অতি ধনীদের সন্তান দেখাশোনার কাজে দুই মাসেই সারাবছরের আয়, ঘণ্টাপ্রতি ১৬৭ ডলার!



 ODD বাংলা ডেস্ক: গ্লোরিয়া রিচার্ডস বছরের যে সময়টা অফ-ব্রডওয়ে থিয়েটারে কাজ করেন না, সেসময় তিনি বিলিয়নিয়ারদের সন্তানদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। এমনকি কোনো কোনো বিত্তশালী অভিভাবকের সাথে তার কখনো সরাসরি দেখাও হয় না। কিন্তু এই 'ন্যানি'র কাজ করে গ্লোরিয়া কত টাকা আয় করেন তা জানলে চোখ কপালে তুলবেন অনেকেই! সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি সূত্রে জানা গেছে, এই কাজের মাধ্যমে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬৭ ডলার করে আয় করে থাকেন গ্লোরিয়া।


নিউইয়র্কে অফ-ব্রডওয়ে থিয়েটার এবং ভার্জিনিয়ায় ওয়ান-ওম্যান শো করার পাশাপাশি বছরের ছয় মাসই ধনকুবেরদের সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শুধু ঘণ্টাপ্রতি পারিশ্রমিকই নয়, সেই সঙ্গে গ্লোরিয়ার ফ্লাইটে যাতায়াত খরচ ও থাকার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, তার বার্ষিক আয়ের ৮০-৯০ শতাংশই আসে এ কাজ থেকে।


"বছরের প্রথম দিকে দুই মাস ন্যানির কাজ করলেই আমি বছরের বাকি সময় স্বচ্ছন্দ্যে চলতে পারি। এই বাচ্চাদের সঙ্গে খুব কাছে থেকে কাজ করার সুযোগ পাওয়াতেই আমার এই কাজটা করতে ভালো লাগে।"


পারিশ্রমিক থেকে শুরু করে দায়িত্ব-কর্তব্য, গ্লোরিয়ার কাজটিকে অনেক দিক থেকেই গতানুগতিক সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। উচ্চ বিত্তশালীদের সন্তানদের দেখাশোনা করার মানে শুধুমাত্র তাদের যত্ন নেওয়াই নয়, বরং কাজের বেশিরভাগ সময়ই তিনি এই শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক কাজের সময়সূচি-দিনক্ষণ সমন্বয়ের কাজে ব্যয় করেন।


১২-১৫ ঘন্টা কাজ করলে একদিনেই প্রায় ২০০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন গ্লোরিয়া। বিলিয়নিয়ারদের প্রাইভেট জেট ও ইয়টে করে ঘুরে বেড়ান তিনি; পোরশে ও টেসলার মতো গাড়িও চালান কাজের সময়ে। আর শিশুদের জন্মদিনের পার্টিতে তাকে দাওয়াত দেওয়া হয় যেখানে ফ্রিতে মেলে আইপ্যাড!


কিন্তু এই চাকচিক্য ও উচ্চ পারিশ্রমিকের পরিবর্তে গ্লোরিয়াকে যা করতে হয়: মা-বাবার অনুপস্থিতিতে বা অভিভাবকরা জটিল সম্পর্কে মধ্যে আছে- এমন পরিস্থিতিতে নিউরোডায়ভারজেন্ট (স্বাভাবিকের চেয়ে ব্যতিক্রম, অনেক সময় অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়) শিশুদেরকে মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া। স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম, প্রায়ই এমন শিশুদের সঙ্গী হয়ে ওঠেন তিনি। আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হওয়ায় তাকে সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে আরও সতর্ক আচরণ করতে হয়- তা নাহলে পে চেক না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 


কিভাবে নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন গ্লোরিয়া?


গ্লোরিয়া রিচার্ডসের ক্লায়েন্টদের মধ্যে কয়েকজন খুবই বিখ্যাত অভিনেতাও আছেন, যাদের সাথে তার কখনো দেখাই হয়নি। এদের মধ্যে একজনের কথা মনে আছে তার; যার চারপাশে নিরাপত্তা প্রহরী এবং মেকাপ আর্টিস্ট দিয়ে এমনভাবে ঘিরে থাকতো যে, তিন মাসের চাকরিতে তিনি একবার শুধু তার ক্লায়েন্টের মাথার কিছু অংশ দেখতে পেয়েছিলেন।


তিনি এমনও দেখেছেন যে তার ক্লায়েন্টরা প্রায়ই বিলাসবহুল বাড়ি কিনছেন এবং ৩২০০ ডলারের স্টেকের এক কামড় খাচ্ছেন। এমনই একজনের সন্তানের ন্যানি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিন তাকে এয়ারপোর্টে যেতে হয়েছিল। সেখানে তাকে বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখান থেকেই তাদের সহচরী হয়ে প্রাইভেট জেটে করে বার্বাডোসে এক রিসোর্টে চলে আসতে হয় তাকে।


গ্লোরিয়া একই সঙ্গে প্রায় ১০টি পরিবারে কাজ করতে পারেন। তিনি বলেন, তার কাজের দায়িত্বগুলো কি কি সেটা বুঝতে তার কিছুটা সময় লেগেছে। যদি না বাড়িতে কাজের লোকের অভাব থাকে, তিনি ঘর পরিষ্কার বা খাবার বানানোর মতো কাজগুলো করেন না।


বরং এর পরিবর্তে তিনি একজন 'মাদারলি ফিগার' হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। শিশুদেরকে মায়ের মতোই যত্ন করেন, মানসিকভাবে সহায়তা করেন। এমনকি একবার দুই অভিভাবক গ্লোরিয়ার নামের পদবী অনুসারেই তাদের সন্তানকে ইতালিয়ান বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন! 


চুক্তিপত্র


গ্লোরিয়া রিচার্ডস জানান, তারা মোট আট ভাইবোন। ১৪ বছর বয়সে তার অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়। তিনি জানান, ন্যানির কাজ করার বিষয়টি তার মধ্যে সহজাতভাবেই এসেছে।


এক দশক আগে যখন তিনি নিউইয়র্কে চলে এসেছিলেন, তখন রিবক স্পোর্টস ক্লাবের চাইল্ডকেয়ার বিভাগে কাজ করতেন তিনি। এখানকার কোনো কোনো সদস্য ছিল বেশ ধনী, তারাই তখন বেবিসিটিং (বাচ্চাদের দেখাশোনা) এর জন্য তাকে প্রস্তাব দিতেন।


তখন তার কোনো ধারণাই ছিল না যে কিভাবে এই কাজই নিয়মিত করা যায় বা কত পারিশ্রমিক নেওয়া উচিত। উপায় খুঁজতে খুঁজতে  তিনি ম্যাডিসন এজেন্সির শরণাপন্ন হলেন। ভ্রমণের প্রতি তার আগ্রহ এবং নিউরোডায়ভারজেন্ট শিশুদের নিয়ে কাজের ইচ্ছা তাকে একজন যোগ্য প্রার্থীতে পরিণত করে বলে জানান একেন্সির ডিরেক্টর অব অপারেশনস জ্যাকি মান। 


এছাড়াও, বিলিয়নিয়ারদের বাড়িতে কাজের জন্য যেমনটা প্রয়োজন, গ্লোরিয়ার সে ধরনের 'অসাধারণ  ব্যক্তিত্ব' রয়েছে।


তবে কখনো কখনো গ্লোরিয়া যখন বিদেশে থাকেন, কোনো কোনো ক্লায়েন্ট তার বেতন কমিয়ে দেন বা আগের চুক্তি ভঙ্গ করার মতো কাজ করেন।


তিনি বলেন, আগের স্টাফরা হয়তো তাদেরকে শুধুই টাকার জন্য 'ব্যবহার' করেছে, তাই তারা হয়তো কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু আমাকে সময়মতো বেতন না দিলে যে আমি বিভিন্ন বিল দিতে পারব না এটা তারা বোঝেন না।


"যেমন ধরুন, আমি সুইজারল্যান্ডে আছি। তখন তারা আমায় বলবে তাদের হাতে নগদ টাকা নেই, তাই আমাকে দিতে পারবে না। আবার ধরুন, আপনার কোনো আচরণ ভাল না লাগলেও তারা হুট করে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিবে, তারা এমনই", বলেন গ্লোরিয়া।


আর এই সময়েই ম্যাডিসন এজেন্সি তার ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করে। গ্লোরিয়া যেন সময়মত পারিশ্রমিক পান সেটা নিশ্চিত করে তারা।


আর্থিক লাভ, মানসিক ক্ষতি


ক্লায়েন্টের অপ্রত্যাশিত মুড সুইং এর সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করাটা গ্লোরিয়ার চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একজন বিলিয়নিয়ারের বাড়িতে ১০ বছরের বেশি সময় কাজ করার পর তাদের প্রতিও তার মায়া জন্মেছে বলে জানান তিনি।


তার অনেক ক্লায়েন্টই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও, স্বাভাবিক প্রচেষ্টার পরেও তারা সাধারণ মানুষের মত হেঁটে একটা দোকানে যেতে পারে না, এয়ারপোর্টে যেতে পারে না, তাদেরকে কথা দিয়ে বা শারীরিকভাবে হেনস্থা হতে হয়। আর এই সমস্যাটা বুঝতে পারেন বলেই গ্লোরিয়া তাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।


তিনি বলেন, "একজন শিশুর যত্ন নেওয়া কঠিন কিছু না। কিন্তু অত্যন্ত বিত্তশালীদের জন্য কাজ করতে আলাদা ধৈর্য্য লাগে, তাদের চাওয়াকে বুঝতে হয়।"


শুরুর দিকে ক্লায়েন্টের ভরসা অর্জন করতে তিনি তাদের সাথে ব্যক্তিগত অনেক কিছুই শেয়ার করেন। কিন্তু তবুও সতর্ক থাকতেই হয় তাকে।


"কখনো কখনো তাদের অনেক খারাপ সময়ে আমিই একমাত্র বন্ধু থাকি, কিন্তু পরমুহূর্তে আমাকে ত্যাগ করতেও তাদের বাঁধবে না", বলেন গ্লোরিয়া।


সেই সঙ্গে  বর্ণ নিয়ে কিছু সমস্যা তো আছেই। "আমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ পরিবারেই কাজ করতে হয়। আর বাচ্চারা ৬-৭ বছর বয়স হতে হতেই আমার মতো দেখতে মানুষদের ব্যাপারে তাদের একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়", বলেন তিনি।


সবকিছু মিলিয়েই গ্লোরিয়ার শেষ কথা, "আমাকে সবসময় মনে রাখতে হয় যে, যদিও এটা খুবই আপন করে নেওয়ার ও বাচ্চাদের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার মতো কাজ, কিন্তু দিনশেষে এটা তো একটা চাকরিই।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.