গাঁজা কি দুশ্চিন্তা কমায়?
ODD বাংলা ডেস্ক: সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে নিজের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ কমানোর জন্য প্রতিদিন একই কাজ করে থাকেন নিউইয়র্কের একটি অলাভজনক সংস্থার কর্মী টিম (ছদ্মনাম)। সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি ব্যাকপ্যাকে রাখা গন্ধনিরোধক কন্টেইনার থেকে একটি জয়েন্ট বের করে আগুন ধরান এবং নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এতে টান দেন। তার মতে, এটি তার মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। সংবাদমাধ্যম দ্য হিল এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিমের মতো যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক তরুণই ধোঁয়া, ভ্যাপিং বা অন্য কোনো উপায়ে গাঁজা (ক্যানাবিস) সেবন করেন।
২৭ বছর বয়সী টিম ছোটবেলা থেকেই দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। গাঁজা সেবন সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমি বলবো না যে এটা পুরোপুরি উদ্বেগ দূর করে, কিন্তু কিছুটা হলেও কমাতে সাহায্য করে। এটা আমাকে কিছুটা শান্ত রাখে।"
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত যে সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়, দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ তার মধ্যে অন্যতম।
মারিজুয়ানা যদিও কারো কারো ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা কমায়, কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে আবার তা বাড়িয়েও দিতে পারে- বিশেষ করে ড্রাগটি যদি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।
তবে মারিজুয়ানা আসলেই উদ্বেগ প্রশমিত করে বা উদ্বেগ তৈরি করে কিনা, তা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি গবেষকরা।
"মানসিক চাপ বা উদ্বেগের ক্ষেত্রে মূল কথা হলো, এ বিষয়ে আসলে আমাদের এখনও অনেককিছু জানার আছে", বলেন ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন এর জেনারেল ইন্টারনাল মেডিসিনের অধ্যাপক ডেভন কানসাগার।
থাইল্যান্ড: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘গাঁজার স্বর্গ’!
তবে কিছু পরিবর্তনশীল ফ্যাক্টর পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে বোঝা যায়- স্বল্প সময়ের জন্য গাঁজা মানুষকে কেমন অনুভব করায়।
যেমন, গাঁজা সেবনের আগে একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা কেমন ছিল তা গাঁজা সেবন-পরবর্তী অনুভূতির ওপর প্রভাব ফেলে যে- এটি সেবনের পর সে উদ্বেগ অনুভব করবে কিনা। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি ইতোমধ্যেই যে অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, গাঁজা সেবন সেটিকে আরও তীব্রতর করে।
এখানে লিঙ্গও একটি ভূমিকা পালন করে। ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কালেভদ্রে গাঁজা সেবনকারীদের মধ্যে নারীরা বেশি উদ্বেগ বা অস্তিরতা অনুভব করে এটি সেবনের পর।
"ব্যক্তি কোন লিঙ্গের তা ক্যানাবিস গ্রহণের প্রতিটি দিককেই প্রভাবিত করে। তাই লিঙ্গভেদে পার্থক্য দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই", বলেন ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন এর ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এস্থার চু।
কিন্তু তিনি এও সতর্ক করেন "এই পার্থক্যগুলো কী কী সে বিষয়ে বিজ্ঞান এখনও সবসময় একমত নয়। ক্যানাবিস গ্রহণের পর পুরুষের তুলনায় নারীদের যে নেতিবাচক উপসর্গ বেশি দেখা দিবেই বা অনুভূতি তীব্র হবেই- মেডিক্যাল লিটারেচারে এর কোনো স্পষ্ট ভিত্তি নেই।"
কোন প্রকারের ক্যানাবিস গ্রহণ করা হচ্ছে সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কারণ ক্যানাবিসের প্রকারভেদে এতে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল থাকে। মারিজুয়ানার প্রধান সক্রিয় উপাদান হলো এই টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল (টিএইচসি)।
"আপনি যদি এই গবেষণাগুলোর দিকে তাকান, যেখানে ক্যানাবিসে থাকা একটি সক্রিয় উপাদানকে প্লাসিবোর (রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য কোনো ঔষধ) সাথে তুলনা করেন এবং উদ্বেগের বিষয়টি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট ডোজ প্রয়োগ করলে অংশগ্রহণকারীদের উদ্বেগ কিছুটা কমাবে এটি",বলেন ইউসিএলএ সেন্টার ফর ক্যানাবিস অ্যান্ড ক্যানাবিনয়েডস-এর পরিচালক জিভা কুপার।
"কিন্তু যখনই গাঁজার উচ্চ ডোজ গ্রহণ করবে কেউ, তখন প্লাসিবোর তুলনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়", যোগ করেন তিনি।
মানুষ কোন উপায়ে গাঁজা সেবন করছে তা এই ড্রাগটি দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ কমাবে নাকি আরও বাড়িয়ে তুলবে সেক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
উইড গামি (ক্যানাবিসযুক্ত চুইংগাম) বা পট ব্রাউনি (ক্যানাবিসযুক্ত ব্রাউনি) খাওয়ার চাইতে যখন কেউ ভ্যাপিং (শ্বাস টেনে নেওয়া) বা ধোঁয়া গ্রহণের মাধ্যমে মারিয়াজুয়ানা সেবন করে, তখন টিএইচসি আরও দ্রুত রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে ও মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।
টিএইচসি মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই এই কেমিক্যালটি নিউরনে ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর নামক একটি অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়,যা মস্তিষ্ক ও দেহের অভ্যন্তরে যোগাযোগের স্বাভাবিক প্রবাহে পরিবর্তন আনে এবং ফলস্বরূপ ব্যক্তির মধ্যে আনন্দ-চঞ্চল অবস্থা তৈরি হয়।
শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে গাঁজা সেবন করলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যক্তির মধ্যে সেই চঞ্চলতা ও উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে, মারিজুয়ানাযুক্ত কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণের পর টিএইচসির পুরোপুরি প্রভাব তৈরি হতে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজ।
"কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যানাবিসযুক্ত এডিবল কিছু খাওয়ার পর অনেকেই বুঝতে পারে না যে এর প্রভাব তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে। তারা ভাবেন যে তারা যথেষ্ট পরিমাণে খাননি, তাই পুনরায় সেই খাবার বা পানীয় খান। ফলে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয় যখন ব্যক্তির শরীরে অধিক মাত্রায় টিএইচসি প্রবেশ করে এবং সে অস্বস্তি, উদ্বেগ, বিশেষ কোনো অক্ষমতা বা নেশাগ্রস্ত অনুভব করে", বলেন কুপার।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গাঁজা গাছের মধ্যে একশোরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানাবিনয়েড কম্পাউন্ড থাকে; টিএইচসি এগুলোর মধ্যেই একটি। ব্যক্তি যে প্রকারের ক্যানাবিস গ্রহণ করছে, তা কোন কোন কম্পাউন্ডের সমন্বয়ে তৈরি সেটিও উদ্বেগ প্রশমন বা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
আরও একটি ক্যানাবিস কম্পাউন্ড হলো ক্যানাবিডিওল বা সিবিডি, যা ক্যানাবিস সাটিভা গাছে পাওয়া যায়। টিএইচসির মতো সিবিডিও একটি সাইকোঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ড যা মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। তবে এটি গ্রহণ করলে টিএইচসি'র মতো নেশা হয় না।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিবিডি আসলে টিএইচসি এবং অন্যান্য ক্যানাবিনয়েডকে মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট কিছু রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে এবং ব্যক্তির মন-মেজাজের ওপর টিএইচসি'র প্রভাব কমিয়ে আনে।
এছাড়া বিভিন্ন প্রিক্লিনিক্যাল গবেষণাতেও অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত সমস্যা সমাধানে সিবিডি ভূমিকা রাখতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।
অদূর ভবিষ্যতে দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ প্রশমনের চিকিৎসায় গাঁজা ব্যবহার হতে পারে বলে ধারণা করা হলেও, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন- এই ড্রাগ বা অন্য কোনো উদ্বেগ-প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করা হলেও তা শুধু স্বল্পমেয়াদী একটা সমাধান হবে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক বিয়েট্রিজ কার্লিনি সংবাদমাধ্যম দ্য হিল'কে বলেন, কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা শান্তিপূর্ণ মানসিক অবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে এমন থেরাপিই বরং উদ্বেগ প্রশমনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হয়ে উঠতে পারে।
Post a Comment