টাইটানিকডুবি: ৩,০০০ মাইল দূর থেকে উদ্ধারের আকুতি শুনেছিলেন একজন

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় টাইটানিক হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়ার পর জাহাজটির টেলিগ্রাফ অপারেটরেরা একাধিক ডিসট্রেস কল পাঠান — যদি কেউ শুনে সাহায্যের ব্যবস্থা করে এ আশায়।


ওইসব উদ্ধার সংকেত শুনে সবার আগে সাড়া দিয়েছিলেন একজন শৌখিন রেডিও অপারেটর — তাও টাইটানিকের অবস্থান থেকে ৪,৮০০ কিলোমিটার দূরে, যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ওয়েলস থেকে।


ওই ভদ্রলোকের নাম আর্থার মুর। শখের বসে নিজে নিজে টেলিগ্রাফের সংকেতগুলো আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। রেডিওটিও তার নিজেরই তৈরি করা ছিল।


বিপদ সংকেত শুনে আর্থার তড়িঘড়ি করে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাকে ব্যর্থমনোরথ হতে হয় — কারণ কেউই তার কথা শুনে বিশ্বাস করতে চাননি।


সম্প্রতি টাইটানিকের সম্পূর্ণ আকৃতির ডিজিটাল স্ক্যান প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে জাহাজটি সমুদ্রের তলায় কী পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে তা প্রথমবারের মতো জানা সম্ভব হয়েছে।


সেদিন আর্থার মুর টাইটানিকের দুর্ভাগা যাত্রীদের জন্য কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু তিনি সোনার প্রযুক্তির প্রাথমিক একটি রূপ উদ্ভাবন করেছিলেন যা কয়েক দশক পরে সমুদ্রতলে টাইটানিকের অবস্থান শনাক্ত করতে সাহায্য করেছিল।


স্থানীয়দের কাছে আর্থার মুর 'আর্টি' নামে পরিচিত ছিলেন। টাইটানিকডুবির বছর খানেক আগেই নিজের রেডিও যন্ত্রপাতির কারণে তিনি খবরের শিরোনাম হন।


১৯১১ সালে ইতালীয় সরকারের লিবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা আর্থার তার রেডিওর মাধ্যমে ইন্টারসেপ্ট করেন। এ ঘটনার দরুন ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি স্কেচ তাকে নিয়ে বড় করে খবর প্রকাশ করে।


১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আর্থার মুর। বাবার পরে ভাইয়ের সঙ্গে নিজেদের একটি কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নেন তিনি।


তরুণ বয়সে ওই কারখানায় এক দুর্ঘটনার ফলে আর্থার একটি পা হারান। তারপর থেকেই প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তার অনুরাগ তৈরি হয়।


তার প্রথম উদ্ভাবন ছিল বাইসাইকেল নিয়ে। নিজের বাইসাইকেলে তিনি এমন একটি কাউন্টারব্যালেন্স যুক্ত করেন যা ব্যবহার করে ভালো এক পা দিয়েই তিনি সাইকেল চালাতে পারতেন।


লেদ মেশিন থেকে একটি বাষ্পচালিত লোকোমোটিভের স্কেল মডেল তৈরি করে একটি ম্যাগাজিনের প্রতিযোগিতায় জয়ী হন আর্টি।


ওই প্রতিযোগিতার পুরস্কার ছিল মডার্ন ভিউজ অভ ম্যাগনেটিজম অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি নামক একটি বই। ওই বই পড়েই আর্থারের রেডিও টেলিগ্রাফি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়।


আর্থার পাতলা তামার তার দিয়ে তৈরি অনেকগুলো অ্যান্টেনা স্থানীয় শিরোই নদীর এক পাড় থেকে অপর পাড়ে পাহাড়ের ওপর গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন রেডিও সিগন্যাল পাওয়ার জন্য।


তার এ প্রযুক্তির ফলে তিনি অন্য রেডিও অপারেটরদের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্বের সিগন্যাল ধরতে পারতেন।


এসব কাজের জন্য মানুষ তাকে পাগল ভাবত। তারা বিশ্বাসই করতে পারত না এরকম কিছু তার ব্যবহার করে আর্টি রেডিও সিগন্যাল গ্রহণ করতে পারবে।


১৯৭২ সালের ১৫ এপ্রিল এমনটাই ভেবেছিলেন স্থানীয় কেয়ারফিলি স্টেশনের পুলিশেরা।


পুলিশ সদস্যরা তার কথা শুনে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন বলেই জানা যায়। 'আমরা দেখছি ব্যাপারটা। তুমি বরং গিয়ে ঘুমাও, আর বেশি চাপ নিও না।'


তবে দক্ষিণ ওয়েলসের বাইর মানুষজন আর্থার মুরের কথা গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলেন।


টাইটানিক ডোবার খবর পত্রিকায় আসার পর থেকেই স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো আর্টির পুলিশকে বলা তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখে।


শৌখিন রেডিওপ্রেমী বিলি ক্রফটস বলেন, 'ওয়েলসের ব্ল্যাকউডে তখন আর্টির এ ঘটনাকে অনেকে হয়তো কালোজাদু হিসেবে দেখেছিলেন, কিন্তু যারা প্রযুক্তিটি সম্পর্কে জানতেন, তারা বিষয়টি বুঝেছিলেন।'


বেতার টেলিগ্রাফি তখনকার দিনের ইন্টারনেট ছিল বলে মন্তব্য করেন ক্রফটস।


আর্টির 'প্রতিভা'র কথা ক্রমশ অনেকের গোচরে আসে। তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক 'অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও'।


সেরকমই একজন ছিলেন গুলিয়েলমো মার্কনি — রেডিও টেলিগ্রাফির অন্যতম উদ্ভাবক।


মার্কনি ধারণা করেছিলেন, রেডিও সিগন্যাল ৩,২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু আর্টি টাইটানিকের সিগন্যাল শুনেছিলেন ৪,৮০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব থেকে।


এক বছরের মাথায় মার্কনি তার বেতার কোম্পানিতে আর্থার মুরকে যুক্ত করে নেন।


মার্কনির শিষ্য হিসেবে আর্থার প্রথমবারের মতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ও ফকল্যান্ড দ্বীপের মধ্যে যোগাযোগের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্থার সোনারের প্রথমদিককার একটি সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। এ প্রযুক্তি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে মিত্রপক্ষের জাহাজগুলোকে জার্মান ইউ-বোট থেকে সাবধানে থাকতে সহায়তা করেছিল।


১৯৪৭ সালে জ্যামাইকাতে অবসর গ্রহণ করেন আর্থার মুর। এরপর তার লিউকেমিয়া ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য ব্রিস্টলে ফিরে আসেন তিনি। সেখানেই এক বছরের মাথায় মারা যান এ উদ্ভাবক।


১৯৮৫ সালে তার তৈরি ও সমৃদ্ধ করা সোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করেই প্রথমবারের মতো সমুদ্রের গভীরে বিধ্বস্ত টাইটানিকের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.