যেভাবে প্রাণিকুল গরম মোকাবিলা করে



 ODD বাংলা ডেস্ক: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমাগত বাড়তে থাকা তাপদাহে বিপর্যস্ত মানুষ ও প্রাণিকুল উভয়ই। আমরা যেমন নানা উপায়ে গরম থেকে বাঁচার চেষ্টা করি, অন্যান্য প্রাণীও বিচিত্র সব পন্থায় নিজেদেরকে তাপদাহ থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। আমেরিকার ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ ফেডারেশন ও ভারমেন্ট গার্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসেস এর প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।


সাপের হয়েছে জ্বালা, কচ্ছপ আর ব্যাঙেরও অসুবিধা একইরকম। এগুলো শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। খুব গরমে এরা কয়েক ঘণ্টার বেশি টিকতে পারে না। দেহের মধ্যকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের ছায়া দরকার হয় বেশি। তবে ইঁদুরজাতীয় প্রাণী যেমন মোল, ভোল বা গফাররা নিজেদের গর্তে ঢুকিয়ে নেয় গরম বেশি পড়লে। তারা সাধারণত সূর্য না ডোবা পর্যন্ত গর্তেই থাকে আর সন্ধ্যায় খাবার খুঁজতে বের হয়। সাপের অবশ্য গর্ত খোঁড়ার দক্ষতা আছে কিন্তু খুব বেশিদূর যেতে পারে না।


বস্তুত যারা মাটির যত গভীরে যেতে পারে তারা তত ঠান্ডায় থাকতে পারে। ভোঁদরজাতীয় প্রাণীদেরও গর্ত খোঁড়ায় দক্ষতা আছে, তবে তারা জনবসতির আশপাশের জায়গা বেছে নেয়। আর হঠাৎ কেউ সেখানে উপস্থিত হলে ঘাবড়ে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে।  


প্রশ্ন হলো, যাদের খোঁড়াখুড়ির দক্ষতা নেই তারা কী করে? ছায়া তো তাদেরও দরকার। কাঠবিড়ালী বা বেজিদের মতো প্রাণীগুলো তখন গাছের কোটরে আশ্রয় নেয় অথবা গাছের ডালে ঘাপটি মেরে থাকে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো গর্তে গিয়ে ঢোকে। মানুষের ঘর-বাড়িতেও তারা আশ্রয় খোঁজে যেগুলো অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে।


কিছু শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী আবার গ্রীষ্মকালীন গভীর নিদ্রায় চলে যায়। শীতনিদ্রার মতোই এ নিদ্রায়ও প্রাণীগুলোর পরিপাকক্রিয়া ধীরগতি লাভ করে এবং একটি বড় সময় ধরে তারা খাবার ও জল না খেয়ে থাকতে পারে। শীতনিদ্রার সময় প্রাণীদের শরীরে উষ্ণতা তৈরি হয় কিন্তু গ্রীষ্মকালীন নিদ্রায় তারা ঠান্ডা অনুভব করে।


শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীরাই সাধারণত এ সুযোগের অধিকারী হয়। তবে কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীও (উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট) গ্রীষ্মকালীন নিদ্রায় চলে যেতে পারে। নিশাচর প্রাণীরা আবার দিনের গরমে ঘুমিয়ে নেয় আর রাতে বের হয় দিনের অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে।


এরপর আসে স্নান বা শরীর ভেজানোর ব্যাপারটি। বন্যপ্রাণীর জন্য জল খুব গুরুত্বপূর্ণ আর গরম দিনে এটা প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। জল কেবল তাদের পিপাসাই মেটায় না, শরীরের তাপমাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। পাখিদের যেমন গরমের দিনে প্রায়ই পাখা আর পালক ভিজাতে দেখা যায়। উভচর প্রাণীদেরও জল দরকার হয় শরীরের শুষ্কতা রোধের জন্য। স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পশম ভিজিয়ে তাদের শরীর ঠান্ডা রাখে। প্রাণিকুল সাধারণত মুক্ত জলাশয় পছন্দ করে তবে জনবসতির জলাশয়েও তারা উপস্থিত হয়ে যেতে পারে।


যে ৭ উপায়ে গরমের সঙ্গে লড়াই করে প্রাণিকুল:


ঘাম নিঃসরণ: মানুষের মতো ঘোড়াও প্রচুর ঘামে। ঘাম প্রাণীদের ঠান্ডা থাকতে সাহায্য করে কারণ ঘাম শুকিয়ে গেলে ত্বকে ঠান্ডা অনুভূত হয়। কুকুরের ঘাম বেরোয় পা দিয়ে। তবে সারা শরীর ঠান্ডা করতে এটি যথেষ্ট নয়। হাঁপিয়ে, অর্থাৎ দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে কুকুর গরম থেকে রেহাই নেয়।


তাপ বিকিরণ: হাতির সুবিধা আছে কান দিয়ে তাপ বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার। রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে ঘটে ঘটনাটি। শরীরের ভিতরের অতিরিক্ত তাপ কান পর্যন্ত পৌঁছে রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আর শেষে তা কান দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ঠান্ডাভাব প্রবাহিত হয় শরীরের ভিতর এবং তাপ কমে।


গ্রীষ্মকালীন গভীর নিদ্রা: কিছু প্রাণী অতিরিক্ত গরমে সুপ্তাবস্থায় চলে যায়। পর্যায়টিকে গভীর ঘুম বলাই ভালো। এসব প্রাণীর মধ্যে ব্যাঙের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির শামুকও আছে। আগেই বলা হয়েছে শুষ্কতা ও গরম থেকে বাঁচতে তারা গর্তের ভিতর ঢুকে পড়ে।


এক্ষেত্রে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার লাঙফিশ (যার ফুলকা ও ফুসফুস উভয়ই আছে) একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ; যারা শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়ের কাদামাটিতে গর্ত খুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যায় এবং নিজেদের দেহ একটি আবরণে মুড়ে ফেলে। বৃষ্টিতে জলাশয়গুলো ভরে উঠলে আবার তারা জেগে ওঠে।  


লুকিয়ে পড়া: সরীসৃপদের মধ্যে বিশেষ করে টিকটিকি ও সাপ গরম বাড়লে দ্রুতই পাথরের আড়ালে বা গর্তের ভিতর চলে যায়। সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেক্সিকোর ১২ শতাংশ টিকটিকি হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া, পাঁচটি মহাদেশে টিকটিকির সংখ্যা কমে গেছে খাবারের অভাবে। কারণ দীর্ঘসময় তাদের লুকিয়ে থাকতে হয়েছে, এতে প্রজননও ব্যাহত হয়েছে।


হাঁপানো: অনেক প্রাণীকেই গরম থেকে রেহাই পেতে দ্রুত শ্বাস নিতে ও ছাড়তে দেখা যায়। কুকুরকে এ অবস্থায় দেখা যায় বেশি। পাখিরাও হাঁপায়; তাদের ফুসফুসের সঙ্গে বায়ুথলি থাকায় তারা বাড়তি সুবিধাও পায়।


পশম ঝরানো: অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী শীতকালে অধিক পশমের কারণেই ঠান্ডা থেকে রেহাই পায়। আবার গ্রীষ্মকালে পশম ঝরিয়ে গরম থেকে রেহাই নেয়।


জলে ডুব দেওয়া: পুকুর বা জলধারায় প্রায়ই দেখা যায় হাতিকে। বাঘও গরম আবহাওয়ায় জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করে। পাখিরা জল পেলে পাখা ও পালক ভিজিয়ে নেয়।  


'গরমকালে জলের অভাবই প্রাণীদের কষ্টের বড় কারণ'


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, বস্তুত গরমকালে জলের অভাবই প্রাণীদের কষ্টের বড় কারণ। তখন জলাশয়গুলোর জল শুকিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে প্রাণীরা জনবসতির কাছে যায় এবং মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ে।


সাধারণত গরম থেকে রেহাই পেতে তারা ছায়াময় জায়গায় আশ্রয় নেয় বা শরীর জলে ডুবিয়ে রাখে। পাখিদের ক্ষেত্রে তারা পাখা ও পালক ভিজিয়ে গা ঠান্ডা করে, ডিম থাকলে বাবা কিংবা মা পাখি ছায়া দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। নিজেদের শরীর ভিজিয়ে এনেও তারা ডিম ঠান্ডা রাখে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.