দৌলার পুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন। কৃষ্ণগোপাল বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। পুত্র দত্তক নেয়ার অনুষ্ঠানে তিনি জমিদারীর সবাইকে নিমন্ত্রণ জানালেন। পুত্রের নাম রাখলেন যুগলকিশোর রায়চৌধুরী।
সিরাজ পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। এভাবেই নতুন করে যাত্রা শুরু করে মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশ। যা অনেকেরই অগোচরে ছিল। সেনাপতি মোহনলালের দুই বিশ্বস্ত সঙ্গী বাসুদেব এবং হরনন্দ ছাড়া এই বিষয়ে কেউই কিছু জানতেন না।শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর পুত্র কৃষ্ণগোপাল দুইবার বিয়ে করলেও কোনো সন্তান হয়নি। বেশ আদরেই তার পরিবারে বড় হয়ে ওঠেন যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। শুধু তাই নয় বেশ দাপটের সঙ্গেই সামাল দিয়েছেন ময়মনসিংহের জমিদারি। যদিও পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণগোপালের দুই স্ত্রী যুগলকিশোরের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে অবগত হন এবং বিরোধ শুরু হয়। যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এই সময়েই নিজের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারেন যুগলকিশোর চৌধুরী। জানতে পারেন তিনি আসলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পুত্র। তার দুই পালিত মা তাকে ইংরেজদের কাছে ধরিয়ে দিতে পারেন। সেই আশংকাও ছিল যুগলকিশোরের মনে। আর ইংরেজরা জানতে পারলে কখনোই সিরাজ পুত্রকে বাঁচিয়ে রাখবে না। সেই কারণে শ্রীহট্ট জেলায় গিয়ে আত্মগোপন করেন যুগলকিশোর।
ফরিদপুর জেলার যাপুর গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের রুদ্রাণী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। তার গর্ভেই হরকিশোর এবং শিবকিশোর নামের দুই পুত্রের জন্ম হয়। একইসঙ্গে জন্ম নেয় আরও চার কন্যা। অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা এবং মুক্তিদা। শিবকিশোরের আয়ু খুব বেশি ছিল না। শিব কিশোর রাজশাহী জেলার বৃকুৎসা গ্রামের কাশীনাথ মজুমদারের মেয়ে ভাগীরথী দেবীকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে কৃষ্ণমণি নামে এক কন্যার জন্ম হয়। কৃষ্ণমণির অল্প বয়সেই মৃত্যু হয় পিতা শিবকিশোরের।
রুদ্রাণী দেবীর দুই পুত্র সন্তানের মৃত্যু ঘটলে যুগলকিশোর ফের বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী যমুনার গর্ভে জন্ম নেয় পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথ রায়চৌধুরী। শেষ জীবনে এই পুত্র সন্তানকে নিজের জন্মের ইতিবৃত্ত বলে গিয়েছিলেন যুগলকিশোর। একইসঙ্গে অবগত করেছিলেন ইংরেজদের থেকে এই নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখতে। ১৮১১ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে মৃত্যু হয় যুগলকিশোরের।
এরপরে প্রাণকৃষ্ণনাথ রায়চৌধুরীর মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে সিরাজউদ্দৌলার বংশ। প্রাণকৃষ্ণনাথ রায়চৌধুরীর প্রথম পুত্র কাজল ১২ বছর বয়সে মারা যায়। দ্বিতীয় পুত্র শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পরেন। এই বিষয়টি জানতে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলেন প্রাণকৃষ্ণনাথ।পুত্র শৌরীন্দ্রকিশোরকে নিজেদের পারিবারিক পরিচয় সম্পর্ক অবগত করে এই সকল বিষয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন তিনি। পিতার পরামর্শে এবং ইংরেজদের থেকে বাঁচতে নাম বদল করে লেখাপড়ায় মন দেন। শৌরীন্দ্রকিশোর নাম বদল করে প্রথমে প্রসন্ন চন্দ্র রায়চৌধুরী এবং পরে প্রসন্ন কুমার দে বলে পরিচিত হন। স্কলারশিপ পেয়ে ১৮৪৮ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময়েই হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয়।
প্রসন্ন কুমার দে ওরফে প্রসন্ন চন্দ্র চৌধুরী ওরফে শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তিনটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর গর্ভে একটি, দ্বিতীয় স্ত্রী মোহিনীর গর্ভে দুইটি এবং তৃতীয় স্ত্রী হিরন্ময়ীর গর্ভে ছয় পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। প্রথম স্ত্রী ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রসন্ন কুমার দের সন্তানের নাম হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্য জগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদাদা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। যদিও নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধরদের সঙ্গে বাংলার বিখ্যাত রায় পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই।
তবে এখনকার সেই ধারা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না কেউ। তবে চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের বর্তমান প্রজন্মের দিকে দেখলেই সিরাজউদ্দৌলার সেই সন্তানের বংশ পাওয়া যায়। যদিও এটি একদিক থেকে সিরাজউদ্দৌলারই বংশধরই বলা যায়।
Post a Comment