আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মেয়াদ প্রায় শেষ, এরপর কী হবে?
ODD বাংলা ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)-এর মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। আগামী আট বছরের মধ্যে স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এ নিয়ে হয়তো খুব বেশি দুঃখের কিছু নেই, বরং আইএসএস-এর এ মহাপ্রস্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষ মহাকাশভ্রমণের নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবে।
১৯৯৮ সালে আইএসএস প্রোগ্রাম শুরু হয়েছিল। সর্বপ্রথম রাশিয়ার জারিয়া নামক মডিউল পাঠানোর মাধ্যমে এ স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মহাকাশে মনুষ্যনির্মিত সর্ববৃহৎ স্থাপনাটি তৈরিতে বিশ্বের প্রায় এক ডজনের বেশি দেশ একত্রে কাজ করেছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, এ প্রজেক্টের কারণে স্নায়ুযুদ্ধের পর দুই চিরশত্রু রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি অংশীদারিত্বের সূচনা হয়।
মার্কিন বিমানবাহিনীর স্কুল অভ অ্যাডভান্সড এয়ার অ্যান্ড স্পেস স্টাডিজ-এর মহাকাশ নীতি বিশেষজ্ঞ ওয়েন্ডি হুইটম্যান কব বলেন, 'এটি একটা বিশাল ব্যাপার ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পর সহযোগিতামূলক মনোভাবের দারুণ একটি গল্প এটি।'
বৈশ্বিক এ প্রচেষ্টার ফলে জন্ম হয় বিশাল এই মহাকাশ স্টেশনের। প্রায় একটি ফুটবল মাঠের মতো বড় এবং ৪০০ মেট্রিক টনের বেশি ভরবিশিষ্ট আইএসএস আমাদের পৃথিবীকে ঘণ্টায় ২৮,৯৮০ কিলোমিটার গতিতে প্রদক্ষিণ করছে। এটি তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০০০ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো কোনো নভোচারী মহাকাশ স্টেশনটিতে পা রাখেন। এরপর থেকে নিয়মিতই তাদের আনাগোনা ছিল সেখানে। কিন্তু এখন স্টেশনটির যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০৩১ সালে এটিকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে মহাসমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে।
আইএসএস-এ মার্কিন ও রাশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন অংশ রয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় ও জাপানের তৈরি মডিউলও আছে এটিতে। আর এ সবগুলো অংশেই এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব গবেষণার তালিকায় আছে আলঝেইমার ও পার্কিনসনস রোগ নিয়ে অনুসন্ধান, পদার্থের নতুন অবস্থা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা, ও মহাকাশে লেটুস ও মূলার মতো খাবার জন্মানোর পদ্ধতি বের করার চেষ্টা।
অবশ্য আইএসএসকে সফল হিসেবে দেখেন না সবাই। যুক্তরাজ্যের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল লর্ড মার্টিন রিজের মতে, এ মহাকাশ স্টেশনে করা গবেষণা থেকে যে বৈজ্ঞানিক আউটপুট পাওয়া গেছে, তার সাপেক্ষে এগুলোর খরচ পড়েছে অনেক বেশি। তার পরামর্শ, বিশ্বের দেশগুলোর রোবোটিক মিশনের ওপর আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে তিনি দুর্দান্ত সফল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ও বর্তমানে মঙ্গলে চলমান বিভিন্ন মিশনের উদাহরণ টেনে আনেন।
তবে অন্যপক্ষের দাবি, গবেষণার চেয়েও আইএসএস-এর মূল সাফল্য হচ্ছে মানুষকে মহাকাশভ্রমণকারী প্রজাতি হিসেবে একত্রিত করতে পারা। মার্কিন মহাকাশ বিশ্লেষক লরা ফরজিক বলেন, 'মহাকাশমুখী সভ্যতা হওয়ার তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে এটি আমাদের মানসিকতাকে বদলে দিয়েছে।' অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সার্বিকভাবে মানুষের পক্ষে মহাকাশ স্টেশন তৈরি না করে কোনো উপায় ছিল না।
পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অনেক যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংঘাতের সময়ও টিকে ছিল আইএসএস। সর্বশেষ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছিল স্টেশনটি। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক যৌথ উদ্যোগ আর দেখা যাবে কি না তা নিয়ে এখন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম-এর মহাকাশ ইতিহাসবিদ ক্যাথি লুইস বলেন, 'রাশিয়ানরা আর এ ধরনের মহাকাশ প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে না। তারা নিজেরাই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। আর ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে তাদেরকে আর এ ধরনের প্রকল্পে গ্রহণ করাও হবে না।'
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উত্তরসূরির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।
আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে পৃথিবীর কক্ষপথে আইএসএস-এর বদলে নতুন একাধিক বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করা হবে। নাসা ইতোমধ্যে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মানুষ পাঠানোর কাজ স্পেসএক্স ও বোয়িং-এর মতো কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছে। নতুন মহাকাশ স্টেশন তৈরির জন্য বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থাটি। এসব স্টেশনগুলো হতে পারে ছোট ছোট গবেষণাগার অথবা মহাকাশ পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে বানানো গন্তব্য।
এসব কোম্পানির একটি হচ্ছে অ্যাক্সিওম স্পেস। এটি ইতোমধ্যে স্পেসএক্স-এর রকেট ব্যবহার করে নিজেদের বেতনভুক নভোচারীদেরকে কক্ষপথে পাঠাতে শুরু করেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এটি আইএসএস-এ নিজেদের মডিউল সংযুক্ত করার আশা করছে। তেমনটা হলে এ মডিউল পরে আবার খুলে নিয়ে আলাদা মহাকাশ স্টেশনে পরিণত করা যাবে। অ্যাক্সিওম চাইছে সেগুলোকে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ভাড়া দিতে।
অবশ্য সবাই এ ধারণা মেতে ওঠেননি এখনো। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড অ্যান্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর নভোচারী জনাথন ম্যাকডোয়েল বলেন, 'মহাকাশে ব্যবসা করার এ পরিকল্পনাকে আমি সত্যিই সন্দেহের চোখে দেখছি। আমার কোনোভাবেই মনে হয় না, কারও পক্ষে কোনো লাভজনক মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা আদৌ সম্ভব।'
তবে নাসা ও আইএসএস-এর অন্যান্য অংশীদারেরা এ সুযোগগুলো পরখ করে দেখতে চায়। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)-এর প্রধান জোসেফ আশবেখার বলেন, 'আমরা সব পক্ষের সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছি। আইএসএস-এর সমাপ্তির পর মহাকাশে গবেষণা চালিয়ে নেওয়ার পথ খুঁজে বের করতে আমার ভীষণ আগ্রহী।'
নাসা প্রতিবছর আইএসএস-এর পেছনে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। আইএসএস-এর পরে এ অর্থ অন্য মিশনে ব্যয় করতে পারবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এ মহাকাশ সংস্থাটি। চন্দ্রপৃষ্ঠে পুনরায় মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার জন্য নাসা বর্তমানে আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছে। ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো ১৭-এর পরে আগামী ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো চাঁদকে আবর্তন করবেন চারজন নভোচারী। 'স্টেশনটির খরচ অনেক। নাসা চাইছে আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়ে এগিয়ে যেতে,' বলেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ নীতি বিশেষজ্ঞ জন ক্লেইন।
নাসার অন্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতায় চাঁদের কাছে লুনার গেটওয়ে নামক একটি মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা। এ দশকের শেষের দিকে এ স্টেশনটির নির্মাণ কাজ শুরু হতে পারে। এর আকৃতি আইএসএস-এর মতো বড় হবে না, তবে ভবিষ্যতে চাঁদে মানুষের অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে লুনার গেটওয়ে।
এছাড়া, আইএসএস চূড়ান্তভাবে ধ্বংস না করারও একটি সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক কোম্পানি বলছে, পুরো স্টেশনটিকে কক্ষচ্যুত করা হবে পুরোদস্তুর অপচয় — বরং এটির কিছু মডিউল ও রিসোর্স মহাকাশে নতুন করে ভিন্ন কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে। নাসা অবশ্য এখনো এ ধরনের কোনো চিন্তার পক্ষে সায় দেয়নি। তবে ভবিষ্যতে এটি আইএসএস পুরোপুরি ধ্বংস করা নিয়ে মত পালটাতে পারে।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিসলুনার ইন্ডাস্ট্রিজসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি আইএসএস-এর বিভিন্ন অংশ পুনরায় ব্যবহার নিয়ে হোয়াইট হাউসে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল। সিসলুনার ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সিইও গ্যারি কালনান জানান, হোয়াইট হাউসের এ প্রস্তাবটি পছন্দ হয়েছে।
মহাসমুদ্রে বিসর্জন অথবা অন্য কোনো কাজে অংশবিশেষ ব্যবহার করা — যেকোনো একভাবে আইএসএস প্রকল্প ২০৩১ সালে শেষ হবে। মহাকাশে এটির জায়গা নিতে পারে ছোটছোট অনেক স্টেশন। তবে আইএসএস 'মৃত্যুর' পরেও এক অনন্য কিংবদন্তি রেখে যাবে, কিন্তু এটির সমাপ্তি হয়তো মহাকাশ অভিযানের নতুন কোনো সূচনার ইতিহাস তৈরি করবে।
Post a Comment