বিশ্বজুড়ে কে-ড্রামার ব্যাপক জনপ্রিয়তার রহস্য কী—ভবিষ্যতে কি এর পতন ঘটবে?
ODD বাংলা ডেস্ক: একটা বিধ্বংসী জোম্বি ভাইরাস, অটিজমে আক্রান্ত এক প্রতিভাবান আইনজীবী, হাইস্কুলে কটূক্তির শিকার হওয়া এবং বাচ্চাদের গেম-কিন্তু মারাত্বক টুইস্টসহ... এই সবগুলোর মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী? সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে বেশি দেখা ১০টি নন-ইংলিশ শো'গুলোর (ইংরেজি ভাষায় নির্মিত নয়) মধ্যে চারটির থিম হলো উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো। এগুলোর মধ্যে আরও একটি বড় মিল হলো, এই চারটিই কোরিয়ান ড্রামা।
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে চীন ও এশিয়াজুড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন শিল্পের বিস্তার ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে বেইজিং ইয়ুথ ডেইলির সাংবাদিকরা 'কোরিয়ান ওয়েভ' (বা হ্যালিউ) শব্দদ্বয় প্রচলন করেন। এর প্রায় ২৫ বছর পর আবারও সারা বিশ্বে এই ট্রেন্ড শুধু যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে তা নয়, একইসঙ্গে এই ইন্ডাস্ট্রি বিনোদন জগতে একটি বড় প্রভাব ফেলেছে।
ইরাক থেকে ভারত, মেক্সিকো থেকে শুরু করে মরক্কো- সর্বত্র কোরিয়ান ড্রামার জয়জয়কার। কোরিয়ান ড্রামাগুলো বিশ্বের সব দেশের দর্শকদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে এবং এ ধরনের শো-এর প্রোডাকশনে আরও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি গবেষকরা বলেছেন, 'পশ্চিমা আধিপত্যশীল ট্রান্সন্যাশনাল পপ সংস্কৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য বৈপরীত্য হলো কে-ড্রামা'।
২০২১ সালের বহুল আলোচিত সিরিজ 'স্কুইড গেম' বিশ্বব্যাপী যে ধরনের জনপ্রিয়তা পেয়েছে, আর কোনো শো এভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। অর্থের প্রয়োজনে মরিয়া একদল মানুষের একটি বিপজ্জনক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সিরিজ। এখানে ধাপে ধাপে বেশকিছু গেমসে অংশগ্রহণ করতে হয় প্রতিযোগীদের। এর মধ্যে যারা জিতবে তারাই পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারবে, কিন্তু যারা জিতবে না তাদের পরিণাম হলো মৃত্যু! স্কুইড গেম যে দর্শকের মন জিতে নিয়েছে তা বলাই বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের মোস্ট ওয়াচড তালিকায় আছে এটি।
কে-পপ সঙ্গীত এবং বিটিএস-এর মতো ব্যান্ডগুলো থেকে শুরু করে অস্কারজয়ী কোরিয়ান সিনেমা 'প্যারাসাইট'- কোরিয়ান সংস্কৃতির ব্যাপক জনপ্রিয়তার মাঝেই কোরিয়ান শো'গুলোর উত্থান ঘটেছে যা এখনও থামেনি।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে কোরিয়ান ড্রামা ব্লকবাস্টার হিট হওয়ার পেছনে গোপন রহস্য কী? আর এটির ভবিষ্যতই বা কী? কেন এগুলো দর্শকদের মধ্যে এতটা জনপ্রিয়?
সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটা ভালো কোরিয়ান ড্রামার চিত্রনাট্য যেমন জটিল, এই প্রশ্নের উত্তরটাও তেমনই জটিল। বৃহৎ অর্থে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন- জনপ্রিয়তার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো, কে-ড্রামার স্টোরিটেলিং অতি উচ্চমানসম্পন্ন এবং স্ক্রিনে এমনভাবে ডেলিভার করা হয় যা ভৌগলিক সীমারেখা ছাপিয়ে বিশ্বের সব অঞ্চলের দর্শকদের কাছে একটি সত্যিকার অর্থ তৈরি করে, বিশেষ করে নারীদের কাছে। নেটফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোও কে-ড্রামাকে এমন সব দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে যারা আগে কোনোদিন এগুলো দেখেইনি। কিন্তু সমৃদ্ধির এই মডেলটির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে- দক্ষিণ কোরিয়ার সৃজনশীল ইন্ডাস্ট্রি খুব সতর্ক না থাকলে তাদের বোনা স্বপ্নই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
'ভালো গল্প বলা'
কোরিয়ান পপ সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির কো্রিয়ান স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হতে চলা অ্যারম জং মনে করেন, কোরিয়ান ড্রামাগুলোর জনপ্রিয়তার পেছনে কোনো বিশেষ 'ফর্মুলা বা উপাদান' নেই। বরং কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যেগুলো এই 'কোরিয়ান ওয়েভ' সৃষ্টির পেছনে কাজ করছে।
"একটা উপভোগ্য গল্পের মধ্যেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যু তুলে ধরা, দক্ষ অভিনয় এবং ডিজাইন, এমন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যা লাখো মানুষের কাছে সহজলভ্য এবং একটা বার্তা দেওয়া যা দর্শকের মনোভাবের সঙ্গে মিলে যায়", সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন জং।
কিন্তু এই সবকিছুর পাশাপাশি মূল যে কারণটি রয়েছে তা হলো, কে-ড্রামাগুলোর স্টোরিটেলিং এর মান, বলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোরিয়া প্রোগ্রাম-এর পরিচালক গি-উক শিন।
"আমার মনে হয় এটা সবারই স্বীকার করা উচিত যে এই ড্রামাগুলোর কন্টেন্ট খুবই ভালো। মানুষ যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয় সেগুলোকে কেন্দ্র করেই গল্প বলা এবং দর্শকদের আকৃষ্ট করার মতো করে বলার একটা দারুণ ক্ষমতা আছে কোরিয়ার।"
এমনকি শুধুমাত্র কোরিয়ান সমাজ ও সংস্কৃতিকেন্দ্রীক বিষয় নিয়ে নির্মিত সিরিজেও এমন বার্তা দেওয়া হয় যা আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছেও ভালো লাগে।
"উদাহরণস্বরূপ, স্কুইড গেমে দেখানো হয়ে আর্থসামাজিক বৈষম্য, সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন শ্রেণী ও জেন্ডারের মানুষদের মধ্যে ক্ষমতা-প্রভাব বিস্তার নিয়ে চর্চা যা শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়া নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও দেখা যায়", বলেন জং।
চিন্তাশীল, চরিত্রের দ্বারা এগিয়ে নেওয়া ও মানবিক গল্প বলা- এই ট্রেন্ডটি কে-ড্রামা এবং কোরিয়ান সিনেমা উভয়ের মধ্যেই দেখা যায় যার মাধ্যমে পরিচালকেরা ভাষার গণ্ডি পেরোতে সক্ষম হয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, 'প্যারাসাইট' চলচ্চিত্রের কথা বলা যায়। ২০২০ সালে প্রথম ইংরেজি ভাষার বাইরের চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার জিতে নেওয়া এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে সমাজের উঁচুতলার ও নিচু তলার মানুষের মধ্যে বৈষম্য মানুষকে কোন পর্যায়ের অপরাধে নিয়ে যেতে পারে।
"এই ড্রামাগুলোর মধ্যে মানবিক আবেগের বিষয়টা খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়", বলেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি ক্যান্ডিডেট জুং স্টেফানি নহ।
একইসঙ্গে কোরিয়ান ড্রামাগুলোতে বিভিন্ন থিমে গল্প সাজানো হয় যা কোরিয়ান ও বিশ্বের অন্যান্য দর্শকদেরও আকর্ষণ করে। রোমান্স হোক বা থ্রিলার কিংবা ভৌতিক, গেমস, অ্যাডভেঞ্চার, কমেডি, অ্যাকশন, যুদ্ধ, ফ্যান্টাসি বা সায়েন্স ফিকশন- এই সব ঘরানার গল্প থাকে কে-ড্রামায়।
তবে শিন বলেন, "কোরিয়ান সাংস্কৃতিক কন্টেন্ট জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। যেমন, ভারত কিংবা লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্কের বিষয়টি থাকতে পারে, যেখানে রক্ষণশীল পরিবারগুলো দ্রুত পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। শিন বলেন, "ভারতীয় বলিউড বা লাতিন আমেরিকান টেলিনভেলার সঙ্গে কে-ড্রামার একটা সাদৃশ্য আছে। তাই এসব অঞ্চলে কে-ড্রামার জনপ্রিয়তা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে দিন দিন আরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা কে-ড্রামার মধ্যে পাওয়া যায়।"
'স্কুইড গেম' যখন লেট ক্যাপিটালিজমের তীব্র সমালোচনা করে, অন্যদিকে নেটফ্লিক্সের পঞ্চম মোস্ট ওয়াচড নন-ইংলিশ শো 'দ্য গ্লোরি'তে তুলে ধরা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কুলে শিশুদের কটূক্তির শিকার হওয়ার বিষয়টি। শীর্ষ তালিকার চতুর্থ শো 'অল অব আস আর ডেড'-এর বিষয়বস্তু হলো একটি হাইস্কুলে জোম্বি ভাইরাসের আক্রমণ। 'এক্সট্রাঅর্ডিনারি অ্যাটর্নি উ'-এর গল্প গড়ে উঠেছে অটিজমে আক্রান্ত এক তরুণ আইনজীবীকে কেন্দ্র করে, যিনি প্রতিভাবান এবং কর্মক্ষেত্রে অন্য আইনজীবীদের চেয়ে বেশি প্রতিভাবান, কিন্তু মানুষের সাথে দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়ায় তার সমস্যা হয়।
নহ বলেন, "কেউই জানে না পরবর্তী হিট শো কোনটি হবে, কিন্তু নির্মাতারা সবসময়ই নতুন নতুন বিষয়বস্তু খুঁজছেন এবং নিজেদের শো হিট বানানোর জন্য এক্সপেরিমেন্ট করেই চলেছেন।"
নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা
সব রকম বৈচিত্র্য ও বিশ্বজুড়ে কন্টেন্টগুলোর আবেদনের মধ্যেই কে-ড্রামায় একটি স্পষ্ট পদ্ধতি রয়েছে যা এটিকে সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে আলাদা করে তোলে।
"কোরিয়ান রমকম ড্রামাগুলো বিশ্বে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে কারণ এই শো'গুলো দেখে বিশেষত নারী দর্শকরা সন্তুষ্টি পেয়েছে এবং নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন ও ভালোবাসাকে তুলে ধরা হয়েছে- যা আমেরিকান কন্টেন্টগুলোতে পাওয়া যায় না", বলেন শিন।
নহ'র ভাষ্যে, "হলিউড সিরিজগুলোতে যখন মেল গেজই বেশি দেখানো হচ্ছে, এসব কে-ড্রামায় তখন 'ফিমেল গেজ' নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।"
আর এটা আসলে অবাক হওয়ার মতো বিষয়ও নয়। কারণ কোরিয়ান ড্রামা ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রনাট্যকারদের অধিকাংশই নারী এবং অনেক নারীই প্রোডাকশনের কাজে জড়িত আছেন। কোনো কোনো হিসাব অনুযায়ী, তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রনাট্যকারদের ৯০ শতাংশই নারী; অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে সকল পরিচালক, লেখক, প্রযোজক ও অন্যান্য পোডাকশন স্টাফ মিলিয়ে মাত্র ২৭ শতাংশ নারী।
প্রোডাকশনে দক্ষতা
কে-ড্রামা জনপ্রিয় হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এগুলো সাধারণত ভিজুয়ালি বেশ আকর্ষণীয় হয়। এই সিরিজগুলো দেখে মজা পাওয়া যায় এবং নান্দনিকতার দিকেও জোর দেওয়া হয় যা আমেরিকান সিরিজে থাকে না, বলেন শিন। উদাহরণস্বরূপ তিনি 'স্কুইড গেম' এর কস্টিউমের কথা বলেন। সেখানে প্রতিযোগীদের কস্টিউম রাখা হয়েছে সবুজ, আর এর বিপরীতে প্রহরীদের স্যুটের রঙ লাল। এই কস্টিউমগুলোই এত জনপ্রিয় হয়েছে যে টানা দুই বছর হ্যালোইনে এগুলোই রাজত্ব করেছে।
আর বিনিয়োগকারীরা এখন কে-ড্রামার দিকে ঝুঁকেছে বিধায় তাদের প্রোডাকশনের মানও দিন দিন শুধু উন্নতই হচ্ছে। "আর তাদের ইন্ডাস্ট্রিও খুবই সৃজনশীল এবং প্রাণবন্ত। সেই সাথে প্রতিযোগিতাপূর্ণও বটে, এজন্যই তাদের প্রোডাকশন এত ভালো হয়", বলেন নহ।
প্রথম দিকে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। পরবর্তীতে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে চীনারাও এদিকে ঝুঁকেছে। চীনা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম 'আইকিউআইওয়াইআই' (iQIYI) জনপ্রিয় কোরিয়ান সিরিজ 'মাই লাভ ফ্রম দ্য স্টার' এর ব্রডকাস্ট লাইসেন্স নিশ্চিত করেছে ৬০০,০০০ ডলারের বিনিময়ে এবং আরও ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় এই ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ কতটা লাভজনক। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই চীনা বিনিয়োগকারীরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
নেটফ্লিক্স নিয়ে 'উভয় সংকট'
জং বলেন, "কোরিয়ান সংস্কৃতি রপ্তানির পর বাইরের দেশগুলোতে এর জনপ্রিয়তার পেছনে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।"
২০১৫ সালে নেটফ্লিক্সের কোরিয়ান সার্ভিস শুরু হওয়ার পর থেকে নেটফ্লিক্সই এই ট্রেন্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রায় ২৩২.৫ মিলিয়ন পেইড সাবস্ক্রাইবার রয়েছে তাদের। "এই মুহূর্তে কোরিয়ান ড্রামাকে আরও দৃশ্যমান ও সহজলভ্য করে তুলতে নেটফ্লিক্স প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।"
দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রামা ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারীও এটি এবং কোরিয়ান কোম্পানিগুলোকে তাদের অরিজিনাল কন্টেন্টের প্রোডাকশনের জন্য ১১০ শতাংশ টাকা দিয়ে থাকে।
গত মাসে নেটফ্লিক্সের কো-সিইও টেড সারানডোস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের মধ্যে একটি বৈঠকের পর নেটফ্লিক্স ঘোষণা করেছে যে, এটি আগামী চার বছরে কোরিয়ান কন্টেন্টে ২.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। অথচ ২০২১ সালে কে-ড্রামার পেছনে ব্যয় তারা ব্যয় করেছিল ৪৬০ মিলিয়ন ডলার। তাই এখন কোরিয়ান প্রোডাকশনগুলোর কাছে তাদের কন্টেন্টের মান উন্নত করার জন্য আরও বেশি টাকা হাতে আছে।
আইকিউআইওয়াইআই বলছে, বড় বিনিয়োগ করার শো'গুলো থেকে আয়ও হচ্ছে মোটা অংকের। নহ বলেন, "হলিউডে এ ধরনের সফল শো পেতে গেলে প্রোডাকশন খরচ হতো অনেক বেশি।"
কিন্তু কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জি হুন পার্ক, ক্রিস্টিন এপ্রিল কিম এবং ইয়ংসুক লি তাদের প্রকাশিত গবেষণায় বলেছেন, নেটফ্লিক্সের ওপর এমন নির্ভরতার কিছু অসুবিধাও রয়েছে।
তারা বলছেন, প্ল্যাটফর্মটি বেশিরভাগ বড় বাজেটের কোরিয়ান নাটক-সিরিজের বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং রাইটকে একচেটিয়া নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিতে পারে; কারণ তাদের প্রোডাকশন 'এখন নেটফ্লিক্সের বিনিয়োগ ছাড়া অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পড়বে'।
নেটফ্লিক্স এখানে জড়িত থাকার কারণেই দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক, পরিচালক, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের বেতন যে হারে বেড়েছে যে, এই মুহূর্তে নেটফ্লিক্সের বিনিয়োগ ছাড়া তা অব্যহত রাখা সম্ভব নয়।
গবেষকরা আরও বলছেন, মার্কিন কোম্পানিটির আর্থিক আধিপত্য কোরিয়ান দেশীয় টিভি স্টেশন এবং প্ল্যাটফর্মগুলোকেও দুর্বল করে ফেলতে পারে। ফলে নেটফ্লিক্সের একচেটিয়া ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতে কী হতে পারে?
তাহলে কি 'কোরিয়ান ওয়েভ' শীর্ষস্থানে উঠে তারপর আবার এর পতন ঘটবে? এই প্রশ্ন আজ নতুন নয়।
কিছু দারুণ সাফল্যের পরে ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝিতে কে-ড্রামার রপ্তানি পড়ে যায়। এর কারণ ছিল, প্রধান বাজারগুলোর বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। চীনের শীর্ষস্থানীয় একজন টেলিভিশন অভিনেতা ঝ্যাং গুওলি কে-ড্রামা ওয়েভকে একটি 'সাংস্কৃতিক দখল' বলে উল্লেখ করেন। অভিনেতা জ্যাকি চ্যান দেশীয় চীনা শ্রোতাদের কোরিয়ান শো 'প্রতিরোধ' করা এবং এর পরিবর্তে দেশীয় পণ্য গ্রহণের আহ্বান জানান।
কিন্তু ২০০৯ সালে এটি পুনরায় নতুন সাজে ফিরে আসে এবং ফিল্ম, মিউজিক্যাল এবং পপ মিউজিকের পাশাপাশি ভৌগলিকভাবেও প্রসারিত হয়। কোরিয়ান ওয়েভ - বা 'হ্যালিউ ২.০- এর দ্বিতীয় প্রজন্মের সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই যে- এটি আর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের উপর নির্ভরশীল ছিল না। স্যাটেলাইট সম্প্রচারের পরিবর্তে নতুন 'কোরিয়ান ওয়েভ'কে এগিয়ে নিয়েছে মূলত সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট। কে-ড্রামাগুলো অনলাইনে এবং সাবটাইটেলসহ সহজলভ্য হয়ে ওঠে এবং কে-পপ পারফরম্যান্সের ক্লিপগুলো ইন্টারনেটে প্রচুর শেয়ার করা হয়, যা দক্ষিণ কোরিয়ার সাংস্কৃতিক রপ্তানির সুযোগকে আরও প্রসারিত করে।
অন্যান্য অনেক ইন্ডাস্ট্রির মতো কে-ড্রামা ইন্ডাস্ট্রিও কোভিড-১৯ এ সময় টিকে থাকার জন্য লড়াই করেছে। কোভিডের সময় তাদেরও প্রোডাকশন বন্ধ ছিল। কিন্তু তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী ব্লকবাস্টার হিসাবে কোরিয়ান সিরিয়ালের আশ্চর্য প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। এই প্রত্যাবর্তনই একাধিক অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে ফিরে আসা একটি ইন্ডাস্ট্রির সহনশীলতার দিকে গুরুত্ব দিতে নজর ফেরায় সকলের।
তবুও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েই যায়। জং বলেন, "কোরিয়ার সাংস্কৃতিক পণ্য যেমন বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছে, তেমনই এটি নিয়ে অনেক কথা বলারও আছে। কিভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার এই কাজগুলো জেন্ডার, জাতি এবং যৌন আবেদন নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের কথা প্রচার করতে পারে? সংখ্যালঘুদের কেন্দ্র করে এমন আরও ন্যারেটিভের প্রয়োজন রয়েছে এবং সাংস্কৃতিক উপযোগীতা এবং বর্ণবাদের বিষয়ে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত।"
Post a Comment