‘যদি জিততে না পারো, তবে প্রতিরোধ করো’: কামুর কথা মনে ছিল দাবা চ্যাম্পিয়ন ডিং লিরেনের
ODD বাংলা ডেস্ক: সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়েছেন চীনা দাবাড়ু ডিং লিরেন। মাত্র চার বছর বয়স থেকেই দাবার প্রতি তীব্র ঝোঁক সৃষ্টি হয় ৩০ বছর বয়সী এই গ্র্যান্ডমাস্টারের। তবে শুধু দাবাই নয়, পাশাপাশি বাবার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন লিরেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ভালবাসেন বৃষ্টি উপভোগ করতে, বই পড়তে। দাবার পাশাপাশি 'দর্শন' তার আগ্রহের বিষয়।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে লিরেনের যাত্রাটা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো। পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই চরম মানসিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ফাইনালে রাশিয়ার ইয়ান নিয়েপোমনিয়াশিকে হারিয়ে চীনের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় থাকা অবস্থাতেই এল পাইসকে সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন লিরেন। নিজের অনুভূতি ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন নরওয়ের ম্যাগনাস কার্লসেনের স্থলাভিষিক্ত হওয়া এ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
একইসাথে নিজের জয় উদযাপনের চরম ব্যস্ততার মাঝেই প্রায় ১৫টি চীনা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন লিরেন। তিনি বলেন, "আমি জানি, গণমাধ্যমে কথা বলাটাও গুরুত্বপূর্ণ।"
সাংবাদিকদের ক্যামেরা, ক্যাবল ও বিভিন্ন যন্ত্রের সামনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার খুব একটা অভ্যস্ততা নেই লিরেনের। একইসাথে ইংরেজিতে খুব একটা সাবলীল নন তিনি। তবুও গণমাধ্যমের প্রতি নিজের সম্মান প্রদর্শন করে সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এ গ্র্যান্ডমাস্টার।
আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশনের সাথে অফিসিয়াল সাক্ষাৎকারে আসরের দ্বিতীয় ম্যাচ হারার পর তার এক বন্ধুর দেওয়া উপদেশের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি চীনের হয়ে মাইলফলক সৃষ্টি করা এ দাবাড়ু।
দাবার পাশাপাশি বইপত্র পড়তেও পছন্দ করেন লিরেন। জানান, কিছু কিছু বই তাকে দাবার দুনিয়ায় আরও ভালো খেলোয়াড়ে পরিণত হতে সহায়তা করেছে। "আলবার্ট কামুর প্রতিরোধের ধারণা মনে পড়েছিল। বিষয়টা হলো, আমার কাছে যদি মনে হয় আমি জিততে পারছি না, তখন সবকিছুর বিনিমিয়ে আমাকে পরাজয় আটকাতে হবে। খেলার কামুর এ কথাটা আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছে।"
লিরেন মনে করেন, দর্শন ও দাবা খেলার মধ্যে একটা চমৎকার মিল রয়েছে। দুটোই অনেকটা বিমূর্ত বিষয়। দাবা এমন একটি খেলা, যেখানে একজন খেলোয়াড়কে বেশ দক্ষ ও বাস্তববাদী হতে হয়। তাই দাবা খেলার সময় মাথা থেকে আবেগ দূরে সরিয়ে রাখেন লিরেন।
এ সম্পর্কে লিরেন বলেন, "আমি একইসাথে বেশ আবেগীয় ও যৌক্তিক চিন্তাধারার একজন মানুষ। আমি শিল্প সম্পর্কেও বেশ উৎসাহী। স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সময় আমি সাধারণত বৃষ্টি হলেও সেটা খুব উপভোগ করি। বাস্কেটবল খেলি। কিন্তু আমি যখন দাবা খেলতে আসি, আমার এসব বিষয়গুলো ক্ষণিকের জন্য ভুলে যেতে হয়। নিজেকে অনেক বেশি পেশাদার হিসেবে চিন্তা করতে হয়।"
তবে দাবাড়ু হিসেবে পেশাদার আচরণের মধ্যে খেলোয়াড়ভেদে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন রাশিয়ান দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ু ছিলেন। তিনি ম্যাচ জিতেই সন্তুষ্ট থাকতেন না, বরং নিজেকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করতে চাইতেন। অন্যদিক পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দ আবার ব্যাতিক্রম। তিনি নিজের মতো স্বাভাবিক খেলাটাই খেলে যেতেন।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে যেয়ে লিরেন বলেন, "আমি নিজেকে একজন স্কলার হিসেবে মনে করি যে পড়তে ভালবাসে। আমি দাবা খেলাটাকে নতুন আঙ্গিকে খেলতে শিখেছি। আমি যখন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ৭০০ জনের তালিকায় চলে আসি, তখন নিজের দক্ষতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমি বুঝতে পারি যে, আমার তীব্র প্রতিযোগিতা করার জন্য চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে।"
চীনের ওয়েনজু শহরে জন্ম নেওয়া লিরেনের মা পেশায় নার্স। আস্তানায় হওয়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ছেলের সাথেই ছিলেন তিনি। আর লিরেনের বাবা পেশায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যার একান্ত ইচ্ছার কারণেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন এ দাবাড়ু।
বাবার ইচ্ছার কারণেই দীর্ঘ পাঁচ বছর আইন পড়ে ডিগ্রি নিয়েছেন লিরেন। তবে প্রথম থেকে বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না তার। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এ দাবাড়ু বলেন, "পড়াশোনা নিয়ে আমি খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করি না।"
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পুরো বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে লিরেনের ক্যারিয়ারের পরবর্তী ভাগের দিকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমাকে একটা শক্ত দল বানাতে হবে। যে দলে দাবার অভিজ্ঞ সব শিক্ষক ও শক্তিশালী সব কম্পিউটার থাকবে। সংক্ষেপে, আমাকে আরও পেশাদার হতে হবে।"
ফাইনালের আগে অবশ্য লিরেন জানান, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা তার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং ধীরে ধীরে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে ওঠাটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনাল ম্যাচের আগে লিরেন তার অ্যানালিস্টের পক্ষ থেকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমার ফাইনালে জেতার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ১২ নম্বর অবস্থানে থাকা রোমানিয়ান দাবাড়ু রিচার্ড র্যাপোর্ট। খেলা শুরু করার সময় আমি সাধারণত যে ভুলগুলো করতাম রিচার্ড সেগুলো শুধরে আমার মাঝে সৃজনশীলতা এনে দিয়েছেন।"
স্বপ্নের মতো একটি দল গঠন করার পর সকলের বিরুদ্ধেই নির্ভয়ে খেলতে চান লিরেন। তিনি বলেন, "আমি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। আগের আসরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কারসেন যদি তার শিরোপা পুনরুদ্ধারের জন্য চ্যালেঞ্জ দিতে চায়, আমি তবুও প্রস্তুতি আছি।"
দাবা ফেডারেশনের অফিসিয়াল সাক্ষাৎকারে লিরেনকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনাটি সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত কি না সেটি জিজ্ঞেস করা হয়। এক্ষেত্রে বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতা উডি অ্যালেনের কথা স্মরণ করেন তিনি।
লিরেন বলেন, "উডি অ্যালেনের মতে 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' বললে কাউকে খুব বেশি ভালোবাসার অর্থ সবসময় প্রকাশ পায় না। তেমনটা বোঝানোর জন্য এর চেয়েও শক্তিশালী বাক্যের দরকার। আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনেকটা এমন। আমি খুশি বললেই অনুভূতিটা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারব না। এরচেয়েও শক্তিশালী শব্দ প্রয়োজন।"
তবে আসর শুরুর পূর্বে অবশ্য ব্যর্থ হলে দাবা খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথাই ভেবেছিলেন লিরেন। তিনি বলেন, "আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম যে, আমি যদি হেরে যাই তবে আমি অবসর নিয়ে নিতে পারি। এবং আমি নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি যদি জিতে যাই তবে আনন্দে খুব কান্না করব। আমি আসলেই জিতেছি এবং খুশিতে অনেক করে কান্না করেছি। আমি এখন আর অবসরের কথা ভাবছি না এবং জীবন এখন অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।"
Post a Comment